08/08/2025
পিকু সিনেমার শুটিং চলছে | সেটে রয়েছে ইরফান খান, দীপিকা পাড়ুকোন এবং তিনি।
হঠাত্ শটের মাঝখানে দেখি উনি দীপিকাকে বলছেন, “দীপিকা ডু ইউ নো দিস অ্যাক্টর কলড্ রবি ঘোষ?”
প্রশ্নটা করে উনি ইরফানের দিকেও তাকালেন। দীপিকা, ইরফান কেউই রবি ঘোষকে চিনতেন না। তারপর বলতে শুরু করলেন, ভারতবর্ষে রবি ঘোষের থেকে বড় কমিক টাইমিং আর কোনও অ্যাক্টরের না কোনও দিন হয়েছে, না কোনও দিন হবে।
যিনি এটা বললেন তার নাম অমিতাভ বচ্চন |
অভিনয় ছিল তাঁর মজ্জায় মজ্জায়। তাই কোনও বাধাই তাঁর সেই ‘প্যাশন’কে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর পেশাদারিত্ব? ঠিক সময়ে কাজের জায়গায় পৌঁছনো ছিল তাঁর স্বভাব। ‘ঠগিনী’ ছবি তৈরির সময় এক দিন বেশ দেরি হল ফ্লোরে পৌঁছতে। দুপুরের ব্রেকের আগে পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ শেষ হলে জানা গেল তিনি সেই সকালেই মা-কে দাহ করে এসেছেন। তাই দেরি।
তিনি বাংলার গর্ব রবি ঘোষ | তাঁকে কমেডিয়ান বললে ভীষণ রেগে যেতেন। বলতেন— কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনও সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি এক জন চরিত্রাভিনেতা। গুরু মানতেন চার্লি চ্যাপলিনকে | তাঁর আসল নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার | অতবড় নাম ছেঁটেকেটে বাংলা অভিনয় জগতে এলেন রবি ঘোষ নামে।
২৪ নভেম্বর, ১৯৩১। কোচবিহারে মামাবাড়িতে জন্ম হয় রবি ঘোষের। বাবা জীতেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার আদতে ছিলেন পূর্ব বাংলার বরিশালের গাভার বাসিন্দা।
পড়াশোনার শুরু কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে। পরে ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন উত্তমকুমারের ভাই অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং এই কলেজেরই নৈশ বিভাগে বি কম-এ ভর্তি হন। নিয়মিত শরীরচর্চার শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই।
ছাত্রজীবনে ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল গড়ে মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। নাটকের জন্য বহু বার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অভিনয় করা তাঁর বাবা জীতেন্দ্রনাথ একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্নারানিকে বলতেন, “রবি অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না।” বাবা না হলেও, মা ও বড়মামার সমর্থন ছিল পুরোপুরি।
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সাল। উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে এলটিজি-র নিবেদিত ‘অঙ্গার’নাটকের প্রথম শো। এবং সে দিন থেকে নাটকের শেষ রজনী পর্যন্ত তাতে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। ১৯৫৯ সালের উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কারও লাভ করেন অঙ্গারের জন্য।
১৯৫৯ সালে তিনি আহবান চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিনহার গল্প হলেও সত্যিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সবার নজরে আসেন। ১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় নির্মিত গুপী গাইন বাঘা বাইন চরিত্রে তার অভিনয় চলচ্চিত্রজগতে একটি মাইলফলক। একে একে তিনি অভিযান (১৯৬২), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) সহ বেশকিছু উপমহাদেশখ্যাত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তিনি নিধিরাম সর্দার চলচ্চিত্রটি পরিচালনাও করেন। তিনি একজন বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেতাও বটে। ১৯৭০ সালে তিনি গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালেও অংশ নেন।
আড্ডাবাজ, পরোপকারী মানুষটি খেতে ভালবাসলেও খুবই পরিমিত আহারে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রিয় খাবার ছিল লুচি ও পাঁঠার মাংস। প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্তর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময়। সেই সময় হঠাত্ই অসুস্থ হয়ে পড়েন রবি ঘোষ। অনুভাদেবীর শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের পর তাঁরা বিয়ে করলেও, ১৯৭২ সালে অনুভাদেবীর অকাল মৃত্যুতে সেই সম্পর্ক দীর্ঘ হয়নি। এই ঘটনার এক দশক পর ১৯৮২ সালে রবি ঘোষ বিয়ে করেন বৈশাখিদেবীকে। তখন তিনি মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে।
১৯৫৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত প্রায় ২০৬টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন রবি ঘোষ | প্রায় ৩৯টি নাটক করেছিলেন। উল্লেখ্য শ্রীমতী ভয়ঙ্করী ১০০০ রজনী, বিজন থিয়েটারে ৯০০ ও সুজাতা সদনে ১০০, কনে বিভ্রাট ৬৩৫ রজনী, সারকারিনায় ৫৩৫ ও সুজাতা সদনে ১০০, নব সংস্করণ, শোধবোধ, ঠগ, ধনপতি গ্রেফতার, অলীকবাবু, ছায়ানট ইত্যাদি। হিন্দিতে অভিনয় করেন সত্যকাম, সব সে বড়া সুখ, আজ কি রবিনহুড, পতঙ্গ সিনেমায় | গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার | 'গুপীবাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বিএফজে পুরস্কার। ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ জীবনাবসান হয় এই চরিত্রাভিনেতার।
পরিচালক সন্দীপ রায় বলছেন, “কমেডিয়ান হিসেবে তাঁর খ্যাতি হলেও আদতে তিনি ছিলেন চরিত্রাভিনেতা।” আসলে রবি ঘোষ এমনই একটা নাম, বাঙালি যাঁকে এক জন কমপ্লিট অভিনেতা হিসেবেই চেনে।
(সংগৃহীত)
゚ #রবিঘোষ ゚