14/07/2025
আলিপুরদুয়ার মেয়ে নাচ করেই পেলেন “বঙ্গ-রত্ন” !
সৌজন্য কালচারাল ডেভলোপেমেন্ট ফাউন্ডেশন, আন্ডার govt. Of India
উত্তরবঙ্গের মুকুটে জুড়ল আরো এক নয়া পালক ।
"যে নাচকে বলা হতো 'ভবিষ্যৎহীন', সেই নাচই আজ এনে দিলো বঙ্গরত্ন — আলিপুরদুয়ারের মোহরের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা"
"যেখানে মেয়েদের থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, অনেকেই বলে নাচ ! ওতো ভদ্র সভ্য মেয়ের কাজ নয় ! সেখানেই এক নারী গড়ে তুললেন সাহসের মঞ্চ!"
লোকের কথায় কান না দিয়ে " নিজের নাচ না থামিয়ে জীবনকেই নাচিয়ে দিলেন মোহর সরকার !"
" একটা সময় যে জায়গায় অপমান পেতেন, আজ সেখানেই দাঁড়িয়ে মেয়েটা সম্মান নিচ্ছে — এ শুধু সাফল্য নয়, এটা এক হার না মানা মেয়ের লড়াই করে জিতে যাওয়া । এ এক ইতিহাস!"
সম্প্রতি, কলকাতার সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে ২৮ ও ২৯ জুন অনুষ্ঠিত International Mega Dance and Music Festival । সেখানে যখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিল্পীরা জড়ো হয়েছিলেন, তখন মঞ্চে উঠে নজর কাড়লেন এক অসম্ভব দৃঢ় মানসিকতার মেয়ে... মোহর সরকার। আলিপুরদুয়ারের এই নৃত্যশিল্পী পেয়েছেন “বঙ্গরত্ন” সম্মান। না শুধু তিনি একা নন, তাঁর নয়জন ছাত্রছাত্রী পেয়েছেন “বঙ্গজ্যোতি” সম্মান। তবে শুধু সম্মান নয়, এই গর্বের মুহূর্তটা যেন ছিল তাঁর জীবনের সমস্ত অপমান, কটাক্ষ ,ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ কষ্ট আর লড়াইয়ের জবাবটা ।
ছোটবেলা থেকেই শুনতে হয়েছে—
"নাচ করে কি হবে?"
"ভালো মেয়েরা এসব করে না!"
"বিয়ের পরেও এসব করবি নাকি?"
সমাজ তাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছে, চোখরাঙানি, চুপ করিয়ে দেওয়া, এমনকি অনুষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেওয়া — এসব যেন জীবনের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল । এমনকি এমনও সময় এসেছে, যখন নিজেরই ছাত্রছাত্রীরা চলে গেছে । অপমান সইতে হয়েছে কেবল মঞ্চে নয়, নিজের কাছেও।
তবু, নাচ ছাড়েননি মেয়েটা ।
কারণ নাচ ছিলো তাঁর জীবনের ধ্যান, জ্ঞান, প্রার্থনা, তাঁর অস্তিত্ব তার বেঁচে থাকার অবলম্বন ! না শুধু নাচেই যে তিনি পারদর্শী তেমনটা নয়, নাচের সাথে সাথে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেছেন ! এমনকি তিনি বেস্ট এংকার এর অ্যাওয়ার্ড ও পেয়েছিলেন !
আলিপুরদুয়ারের নিউ টাউন পার্ক রোডে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মোহর সরকার ।
মোহর সরকার একসময় ভেবেছিলেন চাকরি করবেন । এম.এ এবং বি.এড শেষ করে এক স্কুলে কাজও শুরু করেন। সেখানেই কিছু বাচ্চা তাঁর কাছে নাচ শিখতে আসে। প্রথমে শখ, তারপর ধীরে ধীরে সেই শখটাই হয়ে ওঠে পেশা। বুঝতেই পারেননি, কখন তিনি হয়ে উঠলেন নৃত্যশিল্পী থেকে এক নৃত্যগুরু ।
কিন্তু তাঁর এই সাফল্যের পথ ছিল অজস্র কাঁটায় ভরা। অনুষ্ঠানে সুযোগ না পাওয়া, গসিপ, তির্যক মন্তব্য — এক সময় ভেবেই ফেলেছিলেন, সব ছেড়ে দেবেন । তবে ভিতরের সেই জেদ থামতে দেয়নি। আবার নতুন করে শেখা শুরু করেন, নিজেকে আরও শক্ত করে গড়ে তোলেন ।
ধীরে ধীরে আবারো ছাত্রছাত্রীরা ফিরে আসতে তাকে , সমাজের চোখেও আসে বদল ।
আজ তাঁর কাছে ৩০০-র বেশি ছাত্রছাত্রী নিয়মিত নাচ শেখে, না শুধু নাচ শেখেনেই না, তার একাডেমীর ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বড় বড় মঞ্চ থেকে পুরস্কার অর্জন করেন ।। এখন অনলাইনে যুক্ত হয়েছে দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীরাও । শুধুমাত্র তার কাছ থেকে নৃত্য শিখবে বলেই ।
এই সাফল্যের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে আছেন তাঁর গুরু দীপঙ্কর দত্ত। মোহরের কথায়, “ওঁর আশীর্বাদ না থাকলে আমি এতদূর আসতেই পারতাম না।”
সাথে ছিলেন মা, মামনি, এবং তাঁর স্বামী, যিনি সবসময় পাশে থেকেছেন। এখন মোহর এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছেন, যাঁরা প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন এখন যোগাচ্ছেন পাশে থাকছেন সাহস দিচ্ছেন আরো এগিয়ে যাওয়ার । হ্যাঁ এটাই তো হওয়া প্রয়োজন, একজন আর্টিস্ট কে কখনো বেঁধে রাখতে নেই তাকে খোলা মঞ্চে স্বাধীনতা দিয়ে রাখতে হয়, তবেই হয়তো একজন আর্টিস্ট স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার রসদ ফিরে পাবে । আর এটা বুঝেছিলেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও ! তাই ওরা এখন তার সাহস !
তবে, এই আনন্দময় মুহূর্তে মোহরের চোখে জল এনেছে একটাই কথা— এখন আমার বাবা নেই।
"উনি থাকলে আজ সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন । এখনো বিশ্বাস করি, উনি ওপর থেকে আশীর্বাদ করছেন আমায়।"
মোহরের জীবন আজ শুধু একটি মেয়ের সাফল্য নয়, এটি হাজার হাজার মেয়ের কাছে এক বার্তা — যারা নিজের স্বপ্নকে কখনো হারতে দেয় না । যারা সমাজের বাঁকা চোখকেও অপেক্ষা করে নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে যায় ।
যে সমাজ বলেছিল “নাচ কোনো ভবিষ্যৎ নয়, নাচ কখনোই ভদ্র সভ্য মেয়েদের কাজ হতে পারে না”, সেই সমাজই আজ মোহরের হাতে বঙ্গরত্ন সম্মান পেতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে ! গর্ব করছে, হ্যাঁ এই আমাদের ঘরের মেয়ে মোহর ! আমাদের বাংলার গর্ব !
মোহরের এই আরো একবার সাফল্য প্রমাণ করে দেয়,
“পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। যা শিখো, তাই মন দিয়ে শেখো। সময় নাও, ধৈর্য ধরো, তবেই তুমি নিজের জায়গা তৈরি করতে পারবে। মোহর আরো বলে, আমি চাই, নাচের মধ্যেই আমার জীবন কাটুক, আর সেই নাচের মধ্যেই আমার অন্তিম বিদায় হোক।’’
এ গল্প শুধু মোহরের নয় — এ গল্প সেইসব স্বপ্নদেখা মেয়েদের, যারা জীবনের বাধাগুলোকে সিঁড়ি বানিয়ে উঠে যেতে জানে । এ গল্প শেখায়, নাচ কখনো শুধু তাল-লয় নয়, এটি জীবনের শক্তিশালী উত্তর — যারা বলেছিলো “হবে না”, তাদের মুখের ওপরে জয় লেখা এক তীব্র চাবুক!
The Cob Untold টিমের পক্ষ থেকে মোহরের এই সাফল্যের জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা আপনার আগামী দিন আরো সাফল্যে ভরে উঠুক এই কামনাই করি।