30/01/2025
|| গম্ভীরা লোকনৃত্যর ইতিবৃত্ত ||
|| মালদা জেলার গর্ব, বাংলা গর্ব, পশ্চিমবঙ্গ ||
গম্ভীরা বাংলার লোকসঙ্গীতের অন্যতম একটি ধারা। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। গম্ভীরা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি বর্ণনামূলক গান। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা অঞ্চলে গম্ভীরার মুখোশ পরে গম্ভীরা গানের তালে গম্ভীরা নৃত্য পরিবেশন করা হয়৷ বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়।
ধারণা করা হয় যে, গম্ভীরা উৎসবের প্রচলন হয়েছে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। শিবের এক নাম 'গম্ভীর', তাই শিবের উৎসব গম্ভীরা উৎসব এবং শিবের বন্দনাগীতিই হলো গম্ভীরা গান।
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির গাজন উৎসবই গম্ভীরা পূজা ও উৎসব নামে পরিচিত (উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে এটি গমীরা নামে খ্যাত)। চৈত্রের শেষ চারদিনে মূল অনুষ্ঠান হয়, তবে অঞ্চলভেদে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এমনকি শ্রাবণ মাসেও শিবমূর্তি স্থাপন করে গম্ভীরা পূজা হয়। বর্তমানে মূলত শিবপূজা নামে খ্যাত হলেও প্রাচীনকালে এটি সূর্যের উৎসব ছিল বলে মনে করা হয়।
মালদহে নিম্নবর্ণের হিন্দু, কোচ-রাজবংশী, পোলিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। গম্ভীরা উৎসব মালদহ জেলাতে প্রধানত চার দিনের উৎসব। প্রথমদিন 'ঘটভরা' অনুষ্ঠান; গম্ভীরা মণ্ডপে ঘট স্থাপন করে শিবপূজার উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে হয় 'ছোট তামাশা'; এই দিনে শিব ও পার্বতীর পুজো হয়, পুজোর অনুষ্ঠান রং, তামাশা, আনন্দ, রসিকতার মধ্যে কাটে এবং ঢাক-ঢোল বাদ্য সহযোগে মণ্ডপে নানা নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। তৃতীয় দিনে 'বড়ো তামাশা'র সন্ন্যাসীরা শুদ্ধচিত্তে শুদ্ধাচারে কাঁটা-ভাঙ্গা, ফুল-ভাঙ্গা ও বাণফোঁড়ায় অংশ নেয়। এদিন মালদহে বিভিন্ন সঙের দল ঘোরে; রাতে গম্ভীরা মণ্ডপে মুখোশনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। চামুণ্ডা, নরসিংহী, কালীর মুখোশ পড়ে ঢাকের তালে তালে নৃত্য হয়। মুখোশ পড়ে উদ্দাম নৃত্যের মধ্য দিয়ে গম্ভীরার বিশেষ রূপ প্রকাশ পায়। চতুর্থ দিনের উৎসবের নাম ‘আহারা’। এই দিন মণ্ডপে শিবের সঙ্গে নীলপূজাও হয়, সঙ্গে গম্ভীরা গান গাওয়া হয়ে থাকে। বিকালবেলায় সঙ বেরোয়। বিভিন্ন সাজে সেজে সঙ গ্রাম-শহর পরিক্রমা করে। এই সঙ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম রীতিতে গান গেয়ে অভিনয় করা হয়। এখানে সব রকম ভাবে নাটকীয় গুণ প্রকাশ পায়। এই রীতিটিই হল গম্ভীরা লোকনাট্য।
গম্ভীরা গানের শুরুতে দেবাদিদেব শিবকে বন্দনা করার রীতি আছে। শিবরূপী অভিনেতাকে মঞ্চে নিয়ে এসে তাঁকে সমস্ত বিষয়ে জানানো হয়। সমাজের মঙ্গলের জন্য কী করণীয় বা কোনও সমস্যা থাকলে কী ভাবে তার সমাধান করা যেতে পারে, তার প্রতিকারের নিদান দেন।
গম্ভীরা গান সাধারণত দুপ্রকার — আদ্যের গম্ভীরা এবং পালা-গম্ভীরা। প্রথমত, দেবদেবীকে সম্বোধন করে মানুষ তার সুখ-দুঃখ পরিবেশন করলে তাকে আদ্যের গম্ভীরা বলা হয়। দ্বিতীয়ত, পালা-গম্ভীরায় নানা-নাতির ভূমিকায় দুজন ব্যক্তির অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্যা তুলে ধরা হয়।
গম্ভীরা গানের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় হিন্দুসমাজে। গম্ভীরা নৃত্যটি উত্তরবঙ্গের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা জুড়ে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের সময় প্রদর্শিত হয়। মালদহের গম্ভীরার বিশেষত্ব হল মুখোশের ব্যবহার৷ স্থানীয় সূত্রধর সম্প্রদায় নিম এবং ডুমুর গাছের অংশবিশেষের সাহায্যে মুখোশগুলি তৈরি করে। কখনও কখনও মুখোশগুলি মাটি দিয়েও তৈরি করা হয়।গম্ভীরা গানের তালে এই মুখোশ পরেই নৃত্য পরিবেশন করা হয়। গম্ভীরা নৃত্যের মুখোশ হিসাবে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ ব্যবহৃত হয়। হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের বাণ, কালী, নরসিংহী, বাশুলী, গৃধিনীবিশাল, চামুণ্ডা, উগ্রচণ্ডা, ঝাঁটাকালী, মহিষমর্দিনী, লক্ষ্মী-সরস্বতী, হিরণ্যকশিপুবধ, তাড়কাবধ, শুম্ভনিশুম্ভ বধ ইত্যাদির মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এই মুখোশের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় নরসিংহী মুখোশ।
যে সমস্ত প্রথিতযশা শিল্পীদের হাত ধরে গম্ভীরা মালদহ জেলাতে স্বমহিমায় বিরাজমান তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলি হল ধনকৃষ্ণ অধিকারী, কৃষ্ণধনদাস গোস্বামী, মহম্মদ সুফি, গোপালচন্দ্র দাস, সতীশচন্দ্র গুপ্ত, গোলাম গুপ্ত, কিশোরীকান্ত চৌধুরী প্রমুখ। গম্ভীরা গানকে বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন পুরাতন মালদহের ইটখোলা গ্রামে জন্ম নেওয়া এবং ইংরেজবাজার শহরের কুতুবপুর বাবুপাড়া নিবাসী যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী যিনি গম্ভীরাসম্রাট নামে আখ্যায়িত হন । গম্ভীরায় কৌতুক সৃষ্টিকারী অভিনেতা ও গায়ক শিল্পী হিসেবে তার স্থান ছিল অদ্বিতীয়। তার ডাকনাম ছিল মটরা। এক সময় , মালদহ তো বটেই, অবিভক্ত দিনাজপুর তথা গোটা বাংলায় তার অভিনীত গম্ভীরা মটরার গান হিসেবেও পরিচিত ছিল।
তথ্য সূত্র - বিভিন্ন প্রতিবেদন
ছবি -সৌনক পাল