08/06/2025
বেলা প্রায় আটটা | আমরা চায়ের আয়োজন করতে ব্যস্ত | আহত কজন সেনা, যাঁরা ট্রাকে এসেছেন, তাঁদের কয়েকটি ছোট ছোট চালা ঘরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে | একটা ফাঁকা মাঠের চারদিকে চালাঘর সাজানো |সব কয়টি ঘরের মুখ মাঠের দিকে | নেতাজী তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক মেজর মেনন ও কর্নেল চ্যাটার্জীর এ- ডি- সি লেফটানেন্ট নাজিরের সাথে একে একে রোগীদের পরীক্ষা করছেন, নার্স রয়েছে তাঁর সঙ্গে | ব্যান্ডেজ পাল্টে দিচ্ছেন, ওষুধ দিচ্ছেন, পথ্যের নির্দেশ দিচ্ছেন | নাজির এসব কাজে তাঁকে সাহায্য করছেনা , সে শুধু দেহরক্ষীর মতো নেতাজীর পাশে পাশে থাকছে | পরিদর্শন সেরে ওঁরা তিনজনে যখন মাঝের উঠানটুকু পার হয়ে আসছে, তখন একেবারে অতর্কিতে আকাশ ভেদ করে ছুটে এলো দুটো ফাইটার শত্রু বিমান |
কর্নেল চ্যাটার্জী চেঁচিয়ে বললেন, টেক শেল্টার!! প্লেনস !!
নার্সটি ছিল অনেক পিছনে- সে ছুটে ফিরে গেল ওদিকের চালাঘরে । ওদের তিন জনের সর্বপ্রথমে ছিলেন মেজর মেনন । প্রানপনে তিনি দৌড়লেন আমাদের পাকা ঘরটা লক্ষ্য করে । মাঝখানে নেতাজী, তিনিও দৌড়াচ্ছেন- কিন্তু আটচল্লিশ বছরের যে প্রৌঢ় মানুষটি সারারাত হেঁটে এসেছেন, টপ বুট পরে তাঁর পক্ষে আর কত জোরে ছোটা সম্ভব? দলের সকলের পিছনে ছিল লেফটেন্যান্ট নাজির আহমেদ । কৃষ্ণসার হরিনের মতো লঘুগতি তরুণ সৈনিক! কলেজে যে হান্ড্রেড ইয়্যার্ডস এ পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ফৌজের হকি টিমে যে ছিল দুর্বার সেন্টার ফরওয়ার্ড! নেতাজির এ পথটুকু অতিক্রম করতে যতটুকু সময় লাগবে তার ভিতর সে অনায়াসে গোটা মাঠ বার দুই পারাপার হতে পারে! অথচ চোখের সামনে দেখলাম বড় বড় পা ফেলে সে ঠিক নেতাজির পাশে পাশে হেঁটে আসছে। নেতাজী দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু নাজির হাঁটছে । দেহরক্ষী তাঁকে অতিক্রম করে যাচ্চে না। নির্মম কটি মুহূর্ত!
শত্রু পক্ষের প্রথম প্লেনটি একটু নীচে নেমে এলো । নেতাজী রীতিমত হাপিয়ে পড়েছেন । নাজির উপরদিকে একবার তাকিয়ে দেখল, চোখটা আড়াল করেছে হাতের তালুতে। প্লেনটি মেশিনগান চালাতে চালাতে পার হয়ে গেল উঠোনটা। নেতাজী ও নাজিরের দশ, পনেরো ইঞ্চি দুরে মাটিতে কতোগুলো ছোবল পড়ল। ধুলো উড়ে গেল সরল রেখায়, মেজর মেনন ততোক্ষণে এসে পৌঁছেছেন । নেতাজী আমাদের বারান্দা থেকে আন্দাজ ফুট ত্রিশেক দুরে । আর বড়জোর দশটা পদক্ষেপ আর নেতাজীর ঠিক পাশেই নাজির, আমরা যখনই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যাচ্ছি, অমনি দেখি ডাইভ দিয়ে দ্বিতীয় প্লেনটি নেমে এলো । বাজপাখির মতো উড়ে এলো একি সরলরেখায়। মেশিনগানের তীব্র ক্রটাক্রট শব্দ কাছে থেকে আরোকাছে এসে মুহুর্মুহু গুলি ছড়িয়ে আবার উঠে গেল উর্দ্ধাকাশে । ঠিক তার পূর্ব মুহূর্তে নেতাজী একটা লাফ দিয়ে উঠে এলেন আমাদের বারান্দায় । নাজির পারলোনা । লুটিয়ে পড়লো তার রক্তাক্ত দেহ সিড়ির গোড়ায় ।
ছুটে গেলেন নেতাজী ও কর্নেল চ্যাটার্জী । ধরাধরি করে দাওয়ায় তুললেন দেহটা । রক্তে ভেসে যাচ্ছে নাজিরের বাম অঙ্গ। বুলেট লেগেছে তার বাম জানুতে, অনেক গুলোই । আমার চোখের সামনেই ঘটল ঘটনাটা । বুলেট ঝড়ের মধ্যেই নেতাজী কে পিছন থেকে সজোরে শেষ ধাক্কাটা মেরেছিল এই নাজির আহমেদই, ওর ক্ষত দেখতে সজল চোখে সেকথা নেতাজীও বললেন, যার জেরেই একটি বুলেটো নেতাজী কে স্পর্শ করেনি । আমি কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনষ্ক হয়ে নাজিরকে ঘিরে আমার অনেক একান্ত মুহুর্তে র কথাগুলো ছবির মতো দেখতে লাগলাম, কর্নেল চ্যাটার্জি র সাথে লেফটেন্যান্ট নাজিরের প্রথমবার বার্মা সীমান্ত পার করে ভারতভূমিতে প্রবেশের সেই আবেগঘন মুহূর্ত, আমার জন্যে আনা নাজিরের প্রথম উপহার স্বাধীন ভারতের এক খন্ড মাটির তাল, সবই একে একে ভেসে উঠল । দিন টা কেমন করে কেটে গেল জানি না, মেজর মেনন ও কর্নেল চ্যাটার্জি একমত হলেন যে হসপিটালে ছাড়া এই ক্ষত নিরাময় করা যাবেনা, নিকটবর্তী হাসপাতাল মৌলমিনে নেতাজী সেখানে যাবার নির্দেশ দিলেন । বিকেলে র দিকে জ্ঞান ফিরলো লেফটেন্যান্ট নাজিরের । আমরা তখন ওকে নিয়ে যাচ্ছি মৌলমিনে হাসপাতালে।পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। আমি বললাম কষ্ট হচ্ছে? নাজির দাতে দাত চিপে বললে হ্যাঁ। নেতাজী ঠিক আছেন?
আমি বললাম হ্যাঁ ।
নাজির তারপরে বললো আমার পা কি কেটে বাদ দিয়েছে!
---- না না! পা তোমার ঠিক আছে, ঠিক হয়ে যাবে!
অসীম যন্ত্রণা র মধ্যেও নাজির হাসলো, বললে -- কালই বলেছিলাম না, নাজির হয়তো বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে!
আমি আর সহ্য করতে পারিনি, সজোরে ওর মুখ টা চেপে ধরি, কান্না চেপে রেখে বলি , তোমার কথা বলা মানা আছে, হসপিটালের ডাক্তার দেখলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে, নাজির কিন্তু মানলো না, ওর মুচকি হাসি বুঝিয়ে দিলো ওকে ফাকি দেওয়া যাবে না । আমার কানে ভেসে এলো কয়েক ঘন্টা আগে ই বলা মেজর মেননের উক্তি, হাসপাতালে পৌঁছে বোধহয় বা পাখানা জানু থেকে কেটে বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ, নাজির বাচলে ও হকি টীমের সেন্টার ফরোয়ার্ড আর বাচবে না ।
মৌলমিন হাসপাতালেই লেফটেন্যান্ট নাজির আহমেদ মারা যান, অপারেশনে তার পা কেটে বাদ যায়, আরো দুই দিন বেচে ছিল সে। শেষ সময়ে তার জ্ঞান ছিল কিন্ত কথা বলতে পারত না, আমার দিকে চেয়ে থাকতো, আর দুচোখে জলের ধারা বইতো, আমি চোখের জল মুছিয়ে দিতাম রুমালে!
নাজিরের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার হাতেই দিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হবার পরে নাজিরের মায়ের ঠিকানায় তার, হাতঘড়ি, কলম ইত্যাদি পার্সেল করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, আমার কাছে রইলো শুধু দুটি স্মৃতি চিহ্ন। উর্দু বয়েতে ঠাসা তার একটি ছোট্ট নোট বই। মৌলমিন হাসপাতালে র দক্ষিণ পূর্ব কোনে একটি ফুলে ভরা গুলমোহর গাছের তলায় ওকে কবর দিয়েছিলাম, কবিতার খাতাটা ভিতরে ফেলে দিতে পারিনি, মনে হয়েছিল ও খুশি হবে ওটা আমি নিয়ে এলে ।ঐ খাতাটাই আমাকে উর্দু শিখতে বাধ্য করেছে । এখানকার স্কুলে উর্দু শেখাই আজ। নাজিরের ঐ খাতাটা আমাকে শুধু জীবন দেয়নি, দিয়েছে জীবিকাও। আরো একটা স্মৃতি চিহ্ন আছে । যে রুমাল টা দিয়ে ওর ক্ষতস্থান চেপে ধরেছিলাম একদিন! ঐ একটি রুমাল ই ছিল আমার সম্বল। ঐ রক্তমাখা রুমাল দিয়েই একদিন মুছিয়ে দিয়েছিলাম মৃত্যু পথযাত্রীর চোখের জল ।
পচিশ বছর পার হয়ে গেছে তারপর। আজ আমি প্রৌঢ়া । তবু সে রুমাল তেমন ই আছে । ওর চোখের জলের চিহ্ন মাত্র নেই। জমে আছে শুধু একটা কালো রক্তের দাগ। তাজা রক্ত যেমন শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে, শতাব্দীর এক চতুর্থাংশে মর্মান্তিক তীব্র শোকটার ধার ভোতা হয়ে গেছে। তবু ঐ রুমালটা যেদিন বাক্সের তলা থেকে বের করে দেখি তখন পচিশ বছরের ওপার থেকে শুনতে পাই সাতাশ বছর বয়সের কণ্ঠস্বর--
❝ দো লব্জো মে পুশিদা এক মেরি কাহানী হ্যায়।
এক লব্জ মহব্বত হ্যয়, এক লব্জ জওয়ানী হ্যায় ।
আসুকে মেরে লে-কর দামন পে জরা জাচ্চো--
জম যায়ে তো খুন হ্যয়, বহ্ যায়ে তো পানি হ্যয় ।।❞🥀
♦️তথ্যসূত্রঃ আমি নেতাজীকে দেখেছি, ‘আরতি নায়ারের’ বয়ান, নারায়ণ স্যান্যাল
ছবি 📸 আজাদ হিন্দ ফৌজের দুই সৈনিক (নাম- অজানা)
🇮🇳 জয়হিন্দ 🇮🇳
© এক যে ছিলো নেতা
| ে_ছিলো_নেতা |
📌 Facebook এর পাশাপাশি আমরা পথচলা শুরু করেছি YouTube এও.. আমাদের কাজ ভালো লাগলে আমাদের channel টি Subscribe করে পাশে থাকবেন..