17/10/2025
জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট: এক নীরব মৃত্যুর গল্প!
লন্ডনের এক শীতল ডিসেম্বরের রাত। জানলার বাইরে ঝরছে কুয়াশা, দূরের আলো গিলে খাচ্ছে শহরের নির্জনতা। আর ঠিক সেই সময়েই, এক অচেনা, অদেখা ঘরে নিঃশব্দে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন এক নারী — নাম তাঁর জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট।
কেউ জানল না, কেউ শুনল না। কেবল ঘরের কোণে টিভির আলো মৃদু কাঁপছিল — যেন জীবনের শেষ আলোটা টিমটিম করে জ্বলছিল তাঁর সঙ্গে।
১৯৬৫ সালের ১৯ অক্টোবর, লন্ডনের হ্যামারস্মিথে জন্মেছিল ছোট্ট মেয়ে জয়েস। বাবা ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কাঠমিস্ত্রি, মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত — গ্রেনাডা থেকে এসে গড়ে তুলেছিলেন সংসার। কিন্তু সুখ বেশিদিন টিকল না।
১১ বছর বয়সে মা মারা গেলেন, আর ছোট্ট জয়েসের পৃথিবীটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। চার দিদি মিলে তাঁকে মানুষ করলেও, বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল দূরের — যেন সবসময় কিছু একটা অপূর্ণ থেকে যেত।
জয়েস বড় হতে থাকলেন নিজের মতো। হাসিখুশি, ভদ্র, একটু রহস্যময় — এমনটাই বলতেন সবাই। স্কুলে পড়া শেষ না করেই চাকরির দুনিয়ায় ঢুকে পড়েন তিনি।এক সময় কাজ করতেন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান Ernst & Young-এর ট্রেজারি বিভাগে। ১৯৯০ সালে ওয়েম্বলির মঞ্চে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে করমর্দনের মুহূর্ত — তাঁর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরকাল।
কিন্তু সেই আলো যেন ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করেছিল।
২০০১ সালে হঠাৎ করেই জয়েস চাকরি ছেড়ে দেন। কেউ জানল না কেন। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ, পরিবারের সঙ্গে কথা নয়— তিনি যেন ইচ্ছে করেই নিজেকে পৃথিবী থেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন।
একদিন জানা গেল, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গৃহ-নির্যাতনের শিকার নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে। কে তাঁকে আঘাত করেছিল? কী ভয় তাঁকে গ্রাস করেছিল? — উত্তর আজও অজানা।
তিনি কাজ শুরু করেন এক সস্তা হোটেলে ক্লিনার হিসেবে। এক সময়কার অফিসের মার্জিত পোশাক এখন জায়গা নিচ্ছিল ময়লা মুছার কাপড়ে। কেউ ভাবতে পারেনি, এক সময় যে মেয়ে রাজকীয় আত্মবিশ্বাসে চলত, সে একদিন এমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, জয়েসকে উড গ্রিনের এক সরকারি ফ্ল্যাটে রাখা হয়। সেই ছোট্ট ঘরটিই হয়ে ওঠে তাঁর শেষ ঠিকানা। ডিসেম্বর মাসে তিনি সম্ভবত মারা যান — হাঁপানির আক্রমণ বা পাকস্থলীর আলসারের জটিলতায়।
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
ঘটনার মর্মান্তিক দিকটি হলো —দুই বছর ধরে কেউ তাঁর খোঁজ নেয়নি।তাঁর ফ্ল্যাটের দরজাটা ছিল ভেতর থেকে বন্ধ, ভাড়ার টাকা সরকারি ভাতার মাধ্যমে অটো-পে হচ্ছিল। প্রতিবেশীরা ভাবত, হয়তো ফ্ল্যাটটা খালি।
২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি, যখন বাড়িওয়ালা ভাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙে, তখন ঘরের ভেতর মেঝেতে শুয়ে ছিলেন জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট, একটা শপিং ব্যাগ পাশে, আর চারপাশে সুন্দর করে মোড়ানো ক্রিসমাস উপহার। টিভি তখনও চলছিল। হিটারটাও জ্বলছিল। কিন্তু ঘরটা ছিল ঠান্ডা। ভীষণ ঠান্ডা।
কোনো চিহ্ন ছিল না খুনের, ছিল না আত্মহত্যার নোট। মৃতদেহ এতটাই পচে গিয়েছিল যে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়েছিল দাঁতের রেকর্ড দেখে। তাঁর পরিবার জানত না, তিনি অনেক আগেই চলে গেছেন। তারা ভেবেছিল — জয়েস হয়তো দূরে কোথাও নতুন জীবন শুরু করেছে। কিন্তু সেই জীবনটা থেমে ছিল এক ফ্ল্যাটের নিঃশব্দ দেয়ালের ভেতরে।
২০১১ সালে তৈরি হয় ডকুড্রামা Dreams of a Life, যেখানে তাঁর জীবনের অজানা টুকরোগুলো তুলে ধরা হয়। আর সংগীতশিল্পী স্টিভেন উইলসন তাঁর অ্যালবাম Hand. Cannot. Erase. উৎসর্গ করেন এই নিঃসঙ্গ আত্মার স্মৃতিতে।
জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট হয়তো আজ নেই, কিন্তু তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় — আধুনিক শহরের ভিড়েও মানুষের নিঃসঙ্গতা কত ভয়ংকর হতে পারে। কখনও কখনও, কারও হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকে এক অনন্ত নীরবতা, যা কেউ শোনে না, কেউ বোঝে না।
©Manas Bangla
#জয়েসভিনসেন্ট #নিঃসঙ্গতা #বাস্তব_কাহিনী #মৃত্যুর_রহস্য #নিঃশব্দ_মৃত্যু #অজানা_গল্প #জীবনের_বেদনা #একাকীত্ব #হৃদয়স্পর্শী_গল্প #জীবন_ও_মৃত্যু #আধুনিক_বেদনা #হারিয়ে_যাওয়া_আত্মা #মানবজীবনের_নিঃসঙ্গতা #দুঃখের_বাস্তবতা #ভুলে_যাওয়া_মানুষ