21/05/2025
সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ আইন নিয়ে শুনানী-
পাশারুল আলম- আজকে বলিষ্ঠ আইনজীবী কপিল সিব্বলের যে ১৫ টি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেগুলোর পেছনে থাকা আইনি ও নৈতিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশেষ করে ২০২৫ সালের ওয়াকফ সংশোধনী আইন এবং ভারতের সংবিধানের ধারা ১৪, ২৫, ও ২৬-এর আলোকে।
কপিল সিব্বলের যুক্তিগুলোর সংবিধানিক ও আইনগত বিশ্লেষণসহ বিশদ বিবরণ
১. মসজিদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বৈষম্যের অভিযোগ
সিব্বল বলেন, "মন্দিরগুলোর মতো মসজিদে ২০০০-৩০০০ কোটি টাকার চাঁদা আসে না।"
এটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক ভিন্নতা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অসাম্য তুলে ধরে। মন্দিরের আয় প্রায়শই সরকার-নিয়ন্ত্রিত বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখানে মসজিদ ও ওয়াকফ সম্পত্তি মূলত দান ও স্বেচ্ছাচারিতার উপর নির্ভর করে।
বিশ্লেষণ:
এই বক্তব্য একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বোঝায়, অন্যদিকে তা ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সমতা রক্ষার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে। সংবিধানের ধারা ১৪ অনুযায়ী সকল ধর্ম ও নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে, এবং সম্পত্তি পরিচালনায় এমন বৈষম্য বৈধ নয়।
২-৫. ওয়াকফের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত বিতর্ক
সিব্বলের যুক্তি অনুযায়ী, ১৯৫৪ সালের ওয়াকফ আইনের পূর্বে ওয়াকফ সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন ছিল না, বিশেষ করে "ওয়াকফ বাই ইউজার"-এর ক্ষেত্রে। কিন্তু সংশোধনের পর এটিকে বাধ্যতামূলক করা হয়। আদালতও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
বিশ্লেষণ:
ভারতের ওয়াকফ আইন ১৯৫৪ সালে প্রথম কার্যকর হয় এবং পরে ১৯৯৫ সালে আরও বিস্তৃত রূপ পায়। তবে ঐতিহাসিকভাবে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি কোনো আনুষ্ঠানিক রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। তাই হঠাৎ করে রেজিস্ট্রেশনকে একমাত্র বৈধতা নির্ধারক মানদণ্ড হিসাবে ধরা হলে, বহু শতাব্দী পুরনো ধর্মীয় সম্পত্তিকে অবৈধ বলে গণ্য করা হয়।
এটি ধারা ২৫ (ধর্মাচরণের অধিকার) এবং ধারা ২৬ (ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার)-এর সরাসরি লঙ্ঘন।
৬-৮. ওয়াকফ বাই ইউজার-এর অস্তিত্ব ও ঐতিহাসিক বৈধতা
সিব্বল স্পষ্ট করে বলেন, মন্দিরে যেমন চড়াও আসে, মসজিদে তেমনটি হয় না; তবুও মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায়, ইমাম নিয়োগ ও ধর্মীয় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ব্যবহারই ওয়াকফের প্রমাণ। বাবরি মসজিদও তেমনই এক ঐতিহাসিক ওয়াকফ বাই ইউজার।
বিশ্লেষণ:
ওয়াকফ বাই ইউজার মূলত ‘ইচ্ছাপত্র ছাড়াই ব্যবহারযোগ্য ওয়াকফ’। ভারতের বহু অঞ্চলে এটি প্রথাগতভাবে স্বীকৃত। একে অস্বীকার করলে তা ঐতিহাসিক ধর্মীয় সম্পত্তি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের উপর সরাসরি আঘাত। ধর্মীয় সম্পত্তিকে শুধুমাত্র নথিভুক্তির মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব নয়।
৯-১১. সরকার কর্তৃক হস্তক্ষেপ ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ
সিব্বল অভিযোগ তোলেন, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। মুতওয়াল্লির উপর জেল-জরিমানার বিধান দেওয়া হচ্ছে, যা অসাংবিধানিক।
তিনি বলেন, "আমি কেন প্রমাণ দেবো আমি মুসলমান? আমি কেন ৫ বছর অপেক্ষা করব?"
সংবিধানিক বিশ্লেষণ:
ধারা ২৫: ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। সরকারের মাধ্যমে ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করানো এই ধারার লঙ্ঘন।
ধারা ২৬: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বাধীনতা। ওয়াকফ পরিচালনায় প্রশাসনিক বিধিনিষেধ এই অধিকারকে খর্ব করে।
ধারা ১৪: আইনের চোখে সমতা। এক ধর্মের ওপর অতিরিক্ত বিধিনিষেধ চাপানো অসাম্যের উদাহরণ।
১২-১৩. ওয়াকফ বাই ইউজার বিলুপ্ত ঘোষণা ও ধর্মাচরণে প্রতিবন্ধকতা
সিব্বল বলেন, ওয়াকফ বাই ইউজার-এর ধারা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ধর্মীয় আইন ও ইসলামী বিধানের পরিপন্থী। ওয়াকফ একবার প্রতিষ্ঠিত হলে তা চিরস্থায়ী, বাতিলযোগ্য নয়।
বিশ্লেষণ:
ওয়াকফ একটি ‘সার্বজনীন ইবাদত ও ধর্মীয় সেবার জন্য নির্ধারিত অপ্রত্যাহারযোগ্য দান’। এটিকে বাতিল করার ক্ষমতা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নেই। সংবিধান বলেও রাষ্ট্র ধর্মীয় সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না যদি না তা জনস্বার্থে হয়।
১৪. ASI সংরক্ষিত সম্পত্তি ও ধর্মাচরণের অধিকার
প্রধান বিচারপতির যুক্তি ছিল, “খাজুরাহো মন্দির ASI দ্বারা সংরক্ষিত, তবুও সেখানে পূজা হয়।” সিব্বল বলেন, “নতুন আইন অনুযায়ী, ASI সংরক্ষিত হলে তা ওয়াকফ হতে পারে না।”
বিশ্লেষণ:
এখানে রাষ্ট্রীয় হেরিটেজ সংরক্ষণ বনাম ধর্মীয় স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ASI আইন ও ওয়াকফ আইন উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে যাতে ধর্মাচরণে প্রতিবন্ধকতা না ঘটে।
১৫. অতীতের ওয়াকফের তথ্য না থাকলে জেল—অন্যায্য বিধান
সিব্বল বলেন, ২০০ বছর আগের ওয়াকফের তথ্য প্রমাণ দিতে না পারলে মুতওয়াল্লিকে ছয় মাসের জেল দেওয়া হবে—এ বিধান অনৈতিক ও অবাস্তব।
বিশ্লেষণ:
এটি আইনের অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের ভয়ঙ্কর রূপ। অতীতের মৌখিক, ব্যবহারিক বা সামাজিক স্বীকৃত ওয়াকফের দলিল অনুপস্থিত থাকাটাই স্বাভাবিক। এই ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ধর্মীয় স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।
পরিশেষে বলা যায়, কপিল সিব্বলের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় স্বাধীনতা, ইতিহাসের স্বীকৃতি ও সংবিধানসম্মত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের ওয়াকফ সংশোধন আইনে একদিকে যেমন ধর্মীয় সম্পত্তির স্বচ্ছতা ও রেজিস্ট্রেশন জোরদার করা হয়েছে, অন্যদিকে এতে ঐতিহাসিক ওয়াকফের অস্তিত্ব, মুসলিম সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ধর্মাচরণের স্বাধীনতার উপর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে।
এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা হবে সংবিধানিক ভারসাম্য রক্ষা করা—যাতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও ধর্মীয় স্বাধীনতা উভয়ই রক্ষা পায়।