21/07/2021
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। সারা পৃথিবী তছনছ হয়ে যাচ্ছে গোলাগুলির দাপটে এবং তার জন্য সিংহভাগ দায়ী পৃথিবীর সবথেকে বড় ভিলেইন, হিটলার৷ বিপরীতে অ্যালাইজের মূলত তিনটি দেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে ঠ্যাকনা দেওয়ার, ইংল্যান্ড, রাশিয়া এবং আমেরিকা। অন্যদিকে জার্মানিও একা নয়, তাদের সঙ্গে আছে জাপান, যাদের নৌবাহিনী অসম্ভব শক্তিশালী। আস্তে আস্তে হিটলারের দল জয়ের দিকে এগোচ্ছিল। কিছুতেই তাকে আটকানো সম্ভব হচ্ছিল না বাকিদের৷
এই সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল গুপ্তচর। যারা খবর এনে দেবে বিরুদ্ধপক্ষের পরবর্তী চাল কী। কোথায় হবে পরের অ্যাটাক যাতে সেইমত প্রস্তুত থাকা যায়। এখানেও এগিয়ে জার্মানী। তাদের কাছে আছে এক অদ্ভুত যন্ত্র, নাম 'এনিগমা মেশিন'। যা জার্মানদের সমস্ত ইনফরমেশন এনক্রিপ্টেড করে দেয়। অর্থাৎ এক বিশেষ পদ্ধতিতে আসল ইনফরমেশনটাকে বদলে দেওয়া যাতে যারা সেই পদ্ধতি জানে না, তাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব৷ উদাহরণ দিচ্ছি৷
ধরুন আপনি ঠিক করলেন, একটা ইংরেজি শব্দের প্রতিটি অক্ষর যা, আপনি তার তিনটে অক্ষর পরেরটা লিখবেন৷ মানে A থাকলে তা হয়ে যাবে D। এবার ধরুন শব্দটা হল CAT। তাহলে সেটা লেখা হবে FDW। DOG হয়ে যাবে GRZ। আপাত দৃষ্টিতে এই শব্দগুলো অর্থহীন। একেই বলে এনক্রিপশন। যা অ্যালাইজ দেশগুলির পক্ষে ভাঙা সম্ভব হচ্ছিল না।
এমন সময়েই একজন পাগলাটে গোছের লোক এল ইংল্যান্ডের আর্মির ইনটেলিজেন্স দপ্তরে৷ সেখানে তখন ছয়জনের সিক্রেট টিম তৈরী হয়েছে যারা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এগিনমার কোড ভাঙার৷ এই ক্ষ্যাপাটে লোকটি এসে বলল, 'আমার নাম অ্যালান টিউরিং৷ আমি এগিনমার কোড ভাঙতে পারি।'
কেউ তার কথা বিশ্বাস না করলেও তাকে সেই দলে, তার অ্যাকাডেমিক যোগ্যতার জন্য নিয়ে নেওয়া হল। দলের বাকি সাথে কিন্তু তার মোটেই বনল না। সে নিজের মত এক যন্ত্র বানানোর দাবী জানাল। সে বলল, 'অমন ম্যানুয়ালি এগিনমার কোড ভাঙা সম্ভব নয়৷ অসংখ্য সম্ভাবনা রয়েছে। যে পদ্ধতিতে কাজ চলছে তাতে বহু বছর লেগে গেলেও ভাঙা যাবে কিনা জানা নেই। একমাত্র আমার মেশিনই পারে এই কোড ভাঙতে।'
তার যন্ত্র তৈরীর টাকা দিতে রাজি হল না উপরমহল। অ্যালান কিন্তু ছাড়ার পাত্র নয়। সে সোজা চিঠি লিখে দিল প্রেসিডেন্ট চার্চিলকে। তার দাবী মানলেন চার্চিল। টাকা মঞ্জুর হল। শুরু হল পৃথিবীর প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট যন্ত্র বানানো। জন্ম নিল এক নতুন কনসেপ্ট যার নাম 'অ্যালগরিদম'। তৈরী হল 'টিউরিং মেশিন' যা না থাকলে আমাদের আধুনিক কম্পিউটার বলে কিচ্ছু থাকত না।
এক বছরের চেষ্টায় অ্যালান ভেঙে ফেলল এগিনমার কোড যা জার্মানীর হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বেঁচে গেল লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। যদিও সিক্রেট টিম হওয়ায় দেশের বেশিরভাগ লোক জানতেও পারল না তার এই অসামান্য কৃতিত্বের কথা। সেও নিঃশব্দে মেতে পড়ল তার অন্যান্য গবেষণায়।
১৯৫০ সাল। অ্যালানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিল বৃটিশ সরকার। কারণ? অ্যালান টিউরিং সমকামী যা ইংল্যান্ডে তখন আইনত অপরাধ।
জেলের বিকল্প হিসেবে তাকে সুযোগ দেওয়া হল কেমিকাল ক্যাস্ট্রেশনের। অর্থাৎ সে মুক্ত থাকতে পারে, কিন্তু কেমিকাল দিয়ে তার যৌনক্ষমতা লুপ্ত করে দেওয়া হবে। গবেষণা চালানোর জন্য তাতেই রাজী হল অ্যালান।
কিন্তু রাসায়নিক প্রভাবে তার শরীর ভেঙে পড়ল কিছুদিনের মধ্যেই। তারই সঙ্গে হল চরম মানসিক অবসাদ। ১৯৫৪ সালে, মাত্র ৪১ বছর বয়সে অ্যালান নিজের গবেষণাগারেই পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করে।
শুধু যে অ্যালান টিউরিং লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে তা নয়, দিয়ে গেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ধারণা যা মানুষকে বিজ্ঞানে কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তাকে মরে যেতে হল শুধু সে যৌনভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত নয় বলে৷
২০০৯ সালে বৃটিশ প্রাইম মিনিস্টার গর্ডন ব্রাউন 'অফিশিয়াল পাবলিক অ্যাপোলজি' জানায় টিউরিংকে৷ ২০১৩ সালে রাণী এলিজাবেথ 'রাষ্ট্রীয় ক্ষমা' ঘোষণা করে।
প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে হোমোসেক্সুয়ালিটি আইনি স্বীকৃতি পায়, ভারতে যা তিন বছর আগে হল...