19/06/2025
বাংলা সাহিত্যে নক্ষত্রপতন
সিদ্ধার্থ সিংহ Siddhartha Singha
২০১২ সালে নীরেনদা, মানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আর আমি ছোটদের একটি সংকলন, 'ছোটদের সেরা ৫১'-র যুগ্ম সম্পাদনার কাজ করছি, কার কার লেখা রাখব তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। মোটামুটি সবারই পারমিশন পেয়ে গেছি। কিন্তু প্রফুল্ল রায়েরটা!
তাঁর 'শশীকান্ত দারোগা ও ফকিরা' গল্পটা তো নিয়ে নিয়েছি, কিন্তু অনুমতি না পেলে ছাপি কী করে! ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও প্রফুল্লদাকে আমি চিনতাম। আমি যখন স্কুলের গণ্ডি সবেমাত্র ছেড়েছি, তখন যুগান্তর পত্রিকার বাগবাজারের অফিসে আমি প্রায়ই যাই। অমিতাভ চৌধুরীর হাতে লেখা দিয়ে আসতাম। ছোটদের পাতার জন্য গল্প দিতাম কৃষ্ণ ধরের হাতে। সেই কৃষ্ণ ধরই একদিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন প্রফুল্ল রায়ের সঙ্গে। তখনই জেনেছিলাম উনি বিনোদন বিভাগের সম্পাদক। আমি বিনোদন নিয়ে কখনও কিছু লিখিনি, তবু তারপর থেকে যখনই যুগান্তরে যেতাম, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, কমল চৌধুরী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রফুল্ল রায়ের সঙ্গেও এক ঝলক দেখা করে আসতাম।
সেই ভরসাতেই একদিন তাঁর আজাদগড়ের রিজেন্ট পার্কের 'হেমন্ত অ্যাপার্টমেন্ট'-এর থ্রি-ডি ফ্ল্যাট গিয়ে হাজির।
তখন ভরদুপুর। দরজা খুললেন প্রফুল্লদা। এর আগে যত বারই তাঁকে দেখেছি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। পায়ে চপ্পল। এই প্রথম দেখলাম লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা। দেখেই চিনতে পারলেন।
ঘরে ঢুকে দেখি শুধু বই আর বই। যখন বললাম, আমি আর নীরেনদা একটা সংকলন সম্পাদনা করছি। আপনার একটি লেখা রাখতে চাই। আপনার পারমিশন দরকার। আমি সব লিখে নিয়ে এসেছি। আপনি শুধু সই করলেই হবে।
প্রফুল্লদা কাগজটা হাতে নিয়ে শুধু সইই করলেন না, তাতে লিখে দিলেন, শুধু এই সংকলনেই নয়, তুমি যতগুলো সংকলন সম্পাদনা করবে আমার যে কোনও লেখা রাখতে পারো।
তারপর নানান কথা। রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক উনি তা জানতেন। খবর নিলেন রমাপদ বাবুর সম্পর্কেও। দেখতে দেখতে তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। বাসবী বৌদি বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে তো! দুটো খেয়ে যান। প্রফুল্লদাও সায় দিলেন। ফলে ডাল ভাত তরকারি আর দু'রকমের মাছ। বৌদির কাছেই শুনলাম, প্রফুল্লদা ডিম, মুরগি, মাংস খান না। তবে মাছের খুব ভক্ত। নিজের হাতেই বাজার করে নিয়ে আসেন।
প্রফুল্লদার বয়স যে খুব বেশি হয়েছিল তা কিন্তু নয়। ৯১-ও ছোঁননি। এর চেয়েও বেশি বয়সে রমাপদবাবু আমার সঙ্গে পড়ার দোকানে চা খেতে যেতেন। তবে প্রফুল্লদা দীর্ঘ দিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত কয়েক মাস ধরে তাঁর চিকিৎসা চলছিল দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে।
প্রফুল্লদা লিখতে শুরু করেছিলেন খুব অল্প বয়সে। সেই পাঁচের দশক থেকেই তাঁর গল্প বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে। শুরু করে। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ে 'দেশ' পত্রিকায় তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস পূর্ব-পার্বতী বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল।
তাঁর লেখায় ধরা পড়ত মধ্যবিত্ত বাঙালি আর ভারতের নানা জায়গার মাটির গন্ধ। বিহারের জনজীবনকে ভিত্তি করে ১৩টি উপন্যাস-সহ প্রায় দেড়শোরও বেশি বই লিখেছেন তিনি। তাঁর 'কেয়া পাতার নৌকো', 'শতধারায় বয়ে যায়', 'উত্তাল সময়ের ইতিকথা', 'নোনা জল মিঠে মাটি', 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান', 'পিতৃভূমি', 'আঁধারে ধূপের গন্ধ', 'জলের রেখা', 'শতবর্ষের যুদ্ধ', 'অদ্বিতীয়া', 'রণসজ্জা', 'রথযাত্রা' পাঠকদের মনে এখনও গেঁথে আছে।
তাঁর গল্প ও উপন্যাস অবলম্বন করে বহু টেলিফিল্ম, টেলি-ধারাবাহিক, সিনেমা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে 'এখানে পিঞ্জর' (১৯৭১), 'বাঘবন্দি খেলা' (১৯৭৫), 'মোহনার দিকে' (১৯৮৪), 'আদমি আউর আউরত' (১৯৮৪), 'একান্ত আপন'(১৯৮৭), 'চরাচর'(১৯৯৪), 'টার্গেট' (১৯৯৭), 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' (২০০৩), 'ক্রান্তিকাল' (২০০৫) ইত্যাদি। তাঁর ‘কেয়া পাতার নৌকো’র কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত বাংলা ধারাবাহিকটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।
এই লেখালেখির জন্যই বহু পুরস্কার পেয়েছেন এই লেখক। 'আকাশের নেই মানুষ' উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার, পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড-এর 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট' পুরস্কার। 'ক্রান্তিকাল' উপন্যাসের জন্য ২০০৩ সালে পেয়েছেন সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার। এ ছাড়াও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড়সড় পুরস্কার।
১৯৩৪ সালে ১১ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার বিক্রমপুরের আটপাড়ায় প্রফুল্ল রায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বেড়ে ওঠাও সেখানে। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে চলে তিনি চলে আসেন ভারতে। তার পর থেকে কলকাতাতেই থাকতেন। দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তুদের কথা তাঁর লেখনিতে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে একের পর এক বইতে সেই যন্ত্রণার ছবি এঁকেছেন তিনি। বেশ কিছু দিন ছিলেন নাগাল্যান্ডে। ছিলেন মধ্যপ্রদেশ, আন্দামান, বিহারেও। আর যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একেবারে নিবিড় ভাবে মিশে গেছেন। তাঁদের সুখ দুঃখ যন্ত্রণা তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়।
প্রফুল্লদা নিজেই বলতেন, আমার চাকরিবাকরি করতে ভাল লাগে না। আমি লিখে যে রয়্যালটি পাই। আর আমার উপন্যাস থেকে গড়ে বছরে যে দুটো সিনেমা, টিভি সিরিয়াল হয়, ওতেই আমার চলে যায়।'
আসলে প্রফুল্লদা পার্থিব জগৎ নিয়ে অনেকটাই উদাসীন ছিলেন।
মহানায়ক উত্তমকুমারের 'এখানে পিঞ্জর' সিনেমাটি প্রফুল্লদার উপন্যাস থেকেই তৈরি। লেখকের কাছ থেকে একদিন কাহিনি স্বত্ব কিনতে এলেন প্রযোজক দিলীপ মুখোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, তিনি ১০ হাজার টাকা দেবেন আর অগ্রিম বাবদ তার অর্ধেক।
কিন্তু প্রফুল্ল রায় বললেন, 'আপনার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, আপনি এখন টাকা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।' দিলীপ মুখোপাধ্যায় তখন জানালেন, 'ঠিকই ধরেছেন আপনি, এর আগের দুটো ছবি ফ্লপ হয়েছে।' তখন দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে প্রফুল্লদা বলে দিলেন, 'তা হলে আপনাকে এখন একটা পয়সাও দিতে হবে না। আগে ছবিটা হোক।'
ছবিটা সুপারডুপার হিট হয়েছিল। ওটাই তাঁর উপন্যাস থেকে তৈরি প্রথম ছবি।
তাঁর 'প্রথম তারার আলো' উপন্যাস থেকেই তৈরি হয়েছিল উত্তমকুমারের 'বাঘবন্দি খেলা' ছায়াছবিটি। সেই ছবির কাহিনি স্বত্ব কিনতে কত টাকা তিনি নেবেন, খোদ মহানায়কের মুখে এই প্রশ্ন শুনে প্রফুল্ল রায় বলেছিলেন, 'আমি কিছু বলব না। আপনি যেটা ঠিক বলে মনে করবেন, সেটাই দেবেন।'
শুধু গল্প-উপন্যাস লেখাই নয়, 'যুগান্তর' পত্রিকায় তাঁর নেওয়া সত্যজিৎ রায়ের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সে সময় ব্যাপক আলোড়ন ফেলে গিয়েছিল।
প্রফুল্লদার 'চরিত্র' নামের থ্রিলারটি বেরোনোর পর প্রেমেন্দ্র মিত্র একদিন তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, এই 'চরিত্র' নামের থ্রিলারটির লেখক যে প্রফুল্ল রায়, সে কি তুমি?
প্রফুল্লদা হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।
প্রফুল্লদার 'রামচরিত' উপন্যাসটি বের হওয়ার পর চারিদিকে যখন হইহই কাণ্ড, সবার মুখে প্রশংসার ঝড় বইছে, তখন প্রফুল্লদা অপেক্ষা করছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ফোনের।
অবশেষে সেই ফোন এল। প্রেমেন্দ্র মিত্র জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, 'রামচরিত্র'র লেখক যে প্রফুল্ল রায়, সে কি তুমি?
এ বারও প্রফুল্লদা হ্যাঁ বলায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, যে 'রামচরিত্র' লেখে, সে কেন 'চরিত্র'র মতো থ্রিলার লিখবে?
তার উত্তরে প্রফুল্লদা বলেছিলেন, যিনি 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার'-এর মতো গল্প লেখেন, তিনি কেন ঘনাদা, পরাশর বর্মা লেখেন?
তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র খুব হেসে বলেছিলেন, ঠিকই বলেছ, লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়।
১৯৯২ সালে সংবাদ প্রতিদিন-এর সাহিত্য বিভাগের প্রথম সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি।
তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্কটজনক হয়ে উঠজিল। তাই তাঁকে দক্ষিণ কলিকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই হাসপাতালেই বৃহস্পতিবার বেলা ৩টে ১৫ মিনিট নাগাদ বাংলা সাহিত্যের ইন্দ্রপদন ঘটে। ৯১ বছর পূর্ণ হওয়ার মাস তিনেক আগেই কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন।