31/07/2025
কাটাদ্বীপ না কণ্টকদ্বীপ? ‘কাটোয়া’ নামের গোপন ইতিহাস
বর্ধমান জেলার অন্তর্গত বর্তমান কাটোয়া—যা আজ পরিচিত এক আধুনিক শহর হিসেবে, একসময় ছিল এক প্রাচীন জনপদ। তবে এর নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে বহুস্তর ইতিহাস, ভূগোল আর জনশ্রুতি মিশ্রিত কিংবদন্তি। অনেকের মতে, কাটোয়ার আদি নাম ছিল ইন্দ্রাণী—এক সময়ের মহানগর, যা আজ প্রায় বিস্মৃত।
📜 প্রাচীন ইন্দ্রাণী জনপদ: “ইন্দ্রাণী” শব্দটি শুধু একটি স্থাননাম নয়, এটি এক বৃহৎ ঐতিহাসিক পরিচয়ের ধারক। অজয় ও ভাগীরথীর মোহনায়, বর্তমান শাঁখাইঘাট থেকে দাঁইহাট পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল একসময় ইন্দ্রাণী জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। আজও কাটোয়া থানার বিশাল অংশ “ইন্দ্রাণী পরগনা” নামে চিহ্নিত। বিশ্বাস করা হয়, বেড়া গ্রামের পাশে, প্রাচীন ইন্দ্রেশ্বর মন্দির সংলগ্ন এলাকাতেই ছিল ইন্দ্রাণী নগরী—সম্ভবত এক মহানগরী। আইন-ই-আকবরীতে উল্লেখ আছে ‘ইন্দ্রায়ন’ বা ‘ইন্দ্রয়ীন’ নামে এক পরগনার, যা এই ইন্দ্রাণীর সাথেই সম্পর্কযুক্ত বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন।
🧝♂️ ইন্দ্রদ্যুম্ন ও কণ্টকনগর: জনশ্রুতি অনুযায়ী, ইন্দ্রাণীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন (যিনি ইন্দ্রেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন) গঙ্গাধর মহাদেবের কৃপা লাভের জন্য নিজের মাথা কেটে বলি দিতে চেয়েছিলেন। সেই থেকেই এই অঞ্চল পরিচিতি পেতে শুরু করে “কণ্টকনগর” নামে।
🌊 গঙ্গারিডি ও কাটোয়ার ঐতিহাসিক সংযোগ: - গঙ্গারিডি রাজ্য সম্পর্কে গ্রিক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিস, টলেমি, প্লিনি প্রমুখের বিবরণে দেখা যায়, এটি গঙ্গা নদীর মোহনা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এবং এর রাজধানী ছিল “গাঙ্গে” নামে একটি বন্দরনগরী। রাঢ় অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে কাটোয়া—এই অবস্থান সত্যিই গঙ্গারিডি সভ্যতার প্রবেশদ্বার হিসেবে ভাবা যেতে পারে। অজয় নদ দ্বারা বিভক্ত এই অঞ্চল উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ের সংযোগস্থল। কর্ণসুবর্ণ ও কান্দি মহকুমা—এই অঞ্চলে “গঙ্গারিডি” নামে ক্ষুদ্র স্থাননামের অস্তিত্ব আজও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
🌊 নদীবেষ্টিত দ্বীপ-ভূখণ্ড ও ‘কাটোয়া’ নামের বিবর্তন :
বহু ইতিহাসবিদ যেমন ড. কালীচরণ দাস মনে করেন, কাটোয়া ছিল একসময় নদীবেষ্টিত দ্বীপভূমি। গঙ্গা, অজয়, শিবা ও অন্যান্য উপনদীর শাখাপ্রশাখায় ঘেরা ছিল এই অঞ্চল।
🔹 প্রাচীন গ্রিক পর্যটকেরা একে "Katadupa / Katadipa / Kootdwipa" নামে উল্লেখ করেছেন।
🔹 ফরাসি পণ্ডিত সেন্ট মারটিন এবং ম্যাকক্রিন্ডল মনে করেন, ‘কাটোয়া’-র সংস্কৃত রূপ হতে পারে "কাটদ্বীপ" বা "কণ্টকদ্বীপ"—অর্থাৎ কণ্টকময় দ্বীপ।
এই অঞ্চল ঘিরে আজও রয়েছে:
🔹 অগ্রদ্বীপ ও কণ্টকদ্বীপ: “অগ্রে উৎপন্নং দ্বীপম” অর্থাৎ প্রথমে উৎপন্ন দ্বীপ—এই ব্যুৎপত্তি অগ্রদ্বীপকে ভাগীরথীর পলিসঞ্চয়ে গঠিত প্রাচীন ভূখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে। এডুমিশ্রের কারিকা অনুযায়ী “কণ্টকদ্বীপ” ছিল অগ্রদ্বীপের মধ্যাংশ। “কণ্টক” শব্দের অর্থ কাঁটা বা দুর্গম, যা কাটোয়ার নামের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য ঐতিহাসিক যোগসূত্র তৈরি করে।
🔹 নবদ্বীপ, পট্টদ্বীপ, পূর্বস্থলী: নবদ্বীপের নামকরণে “নব” অর্থ নতুন এবং “দ্বীপ” অর্থ দ্বীপ—এটি গঙ্গার পলিসঞ্চয়ে নবজাগরিত ভূখণ্ডের প্রতীক। ঐতিহাসিকভাবে এটি নয়টি দ্বীপের সমাহার হিসেবেও পরিচিত।
🔹 পট্টদ্বীপ (পাটুলি) এবং পূর্বস্থলীও ভাগীরথীর ধারাবাহিক ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে।
🔹 গঙ্গাটিকুরি ও টিকরা: “টিকরা” বা “টিকুরি” শব্দের উৎস সংস্কৃত “তুঙ্গ” থেকে, যার অর্থ উচ্চভূমি। গঙ্গাটিকুরি নামটি নদী বিধৌত কাঁদরের সঙ্গে যুক্ত, যা বাঁধজঙ্গল বা উঁচু চরভূমির ইঙ্গিত দেয়।
এইসব নাম ও ভূখণ্ডের ব্যুৎপত্তি শুধু ভাষাতাত্ত্বিক নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ভূগোলের মানচিত্রও আঁকে—যেখানে নদী, পলি, জনপদ ও ধর্মীয় ইতিহাস একে অপরকে ছুঁয়ে থাকে। এ থেকে স্পষ্ট যে, কাটোয়া সেই সময়কার এমনই একটি দ্বীপনগরী ছিল। “কণ্টকদ্বীপ > কাটদ্বীপ > কাটদিপা > কাটবা > কাটোয়া”—এই রূপান্তরের সম্ভাবনাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।
🗣️ ভাষা, লোকাচার ও উচ্চারণের পরিবর্তন: ভাষাবিদ সুকুমার সেন ‘কাটোয়া’ শব্দের ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ করে বলেন— “কর্ত + বয়ন = কাটোয়া” অর্থাৎ সুতাকাটা ও বস্ত্র বয়নের স্থান। অপরদিকে, নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ‘কণ্টক’ শব্দটি মুসলমান শাসনের সময় ‘কাট’ হয়ে যায় এবং হিন্দুস্থানী প্রভাবে তার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘ওয়া’/‘বা’। ফলে, ‘কাটোয়া’ উচ্চারণই প্রাধান্য পায়।
🔍 ঐতিহাসিক দলিল ও সাহিত্যপ্রমাণ
1. 📖 গৌড়াধিপতি হুসেন শাহের সমসাময়িককালে রচিত বিপ্রদাসের মনসাবিজয়ে (ইং ১৪৯৫) কিন্তু পরিষ্কার কাটোয়া শব্দ আছে : ‘উজানি কাটোয়া বাহি রহে ইন্দ্রঘাটে।'
2. 📖 মনোহর দাসের ‘অনুরাগবল্লীতেও (ইং ১৬৯৬) কাটোয়া নাম— ‘কাটোয়া নিকট বাগ্যনকোলা পাটবাড়ী।
এই সবই প্রমাণ করে যে, ১৫শ-১৬শ শতকেও “কাটোয়া” নামের অস্তিত্ব ছিল এবং তা জনজীবনে স্বীকৃত ছিল। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়...আজও নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না, ঠিক কোন সময় থেকে ‘কাটোয়া’ নামটি বর্তমান রূপে প্রতিষ্ঠিত হল। তবে এ এক চমকপ্রদ বিষয়—একটি নামের পেছনে এত ভূগোল, ইতিহাস, কিংবদন্তি, ভাষাবিজ্ঞান আর সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ছাপ যা সত্যই অবাক করে দেয়!আজকের কাটোয়া শুধুই একটি শহর নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, ভাষা ও নদীবিধৌত সভ্যতার জীবন্ত সাক্ষী।
Manas Bangla
#কাটোয়া #ইন্দ্রাণী #কণ্টকনগর #বাংলারইতিহাস #মানসবাংলা #নদীসভ্যতা