
22/08/2025
আচার্য্য-সান্নিধ্যে/৩৫
(ইং ০৬-০১-২০২৪)
আর এক প্রসঙ্গে বলছেন—একটা মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি থাকতে হবে, সেইসাথে পরিবেশে প্রভাব থাকতে হবে। তা না হলে তার দ্বারা বেশী কিছু করা সম্ভব না। যেমন—(এক ডাক্তারের নাম করে)এম-বি-এস পাশ, ডাক্তার স্বপনদাও (স্বপনকুমার বিশ্বাস)এম-ডি--, উনি (ঐ ব্যক্তি)চেম্বার খুলে বসলেও ওনার কাছে রোগী যাবে না, কিন্তু স্বপনদার কাছে যাবে। পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রভাব বিস্তার ঘটেছে স্বপনদার করা, চলা, ব্যবহারের মধ্য দিয়ে, যা ওনার নেই। আবার এই প্রভাব ক্ষণিকের অতিথি হ’লে হবে না, যেমন—একজন গায়ক স্টেজে ভাল ভাল গান করল, হাততালি পড়ল, যেই স্টেজ থেকে নেমে এল, জিজ্ঞেস করবে, কে গান করছিল রে?
এদিন সন্ধ্যায় ফিলানথ্রপি সমুখস্থ মণ্ডপে বসে এক শোকাক্রান্ত ব্যক্তিকে বলছিলেন—জীবন যেমন স্বাভাবিক ঘটনা, মরণও তেমনই। আমি অনেক ক’রে দেখেছি, যে চ’লে যায়, তার আর এ দুনিয়া সম্পর্কে কোন মোহ থাকে না, সে সব ভুলে যায়। আর, আমরা অহেতুক তাকে নিয়ে ভাবি, তার দেহটাকে খুঁজি। কিন্তু তার এ-জগতের কোন স্মৃতি থাকে না। সে হয়তো অন্য কোন স্থানে জন্মেছে।
আরও বলছেন—শরীর খারাপ হলেই বা ঘাবড়ানোর কী আছে! আবার অন্য শরীর নিয়ে আসব!
(ইং ০৭-০১-২০২৪)
প্রাতে প্রার্থনান্তে আচার্য্যদেব বড়নাটমণ্ডপে বসে আমাদের মধ্যে নানা আলাপ করছেন।
প্রসঙ্গ তুলে নান্টুদা নামে একদাদার কথায় আচার্য্যদেব বলছেন—ইঞ্জিনিয়ার নান্টুদা খুব সিগারেট খেতেন—একটার পর একটা, বড়দার(শ্রীশ্রীবড়দা)বলায় এক কথায় ছেড়ে দেন। আবার উনি খুব লঙ্কা খেতেন—আমার কানে যেতে একদিন বললাম, এত লঙ্কা খাওয়া তো শরীরের পক্ষে ভাল না, পেটে আলসার হবে। এই এক কথায় তিনি লঙ্কা খাওয়া ছেড়ে দেন। একই আবেগে দাদুর কথায় আবার সেই একই আবেগে নাতির কথায় অত দিনের অভ্যাস ছেড়ে দিলেন। এটা অন্তরে গভীর প্রেম না থাকলে হয় না। আর, গভীর প্রেমে মানুষ সবকিছু পারে।
(ইং ০৮-০১-২০২৪)
প্রাতে প্রার্থনান্তে আচার্য্যদেব বড়নাটমণ্ডপে বসে আমাদের মধ্যে নানা আলাপ করছেন।
প্রসঙ্গ ওঠে দুজনের মধ্যে মতবিরোধ দীর্ঘস্থায়ী করার বেকুবী সম্পর্কে, বলছেন—১৯৮২ সালে আপনার আমার ঝগড়া হয়েছিল, জমি নিয়ে শুরু হয়েছে, তারপর ভয়ংকর বিবাদ হয়েছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছে। আজ ২০২৪ সাল, এতদিন ধরে আপনার আমার সম্পর্কের যে ভাবটা সেটা ১৯৮২ সালের ক্যালেণ্ডারেই টাঙানো। আর এটাই হচ্ছে আমার ভবিতব্য। কী দরকার! আমি ছেড়ে দিই না! আগের মুহূ্র্তে হয়েছে, পরের মুহূর্ত্তে ছেড়ে দিই না! এভাবে proceed করতে পারি।
আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন একটা incident হয়, সেই incident-এর পরে এক প্রিয়জনের প্রতি আমার খুব অভিমান হয়। আমি সেই প্রিয়জনের সাথে এক বছর কথা বলিনি।---
আমার এইরকম অদ্ভূত অদ্ভূত শিক্ষা হয়েছে। আমি আর আমার দিদি ছিলাম কলকাতার বাড়িতে, পিসি ছিল। পিসি আর দিদির মধ্যে কোন একটা কারণে খুচুরখুচুর লাগল, হতেই পারে! তো, দিদি বলল আমি আর খাব না। তুই কি করবি? বললাম, আমিও খাব না। (সহাস্যে) তারপর কৌটোতে চিড়েভাজা ছিল, সেটা নিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলাম। অনশন ধর্ম্মঘট তো! না খেয়ে থাকা! ওর তো ব্যাটা রাগ হয়েছে, অনশন করতে পারবে, আমার তো ততটা রাগ হয়নি, আমি কী করে অনশন করব! তাই আগে চুপচাপ চিড়েভাজাটা ঢুকিয়ে রাখলাম। ওখান থেকে মাঝে মাঝে খাব। (হেসে) এটা আজ অব্দি আমি দিদিকে বলিনি, এবার বলব কিনা ভাবছি, যে দ্যাখ্, তুই সেদিন অনশনটা করেছিলি, আর আমি চিড়েভাজা আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে মাঝে মাঝে খেয়েছিলাম।
কাহিনিটি ব্যক্ত করে বলছেন—এক সময় যেটা serious, পরে সেটাই হাসির হয়ে যায়।
প্রসঙ্গান্তরে বলছেন—একদিন দেখছি একটা ন্যাকড়া দিয়ে সাইকেল মুছছে। যেটা দিয়ে মুছছে সেটা একটা জামা। জামাটা মলিন, কোথাও কোথাও ছেঁড়া। সাইকেল মোছাটা একটা দৃশ্য। কিন্তু আমার মনটা কিন্তু সাইকেলে না, আমার মনটা জামায়। জামাটা যেদিন কেনা হয়েছিল আর যে আবেগ নিয়ে কেনা হয়েছিল, এটা অমুক দিন পরব ব’লে যতটা মহান আবেগ বেরিয়েছিল, আজ তার এই দশা! তাহলে সময় এই মহার্ঘ্যকেও নগন্য করে দেয়। যে ঝগড়া আমার আজকে মনে হল সাংঘাতিক জিনিস, পরে সেটাই একটা হাসিঠাট্টার জিনিস হয়ে যায়। আর, আমরা জীবনটাকে কিছু কিছু জায়গায় এমন serious mood-এ রেখে দিই! যেটা নিয়ে আমি হাঁকপাক করছিলাম। আমি শুনলাম একটা মোবাইল দেড় লাখ টাকা দাম, খুব যোগাড়যন্ত্র করে দেড় লাখ টাকা সংগ্রহ করে কিনলাম। এবার পাশে একজন এসে একটা মোবাইল রাখল, তারটা দু লাখ চল্লিশ হাজার টাকা দাম। তখন আমি আমার মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম।
গুছিয়ে গুছিয়ে একটা বিশাল সুন্দর বাড়ি বানালাম। সবাইকে দেখাচ্ছি। দেখানো হ’য়ে গেল, তারপর কি নিয়ে থাকবে! এতদিন বাড়ি! বাড়ি! বাড়ি!
কতলোক আছে জীবনের একটা বিশাল সময় সুন্দর করে রান্না করছে, কিন্তু অন্য কাউকে খাওয়াচ্ছে না, নিজেই এবং বাড়ির লোকে খাচ্ছে। তাহলে তোর এত প্রতিভা তুই কী কাজে লাগাচ্ছিস্! জিনিসটা যখন কোন মানুষের সম্বর্দ্ধনায় লাগল না! আমি অঢেল পড়াশুনা করলাম, জীবনে কোন কাজে লাগালাম না। তাহলে কী হল! আমি যদি এরকম করে ভাবি তাহলে ওনার (একজনের নাম করে) পড়াশুনাটা বোঝা ছিল। কোন কাজেই লাগল না। আবার একজনের নাম করে বললেন, ওনারও পড়াশোনা হল, কিন্তু কোন কাজে লাগল না।
এভাবে মনের গহন কন্দরের কত যে আত্মবিশ্লেষাণাত্মক ধরণ নিয়ে আলাপ করে চলেন!
আজ আমিও তাঁকে কয়েকটি বিষয় প্রসঙ্গতঃ বলতে সক্ষম হই। আমার ভাইপো কৃতিসুন্দরের মুখে শোনা একটি বিষয়—এক দীক্ষিত পরিবার খুচরো পয়সায় ইষ্টভৃতি অর্ঘ্য মন্দিরে জমা করতে এলে তাকে বলা হয় খুচরো পয়সা নেওয়া হবে না। ফলে সে সেই অর্ঘ্য ঠাকুর-প্রণামী বাক্সে দিয়েছে এবং পরবর্ত্তীতে ইষ্টভৃতি করা বন্ধ করে দিয়েছে। ডি-পি ওয়ার্কের প্রেক্ষিতে তাদের বাড়িতে গিয়ে এই বিষয় জেনে তাকে বুঝিয়ে বলায় আবার ইষ্টভৃতি করা শুরু করেছে।
শুনে আচার্য্যদেব বললেন—ঐ কথাটাই বুঝিয়ে যদি বলত, খুচরো পোস্টাফিসে, ব্যাঙ্কে তো নিতে চায় না! তখন সেই বলত, আচ্ছা দেখি কী করা যায়। আমাদের ব্যবহার, কথা বলার উপর সবটা নির্ভর করছে।
আমি আরও বলি, আমাদের গ্রামে একটি ক্লাব ছিল, এক সময় তাদের মধ্যে কয়েকজন যুবক দীক্ষা নেয়, পরে ঠাকুরবাড়ি এসে আনন্দবাজারে কী অসুবিধা হয়, বিগড়ে গিয়ে আর কিছু করে না।
এ-ব্যাপারেও তিনি ব্যবহার ঠিক করার প্রতি বললেন। আরো বললেন—দু-দিন আগে আমাকে কিছু বলতে গিয়ে একজন ‘বাবাইদা’ বলে সম্বোধন করেছে। তো, আমাদের এখানের কেউ বলছে, আপনি ‘বাবাইদা’ বললেন কেন? ‘আচার্য্যদেব’ বলতে হয়। তখন সে বলে, আমি কি বলব, সেটা আপনাকে শিখিয়ে দিতে হবে! আমার অন্তর যা বলে তা বলতে পারব না? আপনার কাছ থেকে জ্ঞান নিতে হবে? এ-কথাটা আমার কানে যেতে আমি তাকে বললাম, আপনার আমাকে যা বলতে ইচ্ছা করে তাই বলবেন। আপনার অন্তরের কথাটাই বলবেন। এই যে আমি বললাম, উনি শান্ত হয়ে গেলেন। তো, কাকে জ্ঞান দেওয়া যায়, না-যায়, সেটা তো বোধে রাখতে হবে! সবাই তো জ্ঞানটা নেওয়ার মানসিকতায় থাকবে না। আমরা যারা আশ্রমে থাকি, তাদের এ-দিকটা ঠিক রাখতে হয়।
আমি আরো বলি, আজ্ঞে কখনও কখনও পিছলে যায়, বেখাপ্পা হতে যায়, যেমন— সেদিন আপনি ঠাকুরবাড়ি আসছেন—একদল লোক মোবাইলে ফটো তুলতে ব্যস্ত, সতর্ক থাকছেন না। আমি তাদের বলতে গিয়ে দেখলাম গলার স্বরটা রাগতভাবে বেরোচ্ছে। আমি সাথে সাথে সজাগ হয়ে সামলে নিলাম। কিন্তু বুঝলাম আমার বলাটা আর একটু সুষ্ঠু হওয়া দরকার।
তিনি অপর ঘটনায় বলছেন—সেদিন দেখি এখানে (ঠাকুরবাড়িতে) যে চটটট পাতে, রেডী করে, সে একা অত বড় চটটা পাতছে। আর পাশেই একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে তাড়া দিতে বললাম, ‘অ্যাই! দেখছ না! অত বড় চটটা একা পাতছে, হাত লাগাতে পার না?’ তো, অনেক সময় কাজটায় গতি আনতে এ-ভাবে বলতে হয়। আমি তারপর ঠাকুরঘরে প্রণাম করছি, তখন ঠাকুরকে বলছি, ঠাকুর! ওকে কাজটাতে push দিতে গিয়ে আমি এ-রকম করে বললাম। তো, অনেক সময় একটু শক্ত করে বললে কাজ হয়। বলতে হয়। তবে আশ্রমে যারা থাকে, বিশেষ করে যাদের আবেষ্টনীতে ঠাকুরবাড়ি, এই এরিয়া, তাদের ব্যবহারে সূক্ষ্মতা, নম্রতা থাকতে হবে। একজন দারোয়ান উল্টাপাল্টা কিছু বললে মনে কিছু করবে না, তাচ্ছিল্য করবে, ও ব্যাটা দারোয়ান! ও আর কী বলবে! কিন্তু আমাদের মত কেউ বললে সেটাতে mind করবে।
একজন বললেন—অনেক সময় দারোয়ানরা যে কাজটা করা দরকার, সেটা করবে না, যেটা দরকার নাই সেটা হয়তো করল।
আচার্য্যদেব—সে হতে পারে। সে তার বোধের আওতায় এ-সব করতে পারে। কারণ, তার তো income-টা দরকার। সময় গেলে টাকাটা পাবে। তার বাইরে তো তার কোন interest নাই।
অপর এক প্রসঙ্গে তিনি বললেন—একজন আমাকে বলেছিলেন, আমার ওনার প্রতি একটু softness ছিল, আমি তাকে বললাম, আপনি ঠাকুরকে ধরেছিলেন, না তাকে ধরেছিলেন? ঠাকুরকে বাদ দিয়ে তাকে ধরতে গেছলেন! আমি তো ঠাকুরকেই ধরেছি, আমি তো বড়মা(শ্রীশ্রীবড়মা)-কে, বড়দা(শ্রীশ্রীবড়দা)-কে ধরতে যাইনি। আমি ঠাকুরকেই ধরেছি, আর তিনি বলেছেন—বড়দাকে মাথায় নিয়ে চলতে, তাই আমি বড়দাকে নিয়ে চলছি। তাঁর বলার জন্যে। অন্যে কে কি বলল আমি দেখতে যাব? আমি নিজের জিভ দিয়েই চাটনি খাব, অন্যের জিভ দিয়ে কেন খেতে যাব?
একদল লোক আমার কথা বলে এমন উপরে তোলে, ‘বাবাইদা এই’, ‘বাবইদা ঐ’। তারা এখন আমাকে নিয়ে করছে, আবার আমার ছেলেকে, নাতিকে নিয়েও করবে। তাদের তো একটা কোন কেন্দ্র নাই! তারা এভাবে একজনকে উপরে তু’লে সেই বিষয়ের ভগবান হয়ে দাঁড়াবে। সে হবে যীশু, আর ভগবান আকাশে থাকবেন—আর আমজনতা Son of God বলবে None can come to the Father, but through me, এই পরিণতি দাঁড়াবে।
আবেগের সাথে কত কথা বললেন! বলছেন—আমাকে যে প্রণামী দেয় আমি এক পয়সাও নিই নি। এত জিনিস দেয়, একটা টুকরোও আমার ঘরে ঢোকাই নি। আজ আমি মাটিতে বসি, কাল ঐ ঘাসে বসতে হলেও আমার কোন অসুবিধা নাই। আবার অন্য কোথাও থাকলে তাতেও আমার কিছু যায়-আসে না।
তিনি কত যে সহজ হয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করেন! তাঁর কথা বলার তোড়ে কখনও এমন উপমা ব্যবহৃত হয় যে মনে পুলক জাগায়। আজ তেমনই তাঁর একটি প্রসঙ্গ তুলে এক সময় বলি—আজ্ঞে, আপনার কথার মধ্যে ছোট ছোট উপমা, উদাহরণ এমন ভাবে প্রয়োগ হয় যে মনে দাগ কাটে। যেমন একটু আগে বললেন—চাটনী নিজের জিভ দিয়ে চেটে খাব, অন্যের জিভ দিয়ে কেন খেতে যাব! আবার গতকাল এক দম্পতির মধ্যে মনোমালিন্যের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বরটিকে বলছেন—গোলাপের কাঁটাসুদ্ধ ফুল নিয়ে গিয়ে বৌকে দেবে, তাতে সে নিতে গিয়ে হয়তো কাঁটাতে হাত পড়ে রক্ত বের হল, তখন সেই রক্ত বন্ধ করতে গিয়ে একটু ছোঁয়াও হ’য়ে গেল। এইভাবে একটু ছোঁয়া থেকে প্রেম হ’য়ে যাবে। এই উপমাগুলো এত রসাত্মক! এত উপভোগ্য।
এতে তিনি বললেন—এগুলো কী আমি বলি! আমি যে সারাদিন এত কথা বলি, আমার মধ্য দিয়ে ঠাকুরই বলান—আমি সেই মাইকের চোঙটা। আমার কী ক্ষমতা যে বলব! কথা বলতে বলতে তিনি আমার মুখে যা জোগান দেন তাই বলি। গোলাপের কাঁটা নিয়ে কথাটা আসল এভাবে, কালকেই আমাকে একজন গোলাপটা দিলে আমি ভাবলাম এরকম তো হতে পারে।
✒️সুভাষ মুষিব।