27/08/2025
জানেন কী? জব চার্নকের স্ত্রী ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং সম্ভবত বাঙালী। সতীদাহের চিতা থেকে তুলে নিয়ে এসে চার্নক বিবাহ করেছিলেন লীলা নামের এক হিন্দু বিধবা নারীকে...!🌻
কলকাতার ডালহৌসি অঞ্চলে অবস্থিত প্রাচীনতম সেন্ট জন চার্চের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি বিশালাকৃতি আটকোণা সমাধি সৌধ চোখে পড়ে। এই সমাধিস্থলে শায়িত আছেন কলকাতার তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক। তবে সৌধটিকে একটি পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র বলা যেতে পারে, কারণ জব চার্নকের সঙ্গে এখানে শায়িত আছেন তাঁর হিন্দু স্ত্রী, তাঁদের জ্যেষ্ঠা কন্যা মেরী ও মেরীর এক শিশুপুত্র। সৌধের ভেতরে কতগুলি সমাধি-ফলক রয়েছে, সেখানে জব চার্নক, মেরী সবার কথা উল্লেখ থাকলেও চার্নকের স্ত্রীর কোনও উল্লেখ কিন্তু এখানে পাওয়া যায় না। কেন তাঁর স্ত্রীর নাম এখানে নেই, তার পিছনে রয়েছে এক গোপন ইতিহাস। সেটা জানতে হলে আমাদের ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দের বিহারের পাটনায় পৌঁছতে হবে।
কলকাতায় আসার আগে, ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে প্রথমবার বিহারের পাটনায় এসেছিলেন জব চার্নক। পাটনা থেকে নুন ও মশলা সংগ্রহ করে তা জাহাজে চাপিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠানো ছিল তাঁর কাজ। অল্পদিনেই তিনি ভারতবর্ষের প্রেমে পড়ে যান। তিনি নেটিভদের পছন্দ করতেন এবং তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। পাটনায় অবস্থানকালে একদিন চার্নক খবর পেলেন নিকটবর্তী গঙ্গাতীরে সতীদাহের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি সতীদাহ প্রত্যক্ষ করবার উদ্দেশ্যে কৌতূহলবশত সেই স্থানে পৌঁছে দেখেন, বহু মানুষ সেখানে ভিড় করেছে, চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং কিছু মানুষ একটি অল্পবয়সী, অতীব সুন্দরী কিশোরী মেয়েকে জ্বলন্ত চিতার দিক ঠেলে দিতে চেষ্টা করছে। মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে চার্নক শিউরে ওঠেন। তিনি সৈন্যদল নিয়ে রুখে দাঁড়ান। সাহেব দেখে ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়। সেই বিধবা হিন্দু নারীকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তিনি নিজের কুঠিতে নিয়ে যান। চার্নক ভালো করেই জানতেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে এই মেয়েটির আর কোনদিনও স্থান হবেনা। তিনি অনেক ভেবে অবশেষে সেই হিন্দু কন্যাকে বিবাহ করবার সিদ্ধান্ত নেন..💛
ডি.এল. রিচার্ডসনের লেখা বই "দ্য ওরিয়েন্ট পার্ল" থেকে জানা যায়, পাটনার সেই সতী হতে যাওয়া কিশোরীর নাম ছিল লীলা। সে ছিল কাশীর বাসিন্দা এক বাঙালী ব্রাহ্মণ পন্ডিতের বাগদত্তা। লীলার যখন মাত্র পনেরো বছর বয়স, তখন কাশী থেকে সেই বৃদ্ধের মৃত্যুসংবাদ আসে। আর তখনই লীলাকে অনুমরণের (স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী কাছে না থাকলে পরে আলাদা চিতায় স্বামীর ব্যবহৃত কোনো জিনিষ সঙ্গে নিয়ে সতী হওয়া) জন্য প্রস্তুত হতে হয়।
লীলাকে সতী হতে বাধা দিয়ে তাঁকে অপহরণ করে বিবাহ করবার কারণে জব চার্নককে অবশ্য অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছিল। অনুমরণে বাধা দিয়ে তিনি হিন্দু সমাজের চক্ষুশূল হয়ে গিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারাও তাঁর এই আচরণ খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। এমনকী চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্তের ভাবনা-চিন্তাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরেননি চার্নক। এদিকে পাটনার নবাবের কাছে এই মর্মে নালিশ যায় যে, চার্নক এক হিন্দু রমণীকে বলপূর্বক রক্ষিতা করে নিজের কাছে রেখেছেন। অভিযোগ শুনে ক্রোধান্বিত নবাব সেপাই পাঠালেন মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনতে। চার্নক বুঝলেন আর নিস্তার নেই। শেষমেষ তিনি নগদ তিন হাজার টাকা, পাঁচ থান উৎকৃষ্ট পশমি কাপড় এবং কয়েকটি তরোয়াল নবাবকে উপহার দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলেন..🌿
বিবাহের পর বেশ কয়েক বছর সুখে শান্তিতে তাঁরা দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেন। চার্নক লীলার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রেখেছিলেন মারিয়া। তাঁদের বেশ কয়েকটি সন্তানাদিও হয়। ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দে চার্নক সপরিবারে পাটনা ত্যাগ করে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। নিজের মানসিক উদারতার কারণে চার্নক তাঁর স্ত্রীকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হতে দেননি, বরং স্ত্রীর প্রভাবে তিনিই হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন তবে খ্রীষ্টধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচলিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কলকাতায় আসবার কিছুদিনের মধ্যেই লীলার মৃত্যু হয় (সম্ভবত ১৬৯১ এর মাঝামাঝি)। চার্নক সেন্ট জন চার্চের সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সযত্নে সমাহিত করেন। স্ত্রীর স্মৃতিতে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করেন। এরপর চার্নক যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতি বছর স্ত্রীর মৃত্যুদিনে সেই সমাধিস্থলে একটি করে মোরগ উৎসর্গ করতেন।
বর্তমানে সেন্ট জন চার্চ প্রাঙ্গনে যে সৌধটি আমরা দেখতে পাই, সেটি জব চার্নকের বড় জামাই চার্লস আয়ার ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। সমাধি-ফলকের রচয়িতা ছিলেন বিশপ জন ইভান্স। তিনি কোনো অজ্ঞাত কারণে চার্নকের এদেশীয় স্ত্রীর নামটি বাদ দিয়ে দেন। চার্নকের সমাধি ফলকটি একটি বিশেষ ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি, যা নিয়ে আসা হয়েছিল চেন্নাইয়ের পল্লভরম অঞ্চলের সেন্ট থমাস পাহাড় থেকে। পরবর্তীতে জব চার্নকের নামে এই বিশেষ ধরনের পাথরের নামকরণ করা হয় "চার্নকাইট"।
জব চার্নক ১৬৯৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন এমন একজন সাহেব যাঁকে বেশিরভাগ ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা অর্ধশিক্ষিত, একগুঁয়ে, কর্কশ ও রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, চার্নক ছিলেন ভারতীয় চিন্তাভাবনা ও আচার-ব্যবহারে অভ্যস্ত একজন ব্যক্তি যিনি তাঁর স্বদেশীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এদেশীয় লোকদের মধ্যেই জীবনের বেশি সময়টা কাটিয়েছেন। তবে তাঁর মধ্যে যে সাহস দেখা গিয়েছে তা কোনো বিপদকেই গ্রাহ্য করেনি, কোনো বাধাই তাঁকে নিজ কর্তব্যে বিরত করতে পারেনি। একটি অসহায়, মৃত্যুপথযাত্রী হিন্দু বিধবা নারীকে উদ্ধার করে, জীবনসঙ্গিনী বানিয়ে তিনি যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার তুলনা মেলা ভার।
♦️তথ্যসূত্রঃ Alexander Hamilton - A New Account of the East Indies, Desmond Doig - Calcutta: An Artist's Impression, পি. তংকপ্পন নায়ার: কলকাতার সৃষ্টি ও জবচার্নক