20/09/2025
মস্তিষ্কভোজী অ্যামিবা: একটি নীরব ঘাতকের বিবরণ
ভূমিকা
জীবাণুবাহিত রোগের ইতিহাসে এক ভয়ংকর নাম হলো মস্তিষ্কভোজী অ্যামিবা, যার বৈজ্ঞানিক নাম Naegleria fowleri। এটি একটি অতিক্ষুদ্র এককোষী জীব যা মানুষকে সংক্রমিত করে প্রাণঘাতী মস্তিষ্কজনিত রোগ সৃষ্টি করে, যার নাম Primary Amoebic Meningoencephalitis (PAM)। যদিও এই সংক্রমণ খুব বিরল, কিন্তু আক্রান্ত হলে এর মৃত্যুহার প্রায় ৯৭%–৯৯% পর্যন্ত, যা একে করে তোলে বিশ্বের অন্যতম মারাত্মক সংক্রামক জীব।
Naegleria fowleri কী?
Naegleria fowleri হল একটি থার্মোফিলিক (উষ্ণতাপ্রিয়) অ্যামিবা, অর্থাৎ এটি গরম জলে বেঁচে থাকতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। এটি সাধারণত মাটি, উষ্ণ জলাশয়, হট স্প্রিং, হ্রদ, নদী ও অপরিষ্কার সুইমিং পুলে পাওয়া যায়। এর আকার প্রায় ৮–১৫ মাইক্রোমিটার এবং এটি একটি প্রোটোজোয়া (Protozoa), অর্থাৎ অতি সহজ গঠনের এককোষী প্রাণী।
সংক্রমণের উপায়
Naegleria fowleri সাধারণত পান করার মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায় না। বরং, নাকের মাধ্যমে জল প্রবেশ করলে, বিশেষ করে যখন মানুষ সাঁতার কাটে, ডুব দেয় বা কোনোভাবে নাকে জল প্রবেশ করে, তখন এই অ্যামিবা নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়ে প্রবেশ করে সোজা মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। একবার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে এটি দ্রুতগতি মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংস করতে শুরু করে।
রোগের নাম: Primary Amoebic Meningoencephalitis (PAM)
PAM হলো মস্তিষ্ক ও মেনিনজেস (মস্তিষ্কের চারপাশে থাকা পর্দা)–এর একটি মারাত্মক প্রদাহ। এটি একটি অত্যন্ত দ্রুত গতির এবং প্রায় সবসময় প্রাণঘাতী রোগ।
লক্ষণসমূহ:
সাধারণত সংক্রমণের ১–১২ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
মাথাব্যথা
জ্বর
বমি
ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া
মনোযোগের অভাব
খিঁচুনি
বিভ্রান্তি
ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা বা কোমায় চলে যাওয়া
সংক্রমণ শুরু হলে রোগীর অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হতে থাকে এবং সাধারণত ৫–৭ দিনের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে।
সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ
Naegleria fowleri উষ্ণ ও মিষ্টি জলে বেশি সক্রিয়। নিচে কিছু উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের উদাহরণ দেওয়া হলো:
অপরিষ্কার ও উষ্ণ সুইমিং পুল
প্রাকৃতিক হট স্প্রিং
গ্রীষ্মকালে জলের স্তর কমে যাওয়া হ্রদ বা পুকুর
মাটিতে জমে থাকা গরম জল
অপরিষ্কার ট্যাপ বা নলকূপের জল যা নাকে প্রবেশ করে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর প্রাদুর্ভাব
Naegleria fowleri সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ডে বেশি দেখা গেছে। বাংলাদেশেও কিছু সন্দেহভাজন মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকাল ও বর্ষার সময়।
উল্লেখযোগ্যভাবে, পাকিস্তানের করাচি শহরে Naegleria fowleri জনিত মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যেখানে দূষিত জল ও অপরিকল্পিত নলকূপ ব্যবহারের ফলে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
Naegleria fowleri সংক্রমণের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই। তাই প্রতিরোধই সর্বোত্তম পথ।
কীভাবে ঝুঁকি এড়াবেন:
উষ্ণ জলে সাঁতার কাটা বা ডুব দেওয়া এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে।
নাকে জল ঢুকতে দেবেন না – সাঁতার কাটার সময় নোজ ক্লিপ ব্যবহার করুন।
হোম নাসাল রিন্স বা নাক ধোয়ার সময় পরিষ্কার, ফুটানো বা স্টেরাইল জল ব্যবহার করুন।
অপরিষ্কার ও অপ্রসিদ্ধ সুইমিং পুল এড়িয়ে চলুন।
শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ জলাশয়ে স্নান করতে দেবেন না।
চিকিৎসা ও আধুনিক অগ্রগতি
Naegleria fowleri সংক্রমণের চিকিৎসা এখনো অত্যন্ত জটিল। কিছু অ্যান্টি-অ্যামিবিক ওষুধ যেমন Amphotericin B, Miltefosine, Rifampin, এবং Azithromycin মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়। Miltefosine কিছু ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ফল দিয়েছে, তবে সফলতার হার এখনও খুব কম।
শীতল থেরাপি (Therapeutic Hypothermia) – অর্থাৎ রোগীর দেহের তাপমাত্রা কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখা – কখনো কখনো উপসর্গের গতি ধীর করে এবং চিকিৎসার সময় বাড়িয়ে দিতে পারে।
উপসংহার
Naegleria fowleri বা মস্তিষ্কভোজী অ্যামিবা একটি ভয়ংকর ও নীরব ঘাতক, যা সম্পর্কে জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এর চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন এবং মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি, তাই সচেতনতা ও প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা, নিরাপদ জল ব্যবহার, এবং ব্যক্তিগত সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমেই এই প্রাণঘাতী অ্যামিবার সংক্রমণ থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করা সম্ভব।