22/10/2025
ভাইফোঁটার আগের দিন উধাও সাত কুইন্টাল দই! তবু দামের দাপট নয়, মানুষের ভালোবাসাই আসল পুঁজি
ভাইফোঁটার আগের দিন সকাল থেকেই ভিড় ছিল উপচে পড়া। কেউ দই নিতে এসেছে, কেউ মিষ্টি, কেউ আবার শুধু দেখতে—এই দোকানে এমন দাম কীভাবে সম্ভব! চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল সাত কুইন্টাল দই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি—মাত্র ১১০ টাকায় কেজি দই! যেখানে অন্যত্র দাম গড়ে ১৫০ টাকার উপরে, সেখানে এত কম দামে খাঁটি দই বিক্রি করা যেন এক বিস্ময়।
শান্তিপুরের এই জনপ্রিয় মিষ্টির দোকানটির নাম আজ প্রায় সকলের মুখে মুখে। দোকান মালিক জানালেন, প্রায় তিন বছর ধরে তিনি দইয়ের দাম ১১০ টাকাই রেখেছেন। তিন বছর আগে দাম ছিল ১০০ টাকা প্রতি কেজি। মাত্র ১০ টাকা বাড়িয়ে এতদিনেও তিনি দামের লাগাম টেনে রেখেছেন। বললেন, “আমি লাভের পরিমাণ কম রাখি। আমার উদ্দেশ্য মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ভালো মানের জিনিস কম দামে দেওয়াটাই আমার ব্যবসার মূলনীতি।”
দোকানের ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। একসময় এই দোকানদার ছিলেন চানাচুর কারখানার মালিক। তারপর চপের দোকান চালিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতার কারণে আগের ব্যবসাগুলো বন্ধ করতে হলেও, হাল ছাড়েননি তিনি। নতুন করে মিষ্টির দোকান শুরু করেন, আর সেখান থেকেই শুরু তার সাফল্যের পথযাত্রা। বর্তমানে শুধু শান্তিপুর নয়, আশপাশের বাগআছড়া, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর এমনকি দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন তার দোকানে দই-মিষ্টি কিনতে।
৫ টাকায় ৮ থেকে ১০ ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায় দোকানে—এ যেন আজকের বাজারে রূপকথার মতোই কথা। দাম কম বলেই দোকানে ক্রেতাদের ভিড় প্রতিদিনই লেগে থাকে। মালিকের কথায়, “কম দামে মান বজায় রাখা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমি যেভাবে কাজ করি, সেখানে ভেজালের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”
তবে অনেকেই অভিযোগ তোলেন, এত কম দামে বিক্রি মানেই নিশ্চয়ই ভেজাল উপকরণের ব্যবহার। এই অভিযোগের জবাবে দোকানদার স্পষ্ট জানান, “পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সাংবাদিক, ফুড ইন্সপেক্টর—সবাই আমার কারখানায় এসেছেন, পরীক্ষা করেছেন। তারা নিজের চোখে দেখেছেন আমি কিভাবে দই পাতি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য তারা প্রশংসাও করেছেন।”
এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত অনেক ক্রেতাও। তাদের মতে, এই দোকানের দই ও মিষ্টির মান অন্যদের থেকে আলাদা। দাম কম হলেও গুণমান নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। ক্রেতাদের একাধিকজন বলেন, “আজকের বাজারে সব কিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু এই দোকানে এলেই মনে হয় আমরা যেন দশ বছর পিছিয়ে গেছি। এমন দাম আর কোথাও নেই।”
ভাইফোঁটার দিনগুলিতে দোকানের সামনে দেখা যায় ভিড় সামলাতে হিমশিম খাওয়া অবস্থা। দোকানদার বলেন, “অনুষ্ঠানের দিনে কখনও কখনও দইয়ের চাহিদা এত বেড়ে যায় যে মিষ্টি বিক্রি কমে যায়। তাই বাধ্য হয়ে বলি, দই নিতে হলে সঙ্গে কিছু মিষ্টি নিতেই হবে। তবে সেটা একেবারেই উৎসবের বিশেষ দিনেই।”
প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দুই কুইন্টাল দই বিক্রি হয় দোকানে, কিন্তু ভাইফোঁটার আগের দিন সেই পরিমাণ প্রায় সাত কুইন্টাল ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখে এলাকার অন্য মিষ্টির দোকানদাররাও অবাক।
শান্তিপুর মিষ্টির জগতে এই দোকান যেন এক আলাদা অধ্যায়। শুধু দামের প্রতিযোগিতা নয়, সততা, মান বজায় রাখা এবং ক্রেতার সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্কই আজ তার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আজকের দিনে যেখানে ব্যবসা মানেই মুনাফার হিসাব, সেখানে এই দোকানদারের দই যেন এক মিষ্টি বার্তা দেয়—মানুষের ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় লাভ।
ভাইফোঁটার উষ্ণতায় যখন বোনেরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিচ্ছে, তখন শান্তিপুরের এই মিষ্টির দোকানে চলছে অন্যরকম এক আনন্দ। সেখানে মিষ্টির স্বাদে, দইয়ের টানে, আর দোকানদারের আন্তরিকতায় মিশে রয়েছে এক অনন্য মিষ্টি গল্প—যার স্বাদ আজ সারা জেলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।