28/07/2025
#ইষ্টভৃতি_করতে_আমার_ভাল_লাগেনা
" আচ্ছা,- ইষ্টভৃতি করলে আমার জীবনে উন্নতি ও মঙ্গল কিভাবে সম্ভব?"
আজ ডিপি ওয়ার্কে গিয়ে এক গুরুভাইয়ের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। সেই গুরুভাইটি দীক্ষা নিয়েছিল অনেক বছর পূর্বে। কিন্তু ইষ্টভৃতি নিবেদন করা ছেড়ে দিয়েছে বহুদিন হল ।
জিজ্ঞেস করলাম,-" এতদিন ইষ্টভৃতি করে হঠাৎ ছেড়ে দিলে কেন?"
-" এমনিতেই। ইষ্টভৃতি করতে ভাল লাগেনা,- তাই।"
বেশ স্পষ্ট ও সহজভাবে ভাইটি উত্তর দিল।
আমার খুব ভাল লাগল তার এই স্পষ্ট সহজ কথা। কোন নাটকীয়তা ও জড়তা নেই।
আমি তাকে বললাম,-" আমার কোন কাজ করতে ভাল লাগেনা বলেই সেই কাজটা করব না,- তা ঠিক নয়। যে কাজটা করলে আমার জীবনে মঙ্গল নিশ্চিত, - ভাল না লাগলেও সেই কাজটা নিত্য পালন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। একেই সাধনা বলে।
অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা করতে ভাল লাগেনা, পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে পড়া মূখস্ত করতে ভাল লাগেনা। তবুও সবাই পড়ে, পরীক্ষাও দেয়। কারন এতেই যে ভবিষ্যতে মঙ্গল হবে,- সেটা তারা জানে।
ইঞ্জেকশন নিতে, বিস্বাদ ঔষধ খেতে কারো ভাল লাগেনা। কিন্তু রোগমুক্ত হতে সবাই ঔষধ খায়, ইঞ্জেকশন নেয়।
যারা পুলিশে বা মিলিটারিতে চাকরি করে,- তারা চাকরির শুরুতে কঠিন ট্রেনিং করে। অত্যন্ত কষ্টকর ও বিরক্তিকর এই ট্রেনিং। তবু তারা নিষ্ঠাসহকারে এই ট্রেনিং করে,- কারন এতেই তাদের শরীর যুদ্ধের উপযোগী হবে।
যারা সংগীত শেখে তারা ভোরবেলা উঠে রেওয়াজ করে। অত্যন্ত বিরক্তিজনক এই রেওয়াজ। ভোরের ঘুম নষ্ট হয়, একই বিরক্তিকর সুর ঘন্টার পর ঘন্টা সাধতে হয়,- তবুও তারা নিত্য রেওয়াজ করে। কারন,- তার ফলেই তারা একদিন সংগীতে দক্ষ হবে জানে।
সাধারণত: যে কাজ বা অভ্যাসগুলি মানুষের জীবনকে উর্ধমুখে নিয়ে যায়,- সেই কাজগুলো করতে মানুষের ভাল লাগেনা। এটাই নিয়ম।
আবার,- যে কাজ বা অভ্যাসগুলো মানুষের জীবনকে ধ্বংসমুখে নিয়ে যায়,- সেগুলো করতে খুব ভাল লাগে। যে মানুষটি আজকাল মদের নেশায় আসক্ত সে শুরুর দিন থেকেই মদ খেতে ভালবাসে। কেউ তাকে জোর করে মদ খেতে অভ্যস্ত করেনি। যে লোকটি বর্তমানে ঘুষ নেওয়ার অপরাধে জেল খাটছে,- তার ঘুষ খেতে কোনদিন খারাপ লাগেনি। যেসকল মানুষ পরকীয়ায় আসক্ত তাদেরও কোনদিন এই কাজে খারাপ লাগেনি। এইসব কাজের জন্য কাউকে যাজন করতে হয়না, বার বার ঘরে গিয়ে সাধাসাধি করতে হয়না।
উচ্চে অবস্থিত কোন জলের পাত্র থেকে জল নীচে ফেলতে হলে বল প্রয়োগ করতে হয়না। শুধুমাত্র জলের টেপটা ছেড়ে দিলেই হয়। কিন্তু নীচের কোন পাত্র থেকে জল উপরে তুলতে হলে মোটর পাম্প দিয়ে বল প্রয়োগ করতে হয়। জলকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে উপরে উঠাতে হয়। একই ব্যাপার ঘটে আমাদের জীবনেও।
তাই ইষ্টভৃতি করতে প্রথম প্রথম ভাল না লাগারই কথা। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের পকেটের টাকা বিনা স্বার্থে আরেকজনকে দিয়ে দিতে কেন ভাল লাগবে? তবুও ইষ্টভৃতি নিত্য করতে হয়,- যেহেতু তা গুরুর নির্দেশিত সাধনপদ্ধতি, যেহেতু এই ইষ্টভৃতি আমার জীবনে পরম মঙ্গল বয়ে আনে। "
এই কথার পরই সেই ভাইটি জিজ্ঞেস করল,-
"আচ্ছা,- ইষ্টভৃতি করলে আমার জীবনে উন্নতি ও মঙ্গল কিভাবে সম্ভব?"
আমি বললাম,-" ইষ্টভৃতি করলে মানুষের জীবনে মঙ্গল কিভাবে সম্ভব,- তা হয়ত তুমি বুঝতে পারছ না। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ, তাঁর কথা, তাঁর নির্দেশ পালন করে চললে যে মানুষের জীবনে মঙ্গল নিশ্চিত,- তা বুঝতে পারো তো?"
সে দৃঢ়তার সাথে বলল-" অবশ্যই। সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। "
" তাহলে তুমি শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ ও আদর্শ পালন করে তোমার জীবন পরিবর্তন করছ না কেন? ইষ্টভৃতি না করে তুমি শ্রীশ্রীঠাকুরের বানী-কথা-উপদেশগুলি পালন কর। তবেই তো হল। "
সে চুপ করে আছে। কোন যুতসই উত্তর হয়ত খুঁজে পাচ্ছে না। তাই আমি আবার বলতে শুরু করলাম,-
"শুধু নীতিবাক্য, উপদেশ ও বানী শ্রবন- পঠন কারো জীবন পরিচালিত করতে পারেনা, আমাদের জীবনচলনায় কোন পরিবর্তন আনতে পারেনা, - যদি'না সেই বানীকারক মহাপুরুষের প্রতি আমাদের সক্রিয় ভালবাসা ও টান থাকে।
সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা " ধূমপান ক্যান্সারের কারন" সতর্কবার্তাটি লক্ষ করে কোন ধূমপানে আসক্ত ব্যাক্তি ধূম্রপানের কুঅভ্যাস বর্জন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। বরং যারাই দীর্ঘদিনের ধূমপানের অভ্যাস বর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে তাদের কোন প্রিয় ভালবাসার মানুষ, যেমন মা- বাবা- স্ত্রী- প্রেমিকা- বন্ধু- শুভানুধ্যায়ী, তাদের কথায়, তাদের অভিমানের কারনেই এই কুঅভ্যাস বর্জন করেছে।
পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুরের হাজার-হাজার বানী -উপদেশ দেওয়া আছে আমাদের বাঁচা- বাড়ার জন্য। কিন্তু সেইসব বানী-উপদেশ আমাদের জীবনে কোন কাজেই লাগেনা যদি না তাঁর প্রতি আমার সক্রিয় ভালবাসা ও টান জন্মায়। কিন্তু যখন আমি তাঁর দীক্ষা নেই,- সেই মুহুর্তে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আমার কাছে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত অজ্ঞাত ব্যাক্তি। আমি তাঁকে কিভাবে ভালবাসব, তাঁর প্রতি টান কিভাবে সৃষ্টি হবে,- আর আমি তাঁর কথা কেনই বা মেনে চলব? সেই টান ও ভালবাসা জন্মানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় দীক্ষান্তে ইষ্টভৃতি পালনের মধ্য দিয়ে। প্রতিদিন প্রত্যুষে আমার গুরু, আমার প্রিয়পরমের ভোগের জন্য প্রত্যাশাহীন নিষ্ঠানন্দিত অর্ঘ্য নিবেদনই হল ইষ্টভৃতি।
মনোবিজ্ঞান অনুসারে আমি যখন কারো জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করি তখন সেই করার ফলস্বরূপ সেই ব্যাক্তিটি আমায় ভালবাসবে কিনা তা নিশ্চিত নয়,- কিন্তু সেই ব্যাক্তিটির প্রতি আমার ভালবাসা জন্মিয়ে যায়,- তা নিশ্চিত। যার জন্য আমার করা যত বেশী,- তার প্রতি আমার ভালবাসা - টান ও তত বেশী। রাস্তার একটি অপরিচিত কুকুরকে যদি আমি রোজ একটি বিস্কিট খেতে দেই,- তাহলে সেই কুকুরটির প্রতিও আমার টান সৃষ্টি হয়ে যায়। হঠাৎ কোন একদিন যদি কুকুরটিকে দেখতে না পাই,- তবে মন খারাপ হয়ে যায়।
রাতে বাচ্ছা ছেলেটি যখন জ্বরে আক্রান্ত তখন মা ঘুমাতে পারে না,- সারা রাত জেগে ছেলের সেবা- শুশ্রুষা করতে থাকে। যদি ও বাবা কোন কোন সময় ঘুমিয়ে পড়ে- মা কিন্তু ঘুমাতে পারেনা। কারন, ছেলের জন্য বাবার চেয়ে মা'র করা অনেক বেশী। দশ মাস গর্ভে ধারন করেছেন, প্রসব বেদনা সহ্য করে জন্ম দিয়েছেন, রাতে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে বারে বারে দুধ দিয়েছেন কত কি!!! তাই ছেলের প্রতি মা'র টান অনেক বেশী। তাই কথায় বলে " কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কভু নয়।"
সাধারনতঃ আমাদের মত জাগতিক- সাংসারিক মানুষদের কাছে অর্থই হল সর্বাধিক প্রিয় বস্তু। দীক্ষান্তে যখন আমি আমার সেই কষ্টার্জিত, সর্বাধিক প্রিয় অর্থ থেকে সামান্য কিছু অংশ প্রতিদিন প্রত্যুষে প্রত্যাশাহীনভাবে-ভক্তিভরে আমার গুরুর ভোগের জন্য নিবেদন করতে থাকি তখন অজান্তেই ধীরে ধীরে গুরুর প্রতি আমার ভালবাসা জন্মাতে শুরু করে। তাঁর প্রতি টান জন্মায়। তাঁর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হলে তখন ইচ্ছে হয় তাঁকে জানার, তাঁর কথা শুনার। তাঁর প্রতি সৃষ্ট টান আমায় প্ররোচিত করে নিজের জীবনচলনাকে তাঁর ইচ্ছানুসারে পরিচালিত করতে,- শুরু হয় বাঁচা- বাড়ার উদ্দেশ্যে আমার পথচলা। তাই দীক্ষান্তে ইষ্টভৃতি এত আবশ্যক এবং অবশ্যকরনীয় প্রক্রিয়া। ইষ্টভৃতিই আমাদের মনে দীক্ষাকে চেতন রাখে। নতুবা দীক্ষা নেওয়াই সার,- আমার জীবনে তার কোন প্রভাব ফেলে না। "
সে আমার কথাগুলো কতটুকু বুঝতে পারল জানিনা। কিছু কথা বলছে না।
আমি আবার বললাম-
" গুরুর সকল নির্দেশের কার্যকারণ বুঝার মত IQ তথা বুদ্ধিমত্তা শিষ্যের থাকেনা। থাকেনা বলেই আমি শিষ্য,- তিনি গুরু।
ছোটবেলায় স্কুলে আলোর গতিবেগ মূখস্ত করেছি, সৌরজগতের গঠন পড়েছি, অংকের কত সূত্র মূখস্ত করেছি। কোন কার্যকারণ না জেনেই মূখস্ত করেছি। যদি তখন শিক্ষককে জিজ্ঞেস করতাম,- " স্যার,- আলোর গতিবেগ যে সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, - তা আমায় প্রমান করে দেখান। তা নাহলে আমি তা মানব না।"
তবে কি আমার আর পড়াশোনা হত?
যদি শচীন তেন্ডুলকর ছোটবেলায় তার কোচকে বলত,-" ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে দাঁড়িয়ে একইভাবে ব্যাট করা আমার ভাল লাগেনা। কি লাভ হবে তাতে?" তাহলে কি তেন্ডুলকর ক্রিকেটের ভগবান হয়ে উঠতেন?
তাই শাস্ত্র বলে,- গুরুর কাছে নিজেকে সমর্পন করতে হয়, সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভর করতে হয়। গুরুর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য নিয়ে চলতে হয়।"
তবেই গুরুর দীক্ষা নিয়ে আমার জীবনে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগা সম্ভব। আমার জীবন উর্ধগামী হওয়া সম্ভব।
প্রশ্ন করে, যুক্তি দিয়ে, বই পড়ে ধর্ম হয়না। " ধর্ম অনুভূতির উপর।" করতে করতেই অবুভূতি জন্মায়। "
********************
ডা: রাজেশ চৌধুরী
আগরতলা
২৭-০৭-২৫