
12/07/2025
প্রতিমা মূর্তি তৈরির দু'রকমের ধারা আমাদের বাংলায় চালু। কংসনারায়ণী আর বিষ্ণুপুরী। তো, এই দুই ধারার প্রতিমার পেছনে থাকে 'চালা'। যা আমরা জানি 'চালচিত্র' নামে। মুর্তির উচ্চতা অনুযায়ী এই চালচিত্র বানানো হয়। প্রতিমার মাথার মুকুট থেকে চালচিত্রের উচ্চতা সবসময়েই অনেকটা বেশী থাকে। এই চালচিত্র আবার বিভিন্ন রকম। বৃন্দাবনী, ইন্দ্রাণী,
ব্রাহ্মণী, কৈলাসী, দশাবতারী, রামচন্দ্রী ইত্যাদি।
'এখন সাধারণত যে চালচিত্র আঁকা হয় তা মার্কিনি চালিতে ব্যবহৃত হয়। তবে মঠচৌড়ি, টানাচৌড়ি কিংবা সাবেক বাংলা চালের চালচিত্র হত নানা রকম। চালচিত্রে কোথাও কোথাও দেখা যেত অষ্টনায়িকা, দশমহাবিদ্যা, নবদুর্গা, চণ্ডীর কাহিনি, দশাবতার, কৃষ্ণলীলা কিংবা রামায়ণের ঘটনা। শুধু তাই নয় বাংলার এক এক প্রান্তের চালচিত্র হত এক এক রকম। যেমন মঠচৌড়ি চালির চালচিত্রে দেব দেবীর অবয়বগুলি থাকে উপর থেকে নীচে, একটির নীচে আর একটি। আবার সাবেক বাংলা চালে সেগুলি থাক থাক করে আলাদা আলাদা প্যানেলে থাকে। অন্য দিকে, মার্কিনি চালের পটে সেগুলি থাকে পাশাপাশি। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির 'রাজরাজেশ্বরী' দুর্গার চালচিত্রটি ব্যতিক্রমী। মাঝখানে থাকেন পঞ্চানন শিব, পাশে থাকেন পার্বতী। তার এক পাশে থাকে দশমহাবিদ্যা। অন্য দিকে দশাবতার।'
.. দুর্গা প্রতিমার মাথার মুকুট থেকে পায়ের নূপুর অব্দি সব আভরণই নির্মাণ করেন এই শোলা শিল্পীরা। বংশানুক্রমে পারিবারিক প্রথায় চলে আসা এই শিল্পের অন্যান্য ব্যবহারও কিছু কম নয়। মায়ের মূর্তির জন্য শোলার শাড়ি, কল্কাদার আঁচল, চালচিত্র ইত্যাদি সেজে ওঠে শোলা শিল্পীদের হাতের নিপুণতায়। লাল, নীল, সবুজ, গোলাপি প্রধানতঃ এই চার রঙের কাগজ বা কাপড়ের ওপর শোলার বিচিত্র কারুকার্যে দেবীর শাড়ি সেজে ওঠে নানা বর্ণে।
প্রতিমার বুকের ওপরে থাকা শাড়িটির নাম 'ত্রিগুণ'। কোমরে দুই প্যাঁচ কাপড় ঘুরিয়ে নিয়ে বুকের ওপর এক প্যাঁচ দিয়ে আমাদের মেয়েরা শাড়ি পরে। তাই এমন তার নাম। এই ত্রিগুণের পাড় আর জমিতে থাকে সূক্ষ্ম শোলার কাজ। দুই কানে 'বেণীমকর', 'দুল' আর 'চৌদান'। এই বেণীমকর পুরোটাই সূক্ষ্ম শোলার কাজে তৈরি। দেবীর হাতে 'বাজু', 'বিচ্ছু', 'শাঁখা', 'চুড়ি', 'রতনচূড়', 'আংটি', 'ঝুমকো' ইত্যাদি অলংকার। দেবীর মাথায় মুকুট। এই মুকুটিখানিই শোলার নয়নাভিরাম শিল্পকর্মের এক আশ্চর্য নমুনা। মুকুটের ওপরের অংশের নাম 'কিরীট'। শোলানির্মিত কল্কার কাজে পূর্ণ থাকে দেবীর এই কিরীট। দেবীর কল্কাদার বিশাল আঁচলখানি তৈরি করতে যে মেহনত আর উদ্ভাবনী শক্তি লাগে তা একমাত্র বাংলার শিল্পীরাই পারেন ফুটিয়ে তুলতে।
দুর্গাপ্রতিমার পেছনের 'চালচিত্রে' শোলা-নির্মিত শিল্পের এক অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি নির্মাণ করেন বাংলার শোলাশিল্পীরা। শিল্পীরা এই চালচিত্রকে সাজিয়ে তোলেন নানান 'কল্কায়', 'পটিতে' আর ফুল-লতা-পাতার অলংকরণে। চালের প্রথমেই থাকে 'পানপটি'- পানের মত পাতার সঙ্গে লতার তরঙ্গভঙ্গ। এই 'পানপটির' পরে থাকে 'লতাকোলঠিক্রে', আর এক রকম লতার মনোজ্ঞ বক্রছন্দ। তার পাশেই থাকে 'কোলঠিক্রে'- এতেও এক সুচারু লতাছন্দের ব্যঞ্জনা। তারপর দেওয়া হয় 'আধগোলা' অর্ধচন্দ্রাকৃতি অলংকার। 'আধগোলার' পাশেই থাকে 'কল্কা'-এই 'কল্কাই' চালচিত্রের শেষ সীমান্তিক ভূষণ। কল্কার মাথার উপরে সারি সারি পাখী-কল্কার মাঝখানে প্রস্ফুটিত পদ্ম-তার উপরে ভ্রমর। এই রম্য শিল্পকার্যে মণ্ডিত বিরাট 'চালচিত্র'টি দর্শকের চিত্তকে ভাবগম্ভীর ভক্তিরসে ভরিয়ে তোলে।
এই শোলার অলংকারে কত রকম লতার বাহার-কত ফুলের প্রাচুর্য। বাংলার আলপনায়; বাংলার কাঁথায়-বাংলার মন্দিরে, মসজিদে-বাংলার কলসে, হাঁড়িতে, সরার গায়ে-সর্বত্রই এই সমস্ত লতা-ফুল-পাতার অলংকরণ। প্রতিমা সজ্জাতেও তাই এই লতাপাতার ছড়াছড়ি। 'পদ্মলতা', 'কলমীলতা', সুষণীলতা, 'চন্দ্রলতা,' 'শঙ্খলতা'-মণ্ডনশিল্পের আরও কত বহু পরিচিত ও অপরিচিত ডিজাইনের লতাপল্লবের মনোরম ভঙ্গীতে বাংলার শিল্পীরা এই শোলার সাজ তৈরী করেছে।'
কলকাতার বারোয়ারি বারোয়ারির কলকাতা
গৌতম দত্ত
মূল্য ₹ ৫০০/-
বইদেশিক