
11/09/2025
আমি সুরবালা দেবী।আজ দুপুরে আমি আমার দুই ছেলের ঘরের দুই নাতনি, আর এক নাতিকে নিয়ে সুদূর কলকাতা থেকে আমার নিজের জন্ম ভিটে বটঝুড়ি গ্ৰামে এসেছি।আমার বড় ছেলে অভিরূপের মেয়ে অনুরাধা ,ছোট ছেলে অভিনবর মেয়ে শ্রবনা, আর ছেলে বাপ্পাদিত্য ,ওরফে বাপ্পা কে নিয়ে এই বট ঝুড়ি গ্ৰামে এসেছি।এখানে শুভাজিৎ নামে আমাদের নিজস্ব একটি অতিথি শালা আছে। আমি, আমার নাতি -নাতনি দের নিয়ে আমাদেরই এই অতিথিশালায় এসে উঠেছি।
এই গ্ৰামে আমাদের একটি বেসরকারি হাসপাতাল, একটি স্কুল,একটি অতিথি শালা, আর ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য একটা অনাথ আশ্রমও আছে।অতিথি শালায় এসে, দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে, বিকেলে আমি আমার নাতি নাতনিদের নিয়ে আমার নিজের পূর্ব পুরুষদের দ্বারা বাঁধানো নদীর ঘাটে এসে বসে আছি। নাতি নাতনিরা সবাই ঘুরে ফিরে জায়গাটা দেখছে, আর আমি আমার বার্ধক্য জনিত কারণে বেশি ঘোরাঘুরি না করে, নদীর ঘাটে বসে আমার বাল্য কালের পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছি।
এই বটঝুড়ি গ্ৰাম আমার জন্মস্থান হলেও, মাঝে অনেক গুলো বছর বাদ দিয়ে আমি এই গ্ৰামে নূতন করে আজ ক'বছর ধরে আবারও নিজের প্রয়োজনে আসা যাওয়া করছি।এই গ্ৰামে নতুন করে ক'বছর ধরে আসা যাওয়া করলেও আমার পূর্ব পুরুষদের এই বাঁধানো নদীর ঘাটে আমি আজ প্রায় ষাট- পঁয়ষট্টি বছর পরে এসে বসেছি। এতোদিন আমার এদিকটায় আসার কোন প্রয়োজন হয়নি বা আমাকে আমার পরিবারের কেউ আসতে দেয় নি।আজ আমি আমার নাতনি দের একান্ত অনুরোধে শাসনের বেড়াজাল টপকিয়ে, আমি আমার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটা ওদেরকে দেখাতে,ও ঘুরাতে নিয়ে এসেছি।
আমার বাল্য স্মৃতি-বিজড়িত এই নদী,এই নদীর ঘাট, এখন আমার মতোই বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত হয়ে, রুগ্ন হয়ে,ক্ষয়াটে দাঁত বেরিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
আগে এই ঘাটকে লাহিড়ীদের ঘাট বলেই সবাই জানতো। পরিত্যক্ত ক্ষয়াটে এই ঘাটকে দূর থেকে দেখলে এখন আর বাঁধানো ঘাট বলে মনে হয় না। এই নদী যদিও এখন আগের থেকে একটু শীর্ণ কায়া হয়ে আছে, তথাপি আমার ছোট বেলায় দেখা সেই নদীর থেকে তার সৌন্দর্য কোন অংশে এতটুকু ও ম্লান হয়ে যায় নি। এই নদী খরার সময় টুকু বাদ দিয়ে বেশীর ভাগ সময় জলে ভরা থাকে।প্রতি বছর বন্যার সময় এই নদী ফুলে ফেঁপে উঠে বিপদ সীমা অতিক্রম করে আশে পাশে জনজীবনকে বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে।আর অন্য সব সময় এই নদী ধীর স্থির শান্তই থাকে ।
এই নদী বছরের কিছুটা সময় বাদ দিয়ে ,বেশীর ভাগ সময় ভরা-আর বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উঠার জন্য সবাই এই নদীকে ফুলন্তি নদী নামেই চেনে।আমার ছোট বেলায় দেখেছি এই ফুলন্তি নদীতে নৌকা আর মানুষ জনে সব সময় অবিরাম যাওয়া আসা চলতেই থাকতো।বছরে দুবার ফুলন্ত নদীর পাড়ে লাহিড়ী দের নিদিষ্ট বারোয়ারী ঘাটে নৌকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের পন্য বেচা কেনার উদ্দশ্যে পসরা সাজিয়ে আসতো।তাদের আগমনের বার্তা পেয়ে গাঁয়ের বৌ- ঝিয়েরা বড় বড় ঘোমটা টেনে তাদের অভিভাবকদের সাথে ফুলন্তির পাড়ে এসে জড়ো হয়ে ,নৌকা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতো।আবার কখনো কখনো ব্যবসায়ীরা হকারদের মতো অন্যান্যদের পারিবারিক ঘাট গুলোতে এসেও জিনিস বেচাকেনা করতো।
আমি অনেকক্ষন হয় এখানে এসে বসেছি।এখন বিকেল হয়ে গেছে।সারাদিনের পরিশ্রমের পর- তপ্ত সূর্য ক্লান্ত হয়ে অস্তাচলে যাওয়ার পথে।একটু পরেই পাখিরা নিজের আলয়ে ফিরবে,নিজেদের মধ্যে এখন সেই প্রস্তুতি চলছে।আর কদিন পরেই দুর্গাপুজো।এই গ্ৰামেও তার ই প্রস্তুতি চলছে।
নদীর ওপারে ঘন কাশ ফুলের বন,আর এ পাড়ে একের পর এক সার দেওয়া বিশাল বিশাল সব বট বৃক্ষরা বার্ধক্যের ভারে ঝুরি নামিয়ে অহংকারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটের থেকে একটু দূরেই দশ-বারো বছরের গুটি কয়েক দামাল ছেলে মেয়ে- সেই বট বৃক্ষের ঝুরি ধরে মনের আনন্দে দুলছে।আর এই পড়ন্ত বিকেলে সেই বট বৃক্ষের ঝুরি ধরে দোল খেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।গ্ৰাম বাংলার সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।যা দেখলে নয়ন- মন সব জুড়িয়ে যায়।এইসব ছোট ছোট বাচ্চাদের দোল খাওয়া দেখে আমারও ছোটবেলার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
এই গ্ৰামের নাম বটঝুড়ি কে রেখেছে তা আমি ঠিক জানি না।তবে আমি ছোট বেলায় আমার পিসি-ঠাম্মী আর জেঠী-ঠাম্মীর মুখে শুনেছি আমার দাদুর বাবার বাবা, অর্থাৎ পড়ন্ত জমিদার কীর্তি নারায়ন লাহিড়ীর ছেলে হরি নারায়ন লাহিড়ী এই গ্ৰামের নাম রেখেছেন বটঝুড়ি গ্ৰাম। শুনেছি আমার পূর্ব পু্রুষ হরি নারায়ন লাহিড়ীই এই বটঝুড়ি গ্ৰামের পত্তন করেছিলেন।
আমার দাদুর তিন পুরুষ আগের পূর্ব পুরুষ কীর্তি নারায়ন লাহিড়ী যখন কেতুগ্ৰামের শেষ জমিদার ছিলেন তখন থেকেই জমিদারি তলানিতে এসে ঠেকেছিলো।কীর্তি নারায়নের সময় থেকেই একটু একটু করে জমিদার বংশের ভাঙ্গন ধরতে শুরু হয়। কীর্তি নারায়ন খুব সৌখিন আর অত্যাচারী জমিদার ছিলেন।কীর্তি নারায়নের দুই ছেলে ছিলো।বড় ছেলে হরি নারায়ন এবং ছোট চন্দ্র নারায়ন।
দুই ভাইয়ের মধ্যে হরি নারায়ন খুব বিচক্ষণ বুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন এবং হিসেবী জীবন যাপন করতেই ভালোবাসতেন ।তাই প্রজারা হরি নারায়ন কে খুব ভালোবাসতো, শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। ছোটভাই চন্দ্র নারায়ন কিন্তু বাবার মতোই প্রজাদের অত্যাচার করা,সুরা পান করা থেকে পুজোর সময় কলকাতা থেকে বাইজিদের এনে আসর বসানো, বিড়ালের বিয়ে থেকে শুরু করে সব কিছুই রপ্ত করে নিয়েছিলেন।
কীর্তি নারায়নের সময় থেকেই জমিদারীর টাকা পয়সা সব তলানিতে এসে ঠেকেছিলো।বাবার পথ অনুসরণ করে ছোট ছেলে চন্দ্র নারায়ন আরো এক ধাপ তলানিতে এগিয়ে নিয়ে গেল। এই সব নিয়েই বড় ছেলে হরি নারায়নের সাথে বাবা কীর্তি নারায়ন আর ভাই চন্দ্র নারায়নের প্রায়ই প্রকাশ্যে খিটিমিটি লেগেই থাকতো।
একদিন এই খিটিমিটির থেকেই ,টাকা পয়সার লেনদেনের হিসেব নিয়ে প্রচন্ড বাক বিতন্ডার সৃষ্টি হয়।এই বাক বিতন্ডার ফলেই আর সুরার নেশায় কীর্তি নারায়ন ,বড় ছেলে হরি নারায়ন কে সেই ক্ষনেই ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে দেন।
হরি নারায়ন সেই দিনই মায়ের, এবং আত্মীয় স্বজনদের শত বাঁধা অগ্ৰাহ্য করে ,সব সম্পর্ক ছিন্ন করে,ছয় মাস পূর্বে বিবাহিত নব বধূ প্রসন্নকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। হরি নারায়ন পরিবার নিয়ে নৌকায় চলতে চলতে কেতুপুর গ্ৰাম থেকে প্রায় বিশ ক্রোশ দূরে উত্তরে নিরিবিলিতে এই নদীর পাড়ে এসে বসতি স্থাপন করেন।
জমিদার পুত্র হরি নারায়ন যখন এই গ্ৰামে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তখন এই গ্ৰামের চারিদিক পাথুরে মাটি পরিবেষ্টিত ছিলো। পাথুরে মাটি পরিবেষ্টিত ছিল দেখে ক্রোশ কয়েক জমি কারো এক্তিয়ারভুক্ত ছিলো না। হরি নারায়ন পিতার দ্বারা বিতাড়িত হয়ে মনের দুঃখে, ক্ষোভে, বসবাস করার জন্য এই গ্ৰামটিকেই বেছে নেন।গ্ৰামটিকে সবুজে রূপান্তরিত করার জন্য,আর নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ করার জন্য ,ত্যাজ্য জমিদার পুত্র হরি নারায়ন লাহিড়ী অনেক গুলো ছোট ছোট বট গাছের চারা এনে নদীর পাড়ে পাড়ে রোপণ করেন। কালক্রমে সেই চারা গাছ বড় হয়ে তার থেকে ঝুড়ি নেমে মহীরুহর আকার ধারন করে। নদীর তীরে এই বট বৃক্ষ অতীতের -বর্তমানের কত অভিজ্ঞতা ও কত ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার হিসেব নেই।
প্রথমে এই গ্ৰামের নাম ছিলো মাঠ পাথুরে। পরে এই বট বৃক্ষের থেকে বিশাল- বিশাল ঝুড়ি বেরিয়ে আসায় হরি নারায়ন সবার উদ্দেশ্যে বলেন ,এবার থেকে এই গ্ৰামের নাম মাঠ পাথুরে নয়,এই গ্ৰামের নতুন নাম হবে বটঝুড়ি গ্ৰাম।হরি নারায়নের অনুগত প্রজারা তাই মেনে নেয়। তারপর সবার মুখে মুখে এই গ্ৰামের নাম হয়ে যায় বটঝুড়ি গ্ৰাম।
হরি নারায়ন যখন এই গ্ৰামে বসতি স্থাপন করেন তখন কেতুগ্ৰাম থেকে হরি নারায়নকে ভালোবেসে, খবর জেনে নিয়ে কয়েক ঘর ব্রাহ্মন মুচি, নাপিত, মালী,ধোপা, বৈদ্য সবাই পর পর চলে এসেছিলেন অত্যাচারিত জমিদারের হাত থেকে রক্ষা পেতে।
চলবে---------
পুরো গল্পটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে:
আমি সুরবালা দেবী।আজ দুপুরে আমি আমার দুই ছেলের ঘরের দুই নাতনি, আর এক নাতিকে নিয়ে সুদূর কলকাতা থেকে আমার নিজের জন্ম...