22/05/2025
উত্তরবঙ্গে মাত্র ২টি আসন পাবে তৃণমূল?
WB NORTH NEWS LIVE:
রাজ্যের রাজধানী থেকে দূরত্ব অনেকটাই। ইতিহাস-ভূগোলেও অনেক তফাৎ। জীবিকা, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে মাটি কিংবা গাছ- সবই উত্তরের একান্ত নিজস্ব। তাই সব রাজনৈতিক দলই উত্তরবঙ্গের দিকে আলাদা করে নজর দিয়ে থাকে। তৃণমূল জমানায়, বিশেষত রাজ্যে বিজেপির উত্থানপর্বের পর লড়াই শুরু হয়েছে- উত্তরের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে।
কখনও মন্ত্রী দেওয়ার হিড়িক তো কখনও অনন্ত মহারাজকে নিয়ে টানাপোড়েন। এরই মধ্যে বড় দাবি করে বসলেন শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দুর ভবিষ্যদ্বাণী ২৬-এ উত্তরের আটটি জেলা মিলিয়ে নাকি মাত্র ২টো আসন পাবে তৃণমূল!
ঠিক কী বললেন শুভেন্দু?
সোমবার (১৯ মে), ঠিক যেদিন উত্তরবঙ্গ সফরে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়, সেদিনই তিরঙ্গা যাত্রায় সামিল হতে শিলিগুড়ি পৌঁছলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মমতা যখন শিল্প-বাণিজ্য বিষয়ক বৈঠকে একেবারে ‘কল্পতরু’ হয়ে উঠেছেন, বড় অঙ্কের সরকারি বিনিয়োগের ঘোষণা করেছেন, তখনই সংবাদমাধ্যমে শুভেন্দু বললেন, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে জেলাগুলি মিলিয়ে ৫৬টি আসন পাবে বিজেপি একাই, তৃণমূলের জুটবে মাত্র দুটি।
কোন দুটি আসন, সেটাও উল্লেখ করে দিলেন শুভেন্দু। তাঁর হিসেব বলছে, বর্তমান শাসক পাবে শুধু সিতাই আর চোপড়ার আসন। নন্দীগ্রামের বিধায়কের দাবি, উত্তরবঙ্গে কোনও উন্নয়নই হয়নি। না হয়েছে কোনও হাসপাতাল, না হয়েছে ভাল রাস্তা।
দুটি আসনেই বিগত নির্বাচনগুলিতে তৃণমূলের ফল ভাল
সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রে ২০২১ সালে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী জগদীশ চন্দ্র বসুনিয়া। পরে ২০২৪-এ তিনি লোকসভা ভোটে জয়ী হয়ে সাংসদ হওয়ার পর ওই কেন্দ্রে উপ নির্বাচন হয়। সেই ভোটে ফের জয়ী হয় তৃণমূল। বিধায়ক হন সঙ্গীতা রায়।
উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া বিধানসভা কেন্দ্রে ২০২১ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী হামিদুল রহমান। পরপর তিনবারের বিধায়ক তিনি।
গেরুয়া-ঘাঁটি পোক্ত ছিল উত্তরেই
২০১৯ সাল। অর্থাৎ যেবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৮টি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বঙ্গ বিজেপি, সেবার বেশিরভাগ আসনই ছিল উত্তরের। দার্জিলিং, কোচবিহার থেকে শুরু করে একেবারে মালদহ উত্তর পর্যন্ত পরপর উড়ছিল গেরুয়া পতাকা। নিশীথ প্রামাণিক, সুকান্ত মজুমদার, দেবশ্রী চৌধুরী, খগেন মুর্মুদের নাম একেবারে জ্বলজ্বল করছিল।
এমনকী ২০১৪ অর্থাৎ যে বছর প্রথম মোদী সরকার ক্ষমতায় এল, সেবার পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল বিজেপি, তার মধ্যেও একটি উত্তরের। দার্জিলিং থেকে সাংসদ হয়েছিলেন এসএস আলুওয়ালিয়া। অর্থাৎ বরাবরই বিজেপির ভিত উত্তরবঙ্গে বেশ মজবুত।
বারবার উত্তরকে মন্ত্রীও দিয়েছে বিজেপি
বাংলা থেকে সাংসদের সংখ্যা কম হলেও মন্ত্রিসভায় বারবার বাংলাকে জায়গা দিয়েছে বিজেপি। ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার ২০১৬-তেই বাংলা থেকে মন্ত্রী পদ পান এসএস আলুওয়ালিয়া। কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জায়গা পান তিনি। ২০১৯-এ বঙ্গ বিজেপির সাংসদ সংখ্যা বাড়ে। বাড়ে মন্ত্রীর সংখ্যাও। বিজেপির মরা গাঙে বাণ আনার পুরস্কার পেয়েছিল বঙ্গ বিজেপি। রাজ্য়ের চার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মধ্যে দুজনই ছিলেন উত্তরবঙ্গের। নিশীথ প্রামাণিক ও জন বার্লা। গুরুত্ব পায় চা বলয়। গুরুত্ব পায় রাজবংশী, গুরুত্ব পায় আদিবাসী সমাজের মানুষ।
নিশীথে ধাক্কা…
পাঁচ বছর পর আরও একটা নির্বাচন। ফল বেরতেই বোঝা গেল কোথাও যেন ছন্দপতন হয়েছে। যে নিশীথের দাপট ক্রমশ বাড়ছিল কোচবিহারে, তিনিই পরাজিত। নিশীথ প্রামাণিকের উপর ভরসা করে বিজেপি উত্তরে শুধু সংগঠন সাজাচ্ছিল তাই নয়, তাঁকে খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীও তথা খোদ অমিত শাহের ডেপুটি হিসেবেও কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
২০২৪-এ লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হলেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে যান তৃণমূলের জগদীশ বসুনিয়া। তবে দার্জিলিং থেকে মালদহ উত্তর পর্যন্ত সবকটি আসনই হাতে রেখেছে বিজেপি।
উত্তরের দলবদল
যে উত্তরবঙ্গের নেতা খোদ বঙ্গ বিজেপির সভাপতি, সেই উত্তরবঙ্গেও দলবদলের খেলা অব্যাহত। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী। কিন্তু ভোট মিটে যাওয়ার পর থেকেই ফুলবদলের জল্পনা জোরাল হচ্ছিল। গুঞ্জন শেষ হল, যখন ২৪-এ তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়লেন তিনি। লোকসভা ভোটে হেরে গেলেও উপ নির্বাচনে জিতে আপাতত তিনি বিধায়ক।
দলবদল করেছিলেন আর এক বিধায়ক সুমন কাঞ্জীলালও। একুশের বিধানসভা ভোটে আলিপুরদুয়ার কেন্দ্র থেকে তিনি বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরের টার্ম ফুরনোর আগেই বিজেপির সঙ্গ সখ্যতা ত্যাগ করে তৃণমূলে নাম লেখান।
এবার জন বার্লাও…
সদ্য গেরুয়া শিবির ছেড়ে ঘাসফুলে পা রাখলেন জন বার্লা। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মুখ জন বার্লাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্যন্ত করেছিল বিজেপি। কিন্তু ২৪-এর তাঁকে ফিরতে হয় খালি হাতে। টিকিটও পাননি তিনি। সেই থেকেই অসন্তোষের সুর শোনা যেত তাঁর গলায়। এমনকী জন বার্লাকে টিকিট না দেওয়ার পর থেকেই উত্তরে মাথাচাড়া দেয় বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। খোদ রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছিলেন তিনি। আর এবার সরাসরি তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন।
মনে রাখা দরকার, এই জন বার্লাই একসময় কার্যত বঙ্গভঙ্গের কথা তুলেছিলেন। পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবি তুলেছিলেন তিনি। যার জন্য তাঁকে সতর্ক করেছিল খোদ বিজেপি নেতৃত্ব। সেই জন বার্লাই এখন তৃণমূলে। তিনিই এবার বিজেপির গলার কাঁটা হয়ে উঠবেন না তো?
পাহাড়ের বর্তমান ছবিটা ঠিক কেমন
২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন ২০২১-এর ফলাফলের দিকে তাকাতেই হবে। ২০১১ সালের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল বারবার বলেছে, ‘পাহাড় হাসছে’। অথচ সেই পাহাড়ের আঁকেবাঁকে অনায়াসে পদ্মফুল ফুটিয়েছে বিজেপি।
২১-এর ফলাফলে দেখা যায়, দক্ষিণবঙ্গে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া বাদ দিলে আর কোথাও তেমন গেরুয়া প্রতিপত্তি নেই।
কোচবিহার জেলায় ৯ টার মধ্যে ৭টি বিধানসভা আসন পেয়েছিল বিজেপি।
আলিপুরদুয়ারে বিজেপির ফল ছিল ৫-এ ৫।
জলপাইগুড়িতে ৭ টার মধ্যে ৫টিই ছিল বিজেপির হাতে।
দার্জিলিং-এও ৫-এ ৫ ছিল বিজেপির স্কোর।
দুই দিনাজপুর মিলিয়ে ৬টি আসন পেয়েছিল বিজেপি।
মালদহে বিজেপির প্রাপ্তি ছিল ৪।
এবার উত্তরে কে দেবে উত্তর, কী বলছে তৃণমূল
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, “সিপিএমের সময় পাহাড়-ডুয়ার্স বঞ্চিত শোষিত ছিল। তৃণমূল উত্তরের জেলাগুলিতে বিশেষ নজর দিয়েছে। কৃষি পর্যটন ভিত্তিক শিল্প হচ্ছে। আয় বাড়ছে মানুষের। উত্তরবঙ্গ গ্লোবাল ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়েছে।” তাঁর দাবি, কাজ দিয়েই ভোট পেতে হয়। এবারও সেটাই হবে। তবে শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য গুরুত্ব দিতে নারাজ তিনি।
উত্তরের ভিত শক্ত বলেই ভরসা করে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন বিজেপি নেতারা? প্রশ্ন উঠছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাসক দলও নির্বাচনের আগে এমন কোনও চাল দিতে পারেন, যাতে ঘুরে যায় খেলা।