20/05/2025
আচার্য্য-সান্নিধ্যে/৫৩
১১ই ফাল্গুন, ১৪৩০, শনিবার(ইং ২৪-০২-২০২৪)
প্রাতে প্রার্থনান্তে অন্যদিনের মতো আচার্য্যদেব বড়নাটমণ্ডপে। কথায় কথায় তিনি নিজেই বলছেন—কাল(গতকাল সন্ধ্যায় ফিলানথ্রপি-সমুখস্থ মণ্ডপে বসে)একটা অদ্ভূত ভাল কথা বেরিয়ে এল। ঠাকুরের দয়ায় এক-এক সময় এমন এসে যায়। বলছি, ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর, তার মধ্যে কালো বেড়ালকে খুঁজে পেতে হলে একটুকরো ছানাই যথেষ্ট। ছানার লোভে সেই বিড়াল আপনি হাতের কাছে এসে যাবে।
বলছেন—আমি বলার আনন্দে যা মনে আসে বলে যাই, কখনও ভেবে বলি না। তাতে যা আসার এসে যায়।
আবেগসহ বলছেন—ঠাকুরের কাজে পূতও (পবিত্র) চাই, পুতিও (দুর্গন্ধযুক্ত বা অপাঙতেয়ও)চাই। পুতিরও কাজ আছে ঠাকুরের দুনিয়ায়। পাকের মধ্যেই পদ্ম ফোটে, পদ্ম পাককে উপভোগ করে, তেমনি সংসারে, পরিবেশে চলার ক্ষেত্রে খারাপগুলোকে উপভোগের সামগ্রী করে নিয়ে বাঁচার, বৃদ্ধির সহায়ক করে নিতে হবে।
মানসিক চিন্তাধারার যথার্থতায় সব সুন্দরে পর্য্যবসিত হয়। খালি অন্যের বিষয়ে নাক গলানো রকমটা বাদ দিয়ে নিজেকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তাঁর পূজার উপযোগী করে তোলা।
এক মা কাতরভাব নিয়ে জানালেন—স্বামী দীক্ষা নেন নি।
আচার্য্যদেব—তাতে অশান্তি কিসের? তিনি ওতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন!এক্ষেত্রে উপদেশ না দিয়ে নিজের করা দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করা। তাতেই তিনি ক্রমে নত হবেন।
আচার্য্যদেব তাঁর নিজের কথায় বলছেন—আমি বাইরে যেখানে গেছি, স্কুল, কলেজে পড়েছি, কিছুদিন আগে সিমলা গিয়ে কয়েকদিন থেকে এলাম, কখনও কোথাও আমার পরিচয় দিইনি, ঠাকুরের বংশধর বা সৎসঙ্গী কিছু। আমার ব্যবহার দিয়ে এমন মুগ্ধ করেছি যে তারা খুঁজে বের করেছে আমার পরিচয়। ঠাকুরময় হয়ে থাকলে তার চেহারায় একটা glaze বের হবেই। মানুষ দেখেই ধরে ফেলবে।
পরে আত্মবিশ্লেষণী সূক্ষতার একটি ঘটনা বলছেন—কাল খেতে বসেছি, আমি ভেবেছি মিষ্টিটা খাব না, extra calories কেন শরীরে ঢোকাব! কিন্তু মিষ্টির প্রতি আমার একটা লোভ আছে। তো, অবিনের মা বলল, একটা মিষ্টি খাও। খাও বলতে আমার না-খাওয়ার সিদ্ধান্তটা লোভের কাছে পরাস্ত হতে চলছে, আমি কিছু বলছি না, লোভের আওতায় থেকে যুক্তি সাজাচ্ছি, ‘বলছে যখন, নিমরাজী হয়েও কষ্ট করে খেয়ে নেব’ এই ভাব। তারপর দেখা গেল, already মিষ্টি পরিবেশন করা হয়ে গেছে (আরও যারা খাচ্ছিলেন তাদের দেওয়া হয়েছে),আর মিষ্টি নেই। তখন ভাবলাম, যাক্ এভাবে ঠাকুর আমার না-খাওয়াটাকে বজায় রাখলেন। খেতে হল না।(সহাস্যে)আমাকে ঠাকুরের মতন অড়হর গাছের গোড়া ধরে পড়ে থাকতে হল না। ভাবলাম, এটা ঠাকুরের দয়া আমার উপর।
পরে অপর এক মা অভিযোগের সুরে জানালেন স্বামী দীক্ষা নেননি, আবার বাপ আর ছেলের সাথে একটা বিষয় নিয়ে মনান্তর।
সব শুনে আচার্য্যদেব মা-টিকে ধমকের সাথে বলছেন—আপনি বড্ড নাক গলান সব কিছুতে! সে যদি দীক্ষা না নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে আপনার অসুবিধা কোথায়! দীক্ষা না নিয়ে তার তো কোন ঝামেলা হচ্ছে না! ঝামেলাটা আপনার। তাহলে সর্বাগ্রে আপনার মানসিকতার পরিবর্ত্তন করেন, আপনি নিজে ঠিকমত চলেন, তা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রেরণা পেয়ে তার যাতে দীক্ষা নেওয়ার আগ্রহ জন্মে। ব্যাপারটা আপনার চলার উপর নির্ভর করছে। আর, ছেলে বাপের মধ্যে যে ব্যাপারটা, সেটা তাদেরই বুঝতে দিন, আপনি ওর মধ্যে ঢুকছেন কেন? ছেলে বাবাকে ভালবাসে না?
বিষয়টি প্রাঞ্জল করতে নিজের এক কাহিনি বলছেন, বাবা (শ্রীশ্রীদাদা)যখন দুর্গাপুর মিশন হাসপাতালে ভর্ত্তি ছিলেন(অসুস্থাবস্থায়),আমি ওখানের একটা ঘর দখল করে নিয়ে সেখানে ছিলাম, তো, দেখলাম সেই রুমের বেসিনের পাইপটা ক্রটিপূর্ণ, মাঝে-মাঝেই jam হয়ে যায়, আমি সেটাকে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করতাম। আমি দেখলাম, এই যে পাইপটা jam হয়, সেটা আমার problem, পাইপটার কোন problem নয়। আমারই মাথাব্যথা jam হলে সেটা পরিষ্কার করার। সেরকম আপনারই মনের যে জটিলতা সেটাকেই আগে suff করেন, তাহলেই কোন অসুবিধা নাই। সব ঠিক।
মা-টিকে উদ্বুদ্ধপ্রাণতায় সাথে আবারও বলছেন, আপনার বিপদটা নিয়ে যদি আপনিই ভাবেন, তাহলে ঠাকুরের আর ভাবার কোন প্রয়োজন থাকে না। তাঁকে ভাবতে দিন আপনারটা, আর আপনি তাঁরটা নিয়ে ভাবতে থাকুন। একটা জায়গায় কোন জিনিস আছে, সেটাকে না সরালে সেখানে অন্যটা রাখা যাবে?
প্রসঙ্গ পরিবর্ত্তনে বলছেন—পাণ্ডব গৌরব নাটকে শ্রীকৃষ্ণ-সম্পর্কে ভীমের উক্তি, ‘অতি ছল, অতি খল অতীব কুটীল’ মানে এক কথায় বেহায়া। তো, বেহায়াকে আর কিভাবে অপমান করা যায়!
যেমন, ঠাকুরকে হেমকবি বলছেন তার মদ ছাড়ার ব্যাপারে। ঠাকুর তাকে মদ ছাড়তে বারণ না করে বরং নিজের হাতে মদ খেতে দিয়ে এমন করলেন যে হেমকবি মদ ছাড়তে বাধ্য হলেন। তাই তিনি বলছেন—ঠাকুর! আপনি যে এত চতুর, তা বোঝা যায় না। আমাকে আশ্রয়ের সাথে প্রশ্রয় দিয়ে এমনটা করলেন যা দুনিয়ার কেউ দেয় না!
অপর প্রসঙ্গে আচার্য্যদেব বলছেন—আমি একটা সূত্র বের করেছি, সেটা হচ্ছে অনুরাগের সময় ‘তুমি তুমি’ করা, আর বীতরাগের সময় ‘আমি আমি’ করা। তাহলেই আর জটিলতা হয় না।
তিনি প্রেমের সংজ্ঞা হিসাবে আমাদের প্রতি বললেন—তুমিত্বে বা তাহাত্বে তীব্র, অপ্রত্যাশী আকর্ষণের মোলায়েম প্রকাশ হচ্ছে প্রেম।
একটি লক্ষ্যণীয় বিষয়, সেদিন তিনি কিছুটা ক্ষোভের সাথে বলছিলেন—আমাকে মানুষ ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতন ব্যবহার করে, যখন ইচ্ছা হল হাতটা মুছে নিল।
তার একটি নজির দেখলাম, এদিন বেলা নটার দিকে বড়নাটমণ্ডপে সমবেত নামজপের ঠিক কয়েক সেকেণ্ড আগে এক দাদা তার কি একটা নিবেদন জানালে তিনি বললেন, শুনে খুশি হলাম।
প্রশ্ন আসে—পরিস্থিতি না বুঝে যখন-তখন নিবেদন কি তাঁকে যথার্থই খুশি করার বিষয়?