23/07/2025
বাংলা তিনবার ভেঙেছে। প্রথম বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ সালে। প্রতিবাদে সারা বাংলা জুড়ে রাখিবন্ধন হয়েছিল সেবার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রাস্তায় নেমেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়।—রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে। রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে আছে—মেয়েরা খই ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম—যেন একটা শোভাযাত্রা, দিনুও সঙ্গে ছিল, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল—বাংলার মাটি, বাংলার জল বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান।"
তারপর সেটাই একটা মিছিল হয়ে গেল। যাকেই সামনে পাওয়া যাচ্ছে, তার হাতেই বেঁধে দেওয়া হচ্ছে রাখি। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। প্রায় অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গে কলকাতার রাজপথে হাঁটছেন রবীন্দ্রনাথ। পাথুরেঘাটা গিয়ে মিছিল যাচ্ছে, বীরু মল্লিকের আস্তাবলে গিয়ে মুসলমান সহিসদের হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর চললেন চিৎপুরের বড়ো মসজিদের দিকে। মসজিদে যাঁদের পাওয়া গেল, সবাইকে পরানো হল রাখি। তাঁরাও খুশি মনে হেসে রাখি পরেছিলেন সেদিন। এই ঐক্যের তাপে ইংরেজ বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব রদ করতে বাধ্য হয় একটা সময়।
১৯৪৭ সালে হল পরের বঙ্গভঙ্গ। দ্বিতীয়বার। সেটা এরকম গর্বের ব্যাপার নয়। রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন তার ৬ বছর আগে, শেষযাত্রায় তাঁর দাড়ি উপড়ে নেওয়া হয়েছে। দেশবন্ধু আরও অনেক আগে গত। সুভাষ বসু কোথায়, কেউ জানেনা, শরৎ বসু হীনবল। কেউ রাখিবন্ধনের ডাক দেয়নি সেবার। বরং ৪৬-৪৭ সাল জুড়ে চলেছিল তাণ্ডব নৃত্য। চিল, শকুন, মিনা পেশোয়ারি আর গোপাল পাঁঠারা রাজত্ব করেছে ভারত-ছাড়োর পরের কলকাতায়। গান্ধিজি অনশন করেছেন বেলেঘাটায়। কেউ রাখিবন্ধনের কথা বলেননি। যাঁদের বলার কথা ছিল, তাঁরা ক্ষমতার আঁচলের নিচে মুখ লুকিয়ে বসে ছিলেন। যাঁদের মুখ খোলার কথা ছিল, আমাদের সম্মাননীয় বুদ্ধিজীবীগণ কেউ এই সময়টা নিয়ে একটা কথা অবধি বলেননি, পাপ ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত ছিলেন। বাংলায় রাখিবন্ধন হয়নি, বাংলায় কোনো মান্টো তৈরি হয়নি, প্রচুর ক্ষমতাশালী লোক থাকার পরেও। কেবল জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ১৯৪৬ -৪৭। এ-যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো কান্তিময় আলো, চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের। এর কিছুদিন পর দিন ট্রামে চাপা পড়ে মারা যান, যেমন মারা যান আরেক ভগ্নহৃদয় ট্রাজিক নায়ক শরৎ বসু। এই ট্রাজেডি ধারণ যাঁরা করেছেন, তাঁদের বেশিদিন বেঁচে থাকাই অসম্ভব।
তাঁদের শেষযাত্রায় কে কে ছিল, তাও আর যে জানা যায়না, এ আমাদের পূর্বপুরুষের পাপ। সে পাপ, অনুতাপহীন, ধামাচাপা দেওয়া হয়ে গেছে। ১৯৪৬-৪৭ আমাদের পাঠক্রমে ছিল। প্রথমবার যখন পড়ি, হতাশা-টতাশা সবই বোঝা গিয়েছিল, কিন্তু অবোধ বালক ও বালিকা আমরা, প্রশ্ন করেছিলাম, এর নাম ৪৬-৪৭ কেন? রক্তের নদী থেকে কেন ইয়াসিন, হানিফ, গগন, বিপিনরা প্রেতাত্মার মতো উঠে আসবে? ওই বছরই দেশ স্বাধীন হয়েছিল না? অবোধ কিশোর ও কিশোরীরা, হায়, জানতনা, ভাগের ইতিহাস, কলঙ্কের ইতিহাস, দাঙ্গার ইতিহাস, পিতৃপুরুষের পাপ, সব ধামাচাপা দেওয়া হয়ে গেছে ১৫ই আগস্টের মহোৎসবের নিচে। ৪৬ সালে জীবনানন্দের চোখের সুমুখে শুধু লাশ ছিল, কোনো রাখিবন্ধন ছিলনা।
তৃতীয় বঙ্গভঙ্গ, বিতাড়ন, হচ্ছে, হয়ে চলেছে, হতে চলেছে, এই ২০২৫ সালে। পাথুরেঘাটার শশী বা মুর্শিদাবাদের ইয়াসিন, আসামের ব্রজ শীল, মার খাচ্ছে, তাড়া খাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকে বসে আছে, বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, রোজ। আমাদের এবার অন্তত একটা রাখিবন্ধন চাই।
৯ তারিখ, আগস্টের ৯, ২০২৫, আর কেউ করুক না করুক, আমরা রাখিবন্ধন করব। পাঁজিটাজিতেও ওইদিনই রাখি। কিন্তু সে জন্য না। আমাদের ঠেক বদল হচ্ছে কলেজ স্ট্রিটে, ওইদিনই একটা আলোচনা সভাও ঠিক করা হয়েছিল ত্রিপুরা হিতসাধনী সভায়। ঘটনাচক্রে সেদিনই রাখি। ইতিহাসের বাঁকে বোধহয় এইরকম আপতিক ঘটনা ঘটেই থাকে। ওইদিন তাই আমরা একে অপরের হাতে রাখি বাঁধব, অজানা লোকেদের হাতেও বেঁধে দেব, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে। সঙ্গের পোস্টারে সব দেওয়া আছে, যাঁরা চেঁচামেচি, মিটিং-মিছিল কিচ্ছু করতে চাননা, আসুন, অবশ্যই আসুন। সঙ্গে নিয়ে আসুন হাতে বানানো রাখি। একটা সুতো হলেই হবে, এ তো প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়। বেঁধে নিন, বেঁধে দিন রাখি।
পত্রদ্বারা আমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনা করবেন। আর যারা একান্তই আসতে পারবেন না, নিজের এলাকায়, নিজের বাড়িতে, নিজের অফিসে, নিজের মতো করে রাখি বাঁধুন। সবাইকে কলেজস্ট্রিটেই আসতে হবে এমন তো না। সকল ঘর, সকল মাঠ, সকল রাস্তা হয়ে উঠুক রাখিবন্ধনের রাস্তা। বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন, এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান। ভগবানে সকলে ঠিক বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু বাঙালিতে তো করে। অতএব গুরুচণ্ডালির পক্ষ থেকে এই আবেদন রইল। যাঁরা পড়লেন, ছড়িয়ে দিন, বা নিজের মতো করে আবেদন করুন, যা খুশি।