02/08/2025
ভারতীয় রেল সরকারের সহযোগিতা ছাড়াই প্রথম ব্যক্তিগত উদ্যোগ্যে যে ব্যক্তি প্রথম রেললাইন পাতার কাজ করতে চেয়েছিলেন তিনি হলেন প্রিন্স দ্বারকা নাথ ঠাকুর
১৮৪২ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতা- হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেল চালাবার পরিকল্পনা করেন,কোম্পানির নাম গ্রেট ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে,কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে সেই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়
পরে এলো ভারতবর্ষের অন্যতম খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির নাম মার্টিন এন্ড কোম্পানী, এই বৃহত্তর পাইকপাড়া বাসী রা যেটা জানতেন সেটা মার্টিন এন্ড কোম্পানী লিমিটেড,কিন্তু অনেকেই জানতেন না এর রূপকার ছিলেন বাঙালি শিল্পদ্যোগী স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি।এই বৃহত্তর পাইকপাড়ার সাথে রাজেন মুখার্জীর সম্পর্ক ছিল গভীর।
পাইকপাড়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সেভেন ট্যাংকস এর জমি হস্তান্তরিত হয়ে যায় এই মুখার্জি পরিবারের হাতে,স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি র ভাইপো ডা: মতিলাল মুখার্জি কেনেন ওই সম্পত্তি।যাইহোক একমাত্র নেটিভ হওয়ার কারণে তাঁর নাম বাদ যায়,মার্টিন কোম্পানি প্রতিষ্টিত হয় ১৮৯২ সালে
কলকাতার যে রাস্তাটির নাম ছিল মিশন রোড, বর্তমানে তা আমাদের কাছে আর.এন.মুখার্জি রোড নামে পরিচিত। ডালহৌসি অঞ্চলের এই রাস্তাটা প্রায় সারাবছরই মুখর থাকে মানুষের ব্যস্ততায়, অথচ পথচলতি বেশিরভাগ মানুষই খোঁজ রাখেন না কে এই আর.এন. মুখার্জী? জিজ্ঞাসা করলে কেউ কেউ যেমন কিছুই বলতে পারেন না, আবার কেউ কেউ তেমন জানান, "উনি খুব নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন।" ব্যাস ওইটুকুই। বিদেশী অনেক ব্যবসায়ী যাকে নিজের আইডল মনে করেন, সেই মহান বাঙালি স্থপতি-ব্যবসায়ী স্যার রাজেন মুখার্জী সম্পর্কে এর বেশি আর কিছুই বলতে পারেন না
এ বোধহয় একমাত্র আত্মমগ্ন, আত্মবিস্মৃত বাঙালির পক্ষেই সম্ভব। বাঙালি ব্যবসা করে না - এ যেমন বাঙালির এক বদনাম; তেমনি স্যার রাজেন মুখার্জী সম্পর্কিত এই বিস্মৃতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কোনো বঙ্গসন্তান ব্যবসা করে সফল হলেও তাঁকে মনে রাখার কোনওরকম চেষ্টা নেই এই জাতির। তাই ক্রমশই বিস্তৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন এক কালের খ্যাতনামা এই বঙ্গতনয়
অতীতের পাতা উল্টে খানিক পিছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখব, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বুকে রমরমিয়ে চলছে ব্রিটিশ জমানা। এমন সময়েই একদিন কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ব্রাডফোর্ড লেসসি সাহেব এক চূড়ান্ত ফাঁপড়ে পড়লে একরকম তাঁর রক্ষাকর্তা হিসাবেই আবির্ভাব ঘটে রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জীর। ভাষাগত সমস্যার জেরে মিস্ত্রিদের কাজ বোঝাতে লেসসি সাহেব যখন বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন রাজেন্দ্রনাথই তাঁর কাছ থেকে সব বুঝে নিয়ে দেশীয় মিস্ত্রিদের তা বুঝিয়ে দেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন লেসসি। রাজেন্দ্রনাথের দিকে ছুঁড়ে দেন নতুন চ্যালেঞ্জ। কপর্দকশূন্য, অভিজ্ঞতাহীন যুবক রাজেনও সেদিন শুধুমাত্র মনের জোরেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। আর এই ঘটনাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের টার্নিং-পয়েন্ট
১৮৫৪ সালের ২৩ জুন বসিরহাটের ভ্যাবলা গ্রামে রাজেন্দ্রনাথের জন্ম। মাত্র ছ'বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা মায়ের কাছেই। নানা বিপর্যয়, অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে শৈশব কাটলেও, নিজের মেধার জোরেই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। আসলে সে সময় শিবপুর বসিরহাটের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্লাস প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাসে চলত। দীর্ঘ তিন বছর পড়াশোনা করার পরও হঠাৎই স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে পরীক্ষায় বসা হয়নি তাঁর। তাই সেইসময় থেকেই গতানুগতিক চাকুরি-জীবনের স্বপ্ন না দেখে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার। এরপরই একদিন লেসসি সাহেবের সঙ্গে আলাপ এবং তারপরই পলতার জল প্রকল্পের হাত ধরে তাঁর ব্যবসায়ী জীবনে অভিষেক। এরপর একে একে তিনি লখনউ, এলাহাবাদ, আগ্রা, কানপুর জলপ্রকল্প তৈরি করেন এবং এই বঙ্গসন্তানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশময়। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও শুধুমাত্র ‘নেটিভ’ হওয়ার দরুন তাঁকে বারবার হতে হয়েছে অবিচারের শিকার৷ ফলে এরপর যখনই স্যার টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ব্যবসা করার প্রস্তাব তাঁর কাছে আসে তখনই তিনি তা লুফে নেন৷ এরপর ১৮৯২ সালে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি গড়ে উঠলে তাঁর ব্যবসার পরিধিও বেড়ে যায়। এদিকে ১৯০৬ সালে মার্টিন সাহেব মারা গেলে রাজেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ওই সংস্থার সিনিয়র পার্টনার। এই মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি একে একে কলকাতাসহ ভারতের নানা শহরে গড়ে তোলে নানা স্থাপত্য৷ এমনকি কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ, বেলুড়মঠ ও মন্দির, টিপু সুলতান মসজিদ, বিধানসভা ভবন ইত্যাদির নির্মাণেও রয়ে গিয়েছে স্যার রাজেনের সংস্থার অবদান। এদিক থেকে দেখলে কার্যত কলকাতার রূপকার বলা যায় তাঁকে
সেই সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতে রেলপথ চালু করে দেশের বড় বড় শহরকে যুক্ত করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু সে যুগে বসেও রাজেন অনুভব করেছিলেন যে শুধু বড়ো বড়ো শহর নয়, দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে শহরের সঙ্গে আশেপাশের গাঁ-গঞ্জকেও রেলপথে যুক্ত করতে হবে৷ তাই মূলত বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবেই তিনি ‘মার্টিন লাইট রেলওয়ে’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন৷ যা পরিচিত ছিল ‘ন্যারোগেজ রেল’ বা ‘ছোটো রেল’ নামেই৷ গোটা দেশেজুড়েই এরকম বেশ কয়েকটি ছোট বেসরকারি রেল ব্যবস্থা চালু করে তিনি সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দিতে শুরু করেন৷ সেগুলির মধ্যে হাওড়া-আমতা, বারাসত-বসিরহাট, বক্তিয়ারপুর- বিহার,আরা-সাসারাম, দিল্লি- সাহারানপুর ইত্যাদিও রয়েছে। অন্যদিকে পূর্ত বিভাগের বিভিন্ন বরাত পাওয়া কাজ করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন লৌহ ইস্পাত কারখানার প্রয়োজন সেইসময় ভারতে ঠিক কতটা! তাই তিনি ও তাঁর মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি ১৯১৮ সালে গড়ে তোলেন ইস্কো, যার বার্ণপুরের কারখানাটিই দেশের দ্বিতীয় ইস্পাত কারখানার মর্যাদা পায়
এর আগে ১৯০৭ সালে জামশেদপুরে দেশের প্রথম ইস্পাত কারখানাটি গড়ে ছিলেন টাটা গোষ্ঠী। আজও এই দু’টি কারখানাই ভারতের অন্যতম ইস্পাত উৎপাদনের উৎস। ১৯৩৬ সালে রাজেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলেও তাঁর ছেলেরা, বিশেষত স্যার বীরেন মুখার্জির হাত ধরে সম্প্রসারণ হওয়ায় ইস্কোর রমরমা অবস্থা দেখা গিয়েছিল। ফলে ছয়ের দশকের শেষদিকেও বাঙালি নিয়ন্ত্রিত এই শিল্পগোষ্ঠী সম্পত্তির পরিমাণে সারা দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করেছিল। কিন্তু তারপর দ্রুত এই গোষ্ঠী তার পূর্ব গৌরব হারায় ৷ হাত বদল হয়ে যায় এই গোষ্ঠীর হাতে থাকা একের পর এক সংস্থাগুলি এবং এই মুখার্জী গোষ্ঠীর পতন ঘটতে থাকে
শিল্প-বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজেন্দ্রনাথের খেলাধূলার প্রতিও ছিল এক অমোঘ আকর্ষণ৷ এমনকি তিনি বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাব, মোহনবাগান ক্লাবের মতো সংগঠনের সভাপতির আসনও অলংকৃত করেছেন৷ ব্রিটিশ আমলেও তিনি বহু বিদেশী কমিটির সদস্য ছিলেন৷ কিন্তু এত কিছুর মাঝেও তাঁর কাছে ব্যবসাই সর্বক্ষণ অগ্রাধিকার পেয়েছে৷ তাই বারবার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তিনি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ ১৯১০ সালে এডওয়ার্ড বেকার তাঁকে কৃষি ও শিল্প দফতর দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি৷ একইরকম ভাবে আরও বছর দশেক বাদে চেমর্সফোর্ডের মন্ত্রীসভার শিল্প দফতরের দায়িত্ব নিতে বলায় তিনি সেই প্রস্তাবও এড়িয়ে গিয়েছিলেন৷ এই বিখ্যাত বাঙালি তাঁর জীবৎকালে নানান পুরস্কার, উপাধি দ্বারাও সম্মানিত হয়েছেন। এমনকি তাঁর ঝুলিতে রয়েছে নাইট উপাধিও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডি.এসসি উপাধিও প্রদান করা হয়েছে। কলকাতার কারিগর এই মানুষটিকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তাঁর একটি মূর্তিও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রাঙ্গনে স্থাপিত রয়েছে। কিন্তু খুব দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, বাঙালি সমাজ এই বিশ্বখ্যাত বঙ্গসন্তানকে মনে রাখেনি
আসলে ব্য/বসা বিষয়টিকে একেবারে প্রথম থেকেই বাঙালিরা 'নট আওয়ার কাপ অফ টি' বলে দাগিয়ে দিয়েছে। তাই তো স্বাধীনতার এত বছর পরেও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাঙালি আজও মোটের ওপর কোণঠাসা৷ স্যার রাজেনের মতো মানুষকে বাঙালি তার আইডল তালিকায় রাখে না, সে দুর্ভাগ্য বাঙালিরই
উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় রেলপথ প্রতিষ্ঠা এবং রেল-চলাচলের সূচনা সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ আলোড়ন তুলেছিল। ১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট, প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইলের রেললাইন ব্যবহৃত হয়। এর পর প্রথমে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া, পরে ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন চালু হয়। প্রথমে পণ্য পরিবহণের জন্য চালু হলেও অচিরেই আরও বহু রেললাইন বসে এবং মানুষের যাতায়াতের অঙ্গ হয়ে ওঠে রেলগাড়ি। ‘সম্বাদ প্রভাকর’ কাগজে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘শারদ্বর্ণন’ কবিতায় লিখলেন— ‘টাকা ছেড়ে থাবড়ায়/ পার হয়ে হাবড়ায়/ চালিয়েছে রেলওয়ে পথে। হুগলির যাত্রী যত/ যাত্রা করি জ্ঞান হত/ কলে চলে স্থলে জলে সুখ। বাড়ী নহে বড়ো দূর/ অবিলম্বে পায় পুর/ হয় দূর সমুদয় দুখ’। ১৮৮৪ সালে দুর্গাচরণ রায়ের লেখা ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ বইয়ে দেবতা বরুণ, ব্রহ্মাকে ভারতে রেলপত্তনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেছেন— ‘যে দিন প্রথমে চলে অনেকে সাহস করিয়া উঠে নাই। তৎপরদিন আরোহীর সংখ্যা দেখে কে?’। দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকামিনী দাসী, রূপচাঁদ পক্ষী থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু লেখকের লেখায় এই নতুন আশ্চর্য যানের উল্লেখ ছিল। তা থেকে জনজীবনে এই দ্রুতগতির ট্রেনগাড়ির ভূমিকা ও অভিঘাত কী বিপুল ছিল, আন্দাজ করা যায়
স্ট্যান্ডার্ড গেজ বা ব্রড গেজ রেললাইন ছাড়াও অজস্র ছোট আকারের মিটার গেজ ও ন্যারো গেজ রেললাইন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। বাংলায় ছোট রেললাইনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল ‘ম্যাকলিয়ড রাসেল অ্যান্ড কোম্পানি’ এবং ‘মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি’। স্বল্প ব্যয়ে, স্বল্প মূলধনে, কম পুঁজি ও গ্যারান্টি মানির সাহায্যে এই ফিডার লাইনগুলো বসানো সম্ভব ছিল বলে ১৮৯০ থেকে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা পর্যন্ত এই প্রাইভেট কোম্পানির অজস্র ছোট রেলগাড়ির স্বর্ণযুগ হয়ে ওঠে ভারতবর্ষ। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মার্টিন রেল’। হাওড়া, হুগলির গ্রামাঞ্চলের বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে তো বটেই, পরবর্তী কালে বারাসত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে চালু করে তিনটি জেলার মানুষের কাছে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই লাইট রেলওয়ে। আজও হয়তো হাওড়া, হুগলি, বারাসত, বসিরহাটের জায়গায় জায়গায় এই ন্যারো গেজ রেললাইনের অবশিষ্টাংশ কোথাও কোথাও রয়ে গিয়েছে, তার উপরে উঠেছে দোকানপাট, তৈরি হয়েছে বাস রুট। কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে আজও অমলিন এই ট্রেন। বিশেষত যাদের জন্ম পঞ্চাশের দশকে, তারা ছেলেবেলার স্মৃতি হিসেবে আজও রোমন্থন করেন এই ট্রেনে চড়ার কাহিনি। ষাটের দশকের শেষ অবধি মার্টিন রেল চলেছিল। সত্তর দশকের গোড়ায় পৌঁছে আস্তে আস্তে উঠে যায় এই লাইট ট্রেন। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫০-৫১ সালে চালু লাইট রেলওয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হাওড়া-আমতা, হাওড়া-শিয়াখালা এবং বারাসত-বসিরহাট লাইনের মার্টিন রেলওয়ের বিবরণ। অথচ আজ তা ধূসর ইতিহাস, বিস্মৃতির আবরণে ঢাকা।
ব্রিটিশ-বাঙালি যৌথ মালিকানায় গড়ে উঠেছিল মার্টিন লাইট রেলওয়ে। ইংরেজ ব্যবসায়ী টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই রেল-পরিষেবা গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি উদ্যোগপতি স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।ব্রিটিশ ভারতে, ইউরোপীয় পার্টনারদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ছেড়ে টমাস মার্টিন যে ভাবে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন এক জন বাঙালি ভাগ্যান্বেষী শিল্পপতির সঙ্গে, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ
সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় এই কঠোর পরিশ্রমী ও সৎ বাঙালি এক জন শীর্ষস্থানীয় সফল ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র বীরেন মুখোপাধ্যায় বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন এবং ১৯৪৬ সালে যখন ‘মার্টিন অ্যান্ড বার্ন’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। বীরেন মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ স্নেহভাজন। বীরেন মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ১৯৪৫ সালে মার্টিন কোম্পানির ট্রেনের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন চালু হয়। হাওড়া-আমতা, হাওড়া-শিয়াখালা, বারাসত-বসিরহাট— সব ক’টি শাখারই ডিরেক্টর ছিলেন স্যর বীরেন মুখোপাধ্যায়। তুখোড় ব্যবসায়িক বুদ্ধির অধিকারী রাজেন্দ্রনাথ টের পেয়েছিলেন যে, হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনার বিস্তৃত অঞ্চলের প্রচুর মানুষজন কাজের সূত্রে কলকাতা যাতায়াত করেন, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনও সস্তা সুগম যাতায়াত-ব্যবস্থা নেই। সেই অভাব দূর করতেই হাওড়া-আমতা লাইট রেলওয়েজ় (এইচ এ এল আর) এবং হাওড়া-শিয়াখালা লাইট রেলওয়েজ় (এইচ এস এল আর) গড়ে ওঠে। এর পর এই দুই প্রধান রেলপথের আরও শাখাপথ বেরিয়েছিল। মার্টিন রেলের অপর গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল বারাসত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে (বি বি এল আর)। চব্বিশ পরগনা জেলার এই বর্ধিষ্ণু জনপদকে রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত করার এই প্রয়াস ছিল ঐতিহাসিক। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫, বারাসত থেকে বসিরহাট, ২৬ মাইল দীর্ঘ এই রেলপথের সূচনা হয়। এর পর টাকি এবং ইছামতী-তীরবর্তী হাসনাবাদ পর্যন্ত দু’টি এক্সটেনশন লাইন খোলা হয়েছিল। যাত্রীর সংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধির কারণে ১৯০৮ সালে এই লাইনেই শ্যামবাজার শাখা খোলা হয়। গোটা উত্তর এবং পূর্ব কলকাতাকে ছুঁয়ে চলত এই মার্টিন রেল। শ্যামবাজার থেকে শুরু হয়ে পাতিপুকুর, বাগুইআটি, হাতিয়ারা, রাজারহাট, লাঙলপোতা, হাড়োয়াখোল, খড়িবেড়ি, আমিনপুর, বেলেঘাটা জংশন হয়ে এই ট্রেন পৌঁছত হাসনাবাদ। নিত্যযাত্রী ছাড়াও কাঠ, পাট, মাছ, দুধ, মাদুর ও কৃষিজ পণ্যও নিয়ে যেত এই লাইনের গাড়িগুলি। বাষ্প-ইঞ্জিনচালিত পাঁচ কামরাবিশিষ্ট এই ধীরগতির ট্রেনে শ্যামবাজার থেকে বসিরহাট পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগত সাড়ে চার ঘণ্টা। কিন্তু খুব দ্রুত শ্যামবাজার থেকে বাস-পরিষেবা চালু হয়। ট্রেনের চেয়ে ঢের কম সময়ে এবং কম খরচে বাসে চড়ে মানুষ পৌঁছতেন গন্তব্যে। ১৯২৭ সালে মার্টিন কোম্পানির এই শ্যামবাজার-হাসনাবাদ লাইন বিক্রি করে দেওয়া হয় অন্য কোম্পানির কাছে। আরও পরে যাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়া, রেলপথ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় ১৯২৭ সালে কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। পঞ্চাশ বছর চলার পর ১ জুলাই ১৯৫৫ এই লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ট্রেনটি যে দিন শ্যামবাজার থেকে ছাড়ে, সে দিন লাইনের দু’ধারে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল শেষ বিদায় জানাতে। ১৯৫৫-র পর এই রেলপথ ভারত সরকার অধিগ্রহণ করে এবং ইস্টার্ন রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের অন্তর্গত হয়ে যায় এই লাইট রেললাইন। ১৯৬২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রেলমন্ত্রী জগজীবন রাম এই নতুন রেললাইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন
মার্টিন রেলের হাওড়া-আমতা এবং হাওড়া-শিয়াখালা শাখার গভীর প্রভাব পড়েছিল তখনকার সামাজিক জীবনে। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগনার সামাজিক ইতিহাসে এই রেলের ভূমিকা বিরাট। এই রেললাইনের স্টেশনগুলোয় হাটবাজার, স্কুল, কলেজ, জনবসতি গড়ে ওঠে। কৃষিজাত পণ্য এবং গ্রামীণ কুটিরশিল্পে উৎপন্ন দ্রব্য খুব সহজেই মার্টিন ট্রেনের মাধ্যমে শহরের বাজারে চলে আসতে লাগল। মার্টিন রেলের দৌলতে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বলেই আমতা-রামসদয় কলেজ এবং কদমতলায় হাওড়া নরসিংহ কলেজ তৈরি হয়, গ্রামাঞ্চলের বহু ছাত্র এখানে ভর্তির সুযোগ পায়। হাওড়া-হুগলির গ্রামগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ এই মার্টিন রেল ধরেই হাওড়া এবং কলকাতা শিল্পাঞ্চলে নিয়মিত যাতায়াত করত। একটা সময়ে হাওড়া-আমতা শাখায় মোট ৭৫টি ট্রেন চলাচল করত। পাশাপাশি বাস রুটেও চলত বেশ কিছু গাড়ি, বাস, টেম্পো ইত্যাদি
সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম উপাদান যে লোকবাহিত গল্পগাছা, মার্টিন রেল নিয়ে সেই পরম্পরাও খুব একটা কম নেই। গ্রামের মেয়েরা নাকি রেললাইনে সিঁদুর মাখিয়ে দিয়ে ছড়া কাটত— “রেল রেল রেল তোমার পায়ে দিই দেল”। কেউ হয়তো আত্মহত্যা করার জন্য মার্টিন রেলের লাইনে শুয়ে রয়েছে। অত্যন্ত ধীরগতির ট্রেন বলে ড্রাইভার হয়তো কেবিন থেকে নেমে এসে লোকটিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠালেন। কোনও চাষি হয়তো চলার পথে ড্রাইভারকে অনুরোধ করলেন গাড়ি থামাতে। পার্শ্ববর্তী কোনও পরিচিতের বাড়িতে তিনি রেখে এলেন তাঁর মাচার লাউ। পুকুরের মাছও গাড়ি দাঁড় করিয়ে তুলে দেওয়া হত গার্ডের কামরায়। গ্রামের পরিচিত কোনও মহিলা ট্রেনলাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ড্রাইভার সদয় হয়ে তাকে বললেন— “মাসি, হাঁটছ কেন? ট্রেনে উঠে পড়ো।” মহিলা জবাব দিল— “তুমি এগোও বাবা, আমার তাড়া আছে।” অর্থাৎ গোড়ার দিকে ট্রেনের গতি ছিল মানুষের পায়ে হাঁটার গতির চেয়েও শ্লথ। স্টেশনে ঢোকার আগে কিছু ক্ষণের জন্য পাদানিতে চড়া এবং স্টেশন ছেড়ে ট্রেনের গতি বাড়ানোর আগে গাড়ি থেকে নেমে পড়া অনেকের কাছেই ছিল এক মজাদার খেলা। বাংলা সাহিত্য, ছড়া, প্রবাদবাক্য, বাংলা-হিন্দি সিনেমায় মার্টিন রেলের উল্লেখ এবং অনুপ্রবেশ তাই সে দিন ছিল অবশ্যম্ভাবী। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘হাওড়া-আমতা ট্রেন দুর্ঘটনা’ নামক উপন্যাস, কবি বিষ্ণু দে-র লেখা ‘ছড়ানো এই জীবন’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভিযাত্রিক’-এ মার্টিন রেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দি এবং বাংলা ছবিতেও এসেছে এই রেলের দৃশ্য। ১৯৬৬ সালে গুরু দত্তের ছবি ‘বাহারে ফির ভাই আয়েগি’-তে ধর্মেন্দ্র ও জনি ওয়াকারের অভিনয়ে এবং মহেন্দ্র কপূরের কণ্ঠে ‘বাদল যায়ে অগর মালি, চমন হোতা নহি মালি’ গানটি দৃশ্যায়িত হয়েছে। ১৯৭১ সালের সুপারহিট ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিটিতে ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানটি মার্টিন ট্রেনের সিকোয়েন্সে গাওয়া হয়, যদিও স্টুডিয়োতে দৃশ্যটি পুনর্নির্মিত হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে দীনেন গুপ্ত পরিচালিত রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘নতুন পাতা’ সিনেমায় নায়িকা এই মার্টিন রেলওয়ের অন্তর্গত পাঁতিহাল স্টেশনে স্টেশনমাস্টারের ঘরের ছাদে উঠে বাঁদর ধরার কসরত করেছিল। স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ানো, ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়া, স্টেশনে ট্রেনে চড়ে নব বরবধূ আসার দৃশ্য এখানে দেখানো হয়েছে। ১৯৬৪ সালে কিশোরকুমার পরিচালিত ‘দূর গগন কে ছাঁও মে’ ছবিতেও মার্টিন ট্রেনের দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। জনস্মৃতিতে রয়ে গেছে ট্রেনের হকার বা ফেরিওয়ালাদের কথাও। হকাররা এক কামরা থেকে অন্য কামরায়, এমনকি ছাদে-বসা যাত্রীদের কাছেও চা-ফুলুরি-বেগুনি পৌঁছে দিত। মাজুর ‘খৈচুর’, জগৎবল্লভপুরের পান, মাকড়দহের চা, ডোমজুড়ের তেলেভাজা, আমতার পান্তুয়া রীতিমতো আদরের ছিল যাত্রীদের কাছে। এ ছাড়াও এই অঞ্চলের তেভাগা আন্দোলন, মার্টিন রেল-কর্মচারী আন্দোলন, যাত্রী সমিতি, রেলকর্মচারীদের স্ট্রাইক ইত্যাদির স্মৃতিও সে কালের বহু মানুষের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল
১৯৫৭-৫৮ থেকে সমস্যা শুরু হলেও ষাটের দশকের শেষে মার্টিন রেলের হাওড়া-আমতা এবং হাওড়া-শিয়াখালা শাখায় কোম্পানির আর্থিক অবনতি প্রকট হয়ে ওঠে। বাস ও মোটর পরিষেবার উন্নতির সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে, ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষ ও ধর্মঘটের চাপে মার্টিন রেল কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১ জানুয়ারি ১৯৭১ থেকে এই লাইনের সমস্ত রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ১৯৭২ সালে লোকসভার প্রাক্-নির্বাচনী জনসভায় এসে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী এই লাইট রেলওয়ে পুনরায় চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন। ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে এই মিটার গেজ রেলওয়ের বদলে ব্রড গেজ রেলওয়ে চালু হয়। দায়িত্ব নেন ভারতীয় রেল মন্ত্রক। মার্টিন রেলের বেশির ভাগ কর্মচারীদের রেল দফতরের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দেওয়া হয়। ক্রমে সমস্ত রেলপথটি ভারতীয় রেলের দক্ষিণ-পূর্ব শাখার অন্তর্ভুক্ত হয়। মার্টিন রেল আর নেই। কিন্তু আজও মানুষের স্মৃতিতে এর অস্তিত্ব অম্লান
সংগৃহীত