28/03/2025
বারুনী-স্নান ও মহাবারুনী-মেলা
✍️ তাপস কান্তি বিশ্বাস
শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনের পূণ্যতিথিতে ওড়াকান্দি ও ঠাকুরনগরে আমরা যে মতুয়া মহামেলা দেখতে পাই, তার শুরু হয়েছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের তিরোধানের পর তার সুযোগ্যপুত্র শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের হাত ধরে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে 1897 সালে। প্রথম বছরেই এই জন্মোৎসবে 15 লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়েছিল। গুরুচাঁদ ঠাকুরের আহ্বানে অচিরেই সেই মেলা আরো বৃহৎ আকার ধারন করে। ওড়াকান্দির আশেপাশের সমস্ত গ্রামের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো এই মতুয়াদের আপ্যায়ন করার আশায়।
মতুয়ারা ডঙ্কা-কাসর-নিশান সহযোগে দলে দলে ওড়াকান্দিতে আসতে শুরু করেন ঐ পূণ্যতিথিতে। তাদের আসার পথে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে থাকতো জলসত্রের ব্যবস্থা।
হরিচাঁদ ঠাকুর তার জন্মভূমি সফলাডাঙ্গা থেকে অত্যাচারী জমিদার সূর্যমনি মজুমদারের দ্বারা উৎখাত হয়ে রামদিয়ার সেন বাড়িতে স্থান নেন। তার পরে তিনি তার ছোটকাকা রণকৃষ্ণঠাকুরের ঘৃতকান্দি আমভিটা বাড়িতে গিয়ে ওঠেন, ঐ বাড়িতেই গুরুচাদ ঠাকুরের জন্ম হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ওড়াকান্দি ভজহরি দাসের বাড়িতে থেকে ওড়াকান্দির বর্তমান ধাম তৈরি করেন। এটাই হরিচাঁদ এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের কর্মভূমি। এলাকা পুরোপুরি জলমগ্ন হয়ে থাকতো, তাই ওড়াকান্দি তথা আশেপাশের গ্রামের সমস্ত বাড়ি তৈরি করার আগে মাটি কেটে ভিত উচু করা হোতো। সেই মতো ঠাকুরবাড়ির পশ্চিম ও উত্তর দিকের জমি থেকে মাটি কেটে বাড়ির ভিতে দেওয়া হয়। মাটি কাটার ফলে তৈরি সেই পুকুরগুলোই পরবর্তীতে কামনাসাগর ও দুধসাগর নামে পরিচিত ছিল। এই কামনা সাগরেই মতুয়া ভক্তরা পূণ্যতিথিতে এসে স্নান করতেন। কামনা সাগরে ভক্তরা ডুব দিয়ে উঠে কামনা করতেন - "হে ঠাকুর আমি যেন তোমার দেখানো পথে চলতে পারি"। সেই থেকে শুরু হোলো ওড়াকান্দিতে বারুনী স্নান আর এই স্নানকে কেন্দ্র করেই শুরু হোলো বারুনী মেলা, যা আজও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে হয়ে চলেছে ওড়াকান্দিতে।
তবে দেশভাগের পর প্রমথরঞ্জন ঠাকুর পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে বসতি স্থাপন করেন এবং ওড়াকান্দির অনুকরণে এখানেও বারুনী স্নান ও বারুনীমেলা শুরু হয় 1948 সালে। এর ফলে দেশহারা উদ্বাস্তু মতুয়ারা ঠাকুরনগরে প্রতিবছর তাদের প্রাণের ঠাকুরের জন্মলগ্নের পূণ্য তিথিতে ভিড় জমান।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মতুয়ারা ডঙ্কা নিশান কাসর শিঙ্গা সহযোগে "হরিবলো হরিবলো" ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা করে ছুটে আসেন এই পূণ্যভূমিতে।
এ কোনো সাধারণ মেলা নয়, এ মেলা এক মহামিলন মেলা। এই পূণ্যভূমির স্পর্শ মতুয়াদের হৃদয়ে এনে দেয় এক নির্মল প্রশান্তি, তাইতো সারা বছর তারা অপেক্ষা করে থাকে এই দিনটির জন্য। লক্ষ লক্ষ মতুয়ারা হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে ছুটে আসেন তাদের প্রাণের ঠাকুরের পূণ্যভূমিতে। যদিও ঠাকুরনগর হরিচাঁদ গুরুচাঁদের জন্মভূমি ও কর্মভূমি কোনোটাই নয়, তবু তাদের উত্তরসূরীরা এই মাটিতেই বসবাস করেন, সেই আবেগেই মতুয়ারা এখানে আসেন।
একদা এই ভারতের নির্যাতিত নিপীড়িত সমাজের মুক্তি দিতে আলোর দিশা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহামানব হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর, তাদের স্মরণে আজ তার ভক্তরা তাদের জীবনের সব জ্বালাযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ভক্তিভরে ডুব দিতে আসেন ঐ কামনা সাগরে, তাছাড়া তারা এই পূণ্যভূমির একটু ধূলো মেখে ধন্য হতে এখানে আসেন। কামনা সাগরের স্নান আর বারুনী মেলা এভাবেই হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলেছে জাতি-ধর্ম বর্ণ-লিঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে দূর থেকে বহু দূরে।
আজ অগণিত মানুষের মতো আমিও এক অপার বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখি সেই লক্ষ মানুষের ঢল, আর অবাক বিস্ময়ে ভাবি - কি জানি কোন অদৃশ্য জাদুতে, নাকি কোনো এক অমোঘ টানে এগিয়ে চলেছে সেই অগণিত মানুষের ঢল যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে। জানি রক্ত মাংসের ভগবান বাস্তবের মাটিতে নেমে না এলে আমরা এই অপরূপ দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম। তাই হয়তো আমার অন্তরাত্মা অস্ফুটেই যেন বলে ওঠে --
জয় হরিচাঁদ,
জয় গুরুচাঁদ
🙏🙏