05/09/2025
• Happy Teacher's Day
লেখায় – পারমিতা
শুধু শিক্ষাদান করাই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব নয়,আরও অনেক দায়িত্ব থাকে। শুধু বই নয়, জীবনযাত্রার মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা, সততা, সহমর্মিতা শেখানো, ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করা, ভয় দূর করা, তাদের আগ্রহ ও প্রতিভা চিহ্নিত করে উৎসাহ দেওয়া শিক্ষকের দায়িত্ব। শিক্ষকের প্রভাব শুধু স্কুলেই নয়, সমাজেও পড়ে। তাই সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা, ছাত্রদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করাও শিক্ষকের কর্তব্য। শিক্ষক কেবল পাঠদাতা নন, তিনি একজন আদর্শ নির্মাতা, পথপ্রদর্শক ও সমাজগঠক।
বিনয়বাবু হলেন প্রত্যন্ত গ্রামের একজন অঙ্কের শিক্ষক। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীর ক্লাস নিতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। তিনি শুনলেন তিনজন ছাত্রীর কথোপোকথন । একজন হলো ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল তৃষা আর বাকি দুজন হলো রেখা,কাকলী; এরা অঙ্কে ভীষণ কাঁচা।
তৃষা – এই, কাকলী! রেখা!...তোরা আবার আমার কি ভুল ধরাচ্ছিস রে?...তোরা তো অঙ্কে 12/13 পাস; আর আমি?...100 তে 100 পাই! তাই নেক্সট টাইম থেকে একদম আমার ভুল ধরাতে আসবি না। আর তাছাড়া, তোদের থেকে শিখবই বা কি? কিছুই তো পারিস না!...
কাকলী – আরে! আমরা ভুল ধরাচ্ছি না। তুই হয়তো ভুল দেখেছিস; তাই হয়তো angle ta, ভুল মেপেছিস...
রেখা – হ্যাঁ...সেই চোখের ভুল তো হতেই পারে।
রমেন – আরে তোরা চুপ কর! আর ঝগড়া করিস না। স্যার ক্লাসে আসছেন।
( সবাই একসাথে ) গুড মর্নিং স্যার!
বিনয়বাবু :- গুড মর্নিং স্টুডেন্টস। বসো তোমরা।
( সকলে বসে পড়ল, ঠিক তারপরই আবার বলতে শুরু করল )
আচ্ছা.....আজ আমি তোমাদের দুটো গল্প শোনাতে চাই,তোমরা কি শুনতে চাও?
সবাই মিলে বলে উঠল, "হ্যাঁ স্যার, শুনতে চাই! শুনতে চাই!"
তৃষা – হ্যাঁ স্যার, শুনবো। কিন্তু, তার আগে একটু পড়িয়ে দিন। তারপর নাহয় গল্প শুনব।
বিনয়বাবু – রোজ তো তোমরা পড়াশোনা করো। আজ নাহয় একটু গল্প শুনলে।
তৃষা – আচ্ছা, ঠিক আছে স্যার। তাহলে গল্পই হোক।
বিনয়বাবু – আচ্ছা...তোমরা বলো তো, দুজন অশিক্ষিত মানুষের থেকে কি কোনো অঙ্ক শেখা যেতে পারে?
তৃষা – ওরা তো অশিক্ষিত! তাহলে ওরা আবার কি অঙ্ক শেখাবে?
বিনয়বাবু – বাকিদের কি একই মতামত?
রেখা – তা কেমন করে সম্ভব? .. আপনিই বলুন স্যার!
( সবাই মিলে ) হ্যাঁ স্যার। বলুন না, বলুন না.....
বিনয়বাবু – শোনো তাহলে.... আমার বাবা একজন সবজি বিক্রেতা ছিলেন। তিনি কিন্তু কখনও স্কুলে যাননি; আমার অঙ্কের হাতে খড়ি কিন্তু ওনার থেকেই।
কাকলী – তাহ্....কিভাবে শিখলেন স্যার?
বিনয়বাবু – বাবার কাছেই সংখ্যা শেখা..,যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ..... তারপর !গ্রাম ,কিলোগ্রাম ,মিলিগ্রাম; ভর মাপার সব একক বাবার থেকেই শেখা।
রমেন – বাহ, এটা কিন্তু দারুন ব্যাপার!
কাকলী – আমিও বাজারে দেখেছি... সবজি কাকুরা খুব তাড়াতাড়ি হিসেব করেন।
রেখা – হ্যাঁ! আর কত সহজেই ওজন হিসেব করে, আর নামতা ডেকে দাম বলে দেন।
বিনয়বাবু – কি, তৃষা?... অঙ্ক শিখতে পেরেছি তো...?
তৃষা – হ্যাঁ, শিখেছেন।... তবে, এটা তো যে কেউ শেখাতে পারে।
বিনয়বাবু – কিন্তু, তুমিই তো বলেছিলে, ওরা আবার কি শেখাবে?
তৃষা – হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু, তখন তো এভাবে ভেবেই দেখিনি।
রমেন – আরো একটা গল্প বাকি! সেটাও শোনান স্যার....!
বিনয়বাবু – তোমরা তো দেখছি শোনার জন্য ভীষণ excited !.... আচ্ছা, শোনো তাহলে...
( সবাই মিলে ) হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন স্যার।
বিনয়বাবু – আমার কাকু কোনো মতে প্রাইমারি গণ্ডিটা ডিঙিয়েছিলেন; উনি একজন অসম্ভব দক্ষ ছুতোর মিস্ত্রি। উনি প্রতিটা কাঠ কাটতেন জ্যামিতিক Precision এ । একদম প্রাইমারি ক্লাসেই ওনার হাত দিয়েই পরিচয় হয় কোনটা Circle, কোনটা Square, কোনটা Triangle ; কোনটার Area, Volume কিভাবে বের করতে হয়।.....আসলে, ওনারাই কিন্তু আমার প্রথম অঙ্কের শিক্ষক, আর ওনারা দক্ষতার সাথে শিখিয়েছিলেন বলেই তো আমার অঙ্কের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল....
রেখা – সত্যি স্যার! এটা কিন্তু দারুন ব্যাপার; এভাবেও যে শেখা যায়, আমরা কখনও ভেবেই দেখিনি।
বিনয়বাবু – হ্যাঁ, এভাবেই আমার শেখা।.... কি, তৃষা !...শিখতে পেরেছি তো..?
তৃষা – হ্যাঁ স্যার।
বিনয়বাবু – সমাজের প্রতিটা মানুষের থেকেই কিছু না কিছু শেখার আছে। একজন পিছিয়ে পড়া বন্ধুর থেকেও অনেক কিছু শেখা যেতে পারে।...আমাদের জীবনে প্রতিটা মানুষের গুরুত্ব রয়েছে, মূল্যবোধ রয়েছে।...তাই তোমাদের সবাইকে বলছি... সবাইকে সম্মান করবে, কাউকে ছোটো করবে না।
তৃষা – আমি বুঝতে পেরেছি স্যার; আপনি কি বোঝাতে চেয়েছেন।...
( কাকলী, লেখার দিকে চেয়ে ) এই, রেখা! কাকলী! ...Sorry রে...ক্ষমা করে দিস আমায়।
রেখা-কাকলী – না...না এভাবে ক্ষমা চাস না!...আমরাও এবার থেকে ভালো করে অঙ্ক শিখব।
বিনয়বাবু – তৃষা! ...তুমি তো খুব ভালো করো, তুমি তো বন্ধুদের একটু অঙ্ক শেখাতে পারো, বোঝাতে পারো!
তৃষা – হ্যাঁ স্যার !...আমি এবার থেকে, নিজের সাধ্য মতো, সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করব...এবং নিজের ভুলটাকেও স্বীকার করে নেব, আর কাউকে ছোটো করব না।
( সবাই মিলে ) হ্যাঁ স্যার.... এবার থেকে আমরা সবাই একসাথে থাকব... সবাই সবাইকে সাহায্য করব।
বিনয়বাবু –এই তো, সাব্বাস!...এটাই তো চাই।...একটা কথা তোমরা সবসময় মনে রেখো, তোমরা এভাবে এগিয়ে এলে "দশের উন্নতি, দেশের উন্নতি, সমাজের উন্নতি।"
..এভাবেই একজন শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তাদের নিজেদের স্বজাতি, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছেন; বন্ধুদের মধ্যে একতা সহবোধের শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের শিখিয়েছেন, সমাজের প্রতিটা মানুষের কাছেই কিছু না কিছু শিক্ষনীয় জিনিস আছে; সে সবজি বিক্রেতা হোক, বা কাঠের মিস্ত্রি, কিংবা পিছিয়ে পড়া বন্ধু।... এই প্রকৃতি, সমাজ আর সমাজের প্রতিটি জীব আমাদের শিক্ষক।
তাই তো APJ Abdul Kalam বলেছেন -
"শিক্ষার উদ্যেশ্য হল কৌশল এবং বিশেষজ্ঞতার সাথে ভালো মানুষ তৈরি করা:
একমাত্র শিক্ষকেরাই পারে এইরকম মানুষ তৈরি করতে।"