20/06/2025
আমাদের প্রকাশনার একটি কবিতার বই নিয়ে আলোচনা লিখছেন এই সময়ের প্রিয় কবি দীপশেখর চক্রবর্তী
প্রকাশিত হয়েছে কোল্ডফিল্ড টাইমসে..
https://www.facebook.com/share/p/1FTVLAePPA/
শব্দের পরিমিতি এবং দৃশ্যের চলন: তাপস বিশ্বাসের কবিতা
দীপশেখর চক্রবর্তী
পাখি(দের) বিবা(হের) সানাই, তথ্য বলছে এটি তাপস বিশ্বাসের লেখা দ্বিতীয় কবিতার বই। দুটো (এর) প্রয়োগের মাধ্যমে কবি কি বোঝাতে চাইছেন, বইটির নামে? ধরুন বইটির নাম হল, পাখিদের বিবাহ সানাই। এ ক্ষেত্রে জোর পড়ল 'পাখিদের' এবং 'সানাই' শব্দে। উপলক্ষ ‘বিবাহ’ শব্দটি। এর শব্দের প্রয়োগে একটি সংযোগসূত্র স্থাপিত হল। ফলে তিনটি শব্দই সমান গুরুত্ব অর্জন করল, এখানে। লেখ(কের) পরিচিতি অংশ থেকে জানতে পারি, তাপসবাবু ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। তিনি ‘অল্পবিস্তর’ গদ্যচর্চা করেন। লেখার মাঝে বিরতি নিতে ভালবাসেন। কবিতা তার জীবনে- ‘ এক গাঢ় ধর্মের বোবা স্পেস’। ‘স্পেস’ শব্দটির দিকে পাঠকের মন দিতে বলব। ভূমিকার জায়গায় চারটি লাইন লিখেছেন তাপসবাবু। যাদের ছবি দেখার অভ্যাস আছে তারা দেখতে পারবেন এই চারটি লাইন যেন, সিঁড়ি। নিচে নামতে নামতে অনন্তে মিশে গেছে (ঘন্টাঘাট, চুঁচুড়া?)। তৃতীয় লাইনে তাপসবাবু লিখেছেন, ‘শিকড় আর দূরের ডালপালাদের টানছি গলা চিরে চিরে’। কে ডাকছেন? কবি অথবা পাখি। কেন ডাকছেন, ঠিক পরের লাইনেই, ‘পুরোটা দেখা যায় যদি তোমাকে’। কেন দেখতে চান কবি পুরোটা? কবি কি জানেন না, এই পুরোটা দেখার সম্ভাবনা কোনও মানুষের জীবনে কখনও আসে না। আসে, অনেকটা দেখা। কবি অনেকটা দেখতে পান। যেমন পাখিরা দেখতে পায় অনেকটা। হয়ত পাখির মতো কবিও মানুষের থেকে নিরাপদ এক দূরত্বে থেকে অনেকটা দেখে নিতে পারেন। তিনি জানেন, মানুষের স্পর্শের ভেতর থেকেও নিজেকে একটা নিরাপদ দূরত্বে রাখাই কবির ধর্ম। নইলে মানুষ তাকে শিকার করে। পালক ছিঁড়ে নেয়। বন্ধ করে দেয় গান। তাপসবাবুর কবিতাগুলো ছোট ছোট। শব্দে কৃপণ, তবে ভাবে নয়। বরং কবিতায় যে ধর্মকে অত্যন্ত প্রশংসার চোখে দেখি, শব্দের সেই পরিমিতিবোধ ওঁর কবিতার সম্পদ। তিনি জানেন কোথায় কবিতাকে ধরতে হয়, কোথায় ছাড়তে হয়। অতিরিক্ত বলার মোহ থেকে তিনি নিজের কবিতাকে দূরে রাখতে পেরেছেন। ফলে, ‘শব্দ’ ও ‘স্পেস’( না-শব্দ) তার কবিতার গঠনকে যথাযত করেছে। এমন হতে পারে, বিদেশী কবিতার পাঠ, তাপসবাবুকে এই ভাবের কাছে নিয়ে এসেছে। তার কবিতার ভেতর বাংলার রূপ-রস-প্রকৃতি সবই থাকলেও ফর্মের দিক থেকে তা বাংলা কবিতা থেকে কিছুটা দূরে। বরং ফরাসি অথবা বুলগেরিয়ার কবিতার সঙ্গে তার কবিতার এক গভীর যোগাযোগ পাই। ‘ইমেজিস্ট’ কবিতা আন্দোলনের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাবও তার কবিতায় রয়েছে। শব্দের ক্ষেত্রে তিনি কৃপণ এবং প্রায়শই তার কবিতা একটি দৃশ্য তৈরি করে। তবে দৃশ্য তৈরি করেই তা থেমে যায় না। বরং দৃশ্যের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসে জীবনদর্শন। দৃশ্য থেকে দর্শনে পৌঁছনোর এই পথ তাপসবাবু আয়ত্ত করেছেন। এটি তার কবিতার বিশেষ সম্পদ হয়ে উঠেছে। তাপসবাবু তার ইশারা কবিতায় একটি উপমা ব্যবহার করেন- ‘পলিক্লিনিক রঙের বিকেল’। এমন উপমা আমি আগে কবিতায় পড়িনি। তবে, তা কখনওই অতিরিক্ত বলে মনে হয় না। বরং তা চোখের সামনে বিকেলের যে রূপ তৈরি করল, তা আগে হয়নি (মফ:স্বলীয় যোগাযোগ, অভিজ্ঞতার মিল?)। এই যে কবির নতুন পথের সন্ধান, এতে করে প্রায়শই নিজস্ব স্বর গড়ে ওঠে। আলাদা করে তোলে সমসাময়িক কবিদের থেকে। এটি ব্যবহার করার সাহস ও দক্ষতা কবিকে অর্জন করতে হয়। আবহাওয়া নামে অপর কবিতায় তাপস বাবু লিখতে পারেন, ‘এই যেটুকু বন, সেটুকুই চোখ’। পরের লাইনে লেখেন- ‘চোখের কার্পাস’। সুতরাং শুধু দৃশ্য নয়, দৃশ্যের ভেতর থেকে তিনি এক দর্শনের কাছে গেলেন। এই দেখা তার নিজের। তবুও তিনি দেখালেন পাঠককে। আমাদের চোখেও বন ও চোখের সীমা ফুটে উঠল। সীমার মধ্যে থেকেও তা আশ্চর্য, অসীম। ঠিক পরের ‘অন্ধ’ কবিতাতেই তিনি লেখেন- 'বন নয়, সবুজের ঢাকনা'। ফলে মিশে গেল, 'বন', 'চোখ', 'সবুজের ঢাকনা'। আবার দেখুন কীভাবে ছবি থেকে উঠে আসছে দেখার সুন্দর। ঋতুহীন কবিতায় তাপসবাবু লিখলেন, ‘আমাদের ভিতর শীতের রিকশাগুলো ঢুকে/ স্কুল শেষে বাচ্চা কুড়োচ্ছে আমাদের’। শীতের ভেতর জমে থাকা শোক, একাকীত্ব, এদিকে স্কুল শেষে বাচ্চা কুড়োনোর মিলন, দুই বিপরীত এক হয়েছে এই দৃশ্যে। এক হয়ে যে দৃশ্যটি গড়েছে তাকে বলা যেতে পারে বেদনার ভেতরে রাখা দৃশ্যের সুখ। ‘পাখি’ শব্দটি বারবার ফিরে আসছে তার কবিতায়। ‘সঙ্গমচিহ্নের ডানা’ নামক সিরিজ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘গানের ভিতর( ভেতর নয় কিন্তু) দিয়ে পাখিরা যায়/ গাছের ভিতর দিয়ে যায়, নদীর ভিতর’। পাখিরা আর কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে? সুরের ভিতর, গাছের ভিতর, সঙ্গমের ভিতর। কবি হাওয়ার ভেতর প্রণয় ধরে রাখছেন। তিনি জানেন- ‘এই অভিসার আকাশবর্ণ হবে/ পাখির বোল হবে’। অপর একটি সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত কবিতায় তিনি লেখেন- ‘পাখি আমাদের শেষ আর শুরুর বিন্দু’। স্টেটমেন্ট শুধু নয়, স্টেটমেন্টের পেছনে রাখা জীবনদর্শন। যা ব্যক্তিগত হয়েও অনেকের। সাকার হয়েও নিরাকার। যাক, ‘পাখি’ থেকে সরে যাই এবার। 'নদীচর' নামক একটি কবিতা সিরিজের দুই নম্বর কবিতাটির কাছে দাঁড়াব। তৃতীয় লাইনটি লক্ষ করুন পাঠক- ‘অস্থিমজ্জায় ডুবুরি নামাই’। একই কবিতায় একটি শব্দ পাই নুড়ি নটরাজ( মাঝে কোনও – নেই, তবুও এটি একটিই শব্দ)। একই কবিতায় আরেকটি লাইন- ‘নিজের ভেতর কালো মেয়েটির এত গুঁড়ো করা জল/ এত সম্ভোগ…’ এর পর কি কবিতাটি শেষ হওয়া উচিৎ ছিল? তার পরের শব্দ দুটি- ‘অন্ধকার লাগে!’ অপর একটি কবিতার কথা বলে এই আলোচনা শেষ করব। কবিতার নাম ‘অথৈ’। প্রথম লাইন—‘সন্ধের অন্ধ ব্যাগ, গম্ভীর বাতাস ভরে আনছ তুমি।’ পঞ্চম ও ষষ্ঠ লাইন- ‘শুধু বাতাস নয়, তোমার পায়ের গোছ ধরে ধরে/ জাহাজ আর বন্দরসমেত সমুদ্র চলে এসেছে এতদূর’। ‘পাখিদের বিবাহের সানাই’ কবিতার বইটির সবথেকে বড় শক্তি এই, তা অতিরিক্ত নয়। ‘স্পেস’ ও ‘শব্দ’ -এর ব্যবহারের দক্ষতার কথা তো আগেই বললাম। আরেকটি জরুরি শব্দের কাছে যেতে চাই। কবির বোধ এবং সংবেদনশীলতা। আধুনিকতার নামে কোনও অহেতুক লাফালাফি করা কবির ধর্ম নয়। বিপন্নতা বোঝাতে গিয়ে কেঁদে কেটে অস্থির করেননি। বরং তা চাপা ব্যথার মতো। সেই ভাষা জনপ্রিয় হবে কতদূর- এই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কবিও জানেন, তিনি লিখছেন নিজের জন্য এবং সেই সব পাঠকের জন্য যারা বাংলা কবিতার এই উজ্জ্বল বৃত্তের ভেতর খুঁজে চলেন শান্তিময় অন্ধকার, নীরবতার ভাষা। বোধ, ভাষা, শব্দ এবং দৃশ্যনির্মাণে তাপসবাবু এই বইয়ে সফল। আশা করি, তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না। বইটির নির্মাণে যত্নের ছাপ দেখিয়েছে প্রকাশক ‘এবং অধ্যায়’। প্রচ্ছদও যথাযথ।
পা খি দে র বি বা হে র সা না ই
(প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২০২৩)
তাপস বিশ্বাস
প্রকাশক- এবং অধ্যায়
মূল্য: ২০০ টাকা।