24/05/2025
https://www.facebook.com/share/p/18FxQckRdi/
কালো কুকুরের রহস্য
দ্বিতীয় পর্ব
____________________
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রবীর রায়ের চিন্তার জাল আরও ঘন হলো। কালুর অপলক দৃষ্টি আর অস্পষ্ট মুখের ছবিটি যেন তার মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছিল। শুভ্র কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, তবে তার চোখে নতুন কিছু জানার আগ্রহ তখনও বিদ্যমান।
"স্যার, ছবিটা কি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে?" শুভ্র জানতে চাইল, যখন তারা অরুণাভর বাড়ির বাইরে এসে গাড়িতে বসলেন।
"হয়তো," প্রবীর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন। "ছবিতে যার মুখ ঘষা হয়েছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।"
পরের দিন সকাল থেকেই প্রবীর এবং শুভ্র তদন্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রথম কাজ ছিল অরুণাভর পরিচিত মহলে সেই অস্পষ্ট মুখের ব্যক্তির পরিচয় জানার চেষ্টা করা। তারা অরুণাভর পুরনো দিনের বন্ধু, কলেজের সহপাঠী এবং প্রাক্তন সহকর্মীদের সাথে কথা বললেন। অনেকেই অরুণাভর দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলেন, কিন্তু কেউই সেই কালিমাখা মুখের ব্যক্তির নাম বলতে পারলেন না।
"উনি খুব ব্যক্তিগত মানুষ ছিলেন, স্যার," অরুণাভর এক পুরোনো বন্ধু বললেন। "নিজের ভেতরের কথা সহজে কাউকে বলতেন না।"
তদন্তের পাশাপাশি প্রবীরের মন বারবার কালুর কাছে ফিরে যাচ্ছিল। তিনি দেবনাথের কাছে খবর নিয়ে জানতে পারেন, কুকুরটি এখনও সেই স্টাডিরুমেই বসে আছে, কারও সাথে তেমন মেলামেশা করছে না। শুধু পরিচারিকা যখন খাবার দেয়, তখনই সে সামান্য ওঠে।
"কুকুরটা যেন কিছু বলতে চাইছে, শুভ্র," প্রবীর আনমনে বললেন। "কিন্তু তার ভাষা আমরা বুঝতে পারছি না।"
শুভ্র কিছুটা সন্দিগ্ধ ছিল। "স্যার, এটা তো একটা পশু। এর মধ্যে এত রহস্য খোঁজার কি আছে?"
প্রবীর মৃদু হাসলেন। "শুভ্র, অনেক সময় নীরবতাই সবচেয়ে বড় কথা বলে। আর চোখ... চোখ কখনো মিথ্যে বলে না।"
সেদিন সন্ধ্যায় প্রবীর আবার অরুণাভর বাড়িতে গেলেন। পরিচারিকা দরজা খুলে অবাক হলেন।
"আপনি আবার এসেছেন, স্যার?"
"হ্যাঁ। কালুর সাথে একটু কথা বলতে চাই," প্রবীর উত্তর দিলেন।
স্টাডিরুমে কালু তখনও একই অবস্থায় বসে ছিল। প্রবীর ধীরে ধীরে তার কাছে গেলেন এবং তার পাশে বসলেন। তিনি নিজের পকেট থেকে একটি শুকনো মাংসের টুকরো বের করে কালুর দিকে ধরলেন। কালু প্রথমে ইতস্তত করল, তারপর প্রবীরের হাত থেকে খেলো।
প্রবীর কালুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। "কালু, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? তুমি কি দেখেছো কে মেরেছে তোমার মালিককে?"
হঠাৎ কালু উঠে দাঁড়াল এবং প্রবীরের হাতের কাছে তার নাক ঘষতে লাগল। তারপর সে দরজার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ডেকে উঠল।
"ও কি কিছু বোঝাতে চাইছে, স্যার?" শুভ্র, যে প্রবীরের সাথে এসেছিল, অবাক হয়ে বলল।
প্রবীর দরজার দিকে তাকালেন। দরজা বন্ধ ছিল। "হয়তো ও চায় আমি কোথাও যাই..."
কালু এরপর ঘরের অন্য একটি কোণে গেল এবং সেখানে রাখা একটি পুরোনো কাঠের বাক্সের চারপাশে ঘুরতে লাগল। বাক্সটি ধুলোয় মলিন, বহু বছর ধরে খোলা হয়নি বলেই মনে হয়।
প্রবীর এবং শুভ্র বাক্সটির কাছে গেলেন। বাক্সটি তালাবন্ধ ছিল। প্রবীর দেবনাথকে ডেকে তালা ভাঙার ব্যবস্থা করতে বললেন। তালা ভাঙার পর বাক্সের ভেতর থেকে যা বেরোল, তা দেখে প্রবীর এবং শুভ্র দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বাক্সের ভেতরে ছিল বেশ কিছু পুরনো চিঠি, কিছু দুর্লভ ছবি এবং একটি ছোট, চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি।
ডায়েরিটির প্রথম পাতা খুলতেই প্রবীরের চোখ আটকে গেল। সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে একটি নাম লেখা – "মালিনী"। আর তার পাশেই সেই কালিমাখা মুখের ছবি, যা অরুণাভর স্টাডিরুমে ছিল, তবে এখানে মুখটি স্পষ্ট। একজন সুন্দরী মহিলার ছবি।
"মালিনী... ইনি কে?" শুভ্র বিস্ময়ের সাথে বলল।
প্রবীর ডায়েরির পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। প্রতিটি পাতায় অরুণাভ এবং মালিনীর গভীর সম্পর্কের কথা লেখা। তাদের প্রেম, বিরহ এবং কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডায়েরির শেষ কয়েকটি পাতায় মালিনীর অসুস্থতা এবং তার প্রতি অরুণাভর গভীর উদ্বেগের কথা লেখা। একটি পাতায় মালিনীর মৃত্যুর তারিখও উল্লেখ করা হয়েছে – প্রায় পাঁচ বছর আগে।
"পাঁচ বছর আগে মালিনীর মৃত্যু... তাহলে এই রহস্যের সাথে তার কী সম্পর্ক?" প্রবীর আনমনে বললেন।
ঠিক তখনই কালু অস্থির হয়ে প্রবীরের পায়ের কাছে ঘেঁষতে লাগল এবং মৃদু গোঙানির শব্দ করতে লাগল। তার দৃষ্টি তখনও দরজার দিকে নিবদ্ধ।
প্রবীর দরজার দিকে তাকালেন। বাইরে আবছা অন্ধকার। হঠাৎ তার মনে একটি প্রশ্ন জাগল – কালু কি শুধু মালিনীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে, নাকি সে অন্য কিছু অনুভব করতে পারছে?
দ্বিতীয় পর্বের শেষে, প্রবীর রায় একটি নতুন রহস্যের মুখোমুখি – মালিনী, যার অকালমৃত্যু পাঁচ বছর আগে ঘটেছে, তার সাথে অরুণাভর হত্যাকাণ্ডের কি কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে? আর কালুর এই অস্থির আচরণ কি কোনো নতুন সংকেত দিচ্ছে?