17/09/2025
ঢাকা শহরে একটি রাজনৈতিক গল্প
মধ্যরাত। ঢাকার বাতাস ভারী। এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি নেই, শহরের চারপাশের সব ধূলো আর ক্লান্তি যেন বাতাসে মিশে আছে। ধানমন্ডির লেকের পাশে একটা পুরনো কফিশপের ভেতরে বসে আছে দুই রাজনৈতিক বন্ধু — শফিক আর মোস্তফা। তাদের বন্ধুত্ব প্রায় ৩০ বছরের, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক পথের দূরত্ব এখন যোজন যোজন। শফিক বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ নেতা, আর মোস্তফা এককালের প্রভাবশালী নেতা এখন বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ মুখ।
মোস্তফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাঙা গলায় বললো, "শফিক, মনে আছে, যখন আমরা প্রথম রাজনীতিতে আসি? কত স্বপ্ন ছিল আমাদের। ভেবেছিলাম দেশটাকে পাল্টে দেব।"
শফিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "মোস্তফা, স্বপ্ন এখনো আছে। শুধু পথটা একটু ভিন্ন।"
"ভিন্ন?" মোস্তফার চোখে তাচ্ছিল্যের হাসি, "আমরা তো একসময় এক নৌকার যাত্রী ছিলাম। এখন তুমি ক্ষমতা আর আমি এই আঁধারে বসে আছি। তোমরা বলছো দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি দেখছি মানুষ এখনো শঙ্কা আর হতাশায় ভুগছে।"
শফিক চুপ করে রইলো। গত দুই দিন ধরে একটা খবর তাকে অস্থির করে রেখেছে। দলের ভেতর থেকে এক প্রভাবশালী নেতা, যার সঙ্গে শফিকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো, তিনি গোপনে বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। উদ্দেশ্য, ক্ষমতা পরিবর্তনের একটা চক্রান্ত। শফিক জানে, এই খবর ফাঁস হলে রাজনীতিতে ভূমিকম্প হবে।
মোস্তফা হঠাৎ বললো, "আজকে আমাকে একজন ফোন করেছিল। বললো, তোমাদের দলের ভেতর নাকি একটা ফাটল ধরেছে। কিছু নেতা নাকি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়।"
শফিকের বুক কেঁপে উঠলো। তার মনের ভেতরের কথাটা কি মোস্তফা জেনে গেছে?
শফিক গম্ভীর হয়ে বললো, "কে বলেছে তোমাকে?"
"নাম বলবো না," মোস্তফা শান্ত স্বরে বললো, "শুধু বললাম, সময় পাল্টায়। রাজনীতিতে কিছুই চিরস্থায়ী না।"
শফিক বুঝতে পারলো, মোস্তফা তার মনের কথা জানার জন্য চেষ্টা করছে। সে সরাসরি বললো, "মোস্তফা, তুমি জানো, আমাদের দল শক্ত। কোনো ফাটল নেই।"
মোস্তফা হাসলো, কিন্তু সেই হাসিতে কোনো আনন্দ ছিল না। "শফিক, তুমি আর আমি তো জানি, রাজনীতিতে কোনো কিছুই সোজা পথে চলে না। তুমি তোমার পদ বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলছো, আর আমি দেশের জন্য একটা সুযোগ খুঁজছি।"
শফিক উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর কিছু টাকা রেখে বললো, "আমি যাই। অনেক রাত হয়েছে।"
"যাও," মোস্তফা বললো, "কিন্তু মনে রেখো, ক্ষমতার মোহে সবকিছু হারানো যায়। তোমার স্বপ্ন, তোমার আদর্শ, তোমার বন্ধুত্ব..."
শফিক কোনো উত্তর না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাত তখন গভীর। ঢাকার রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। শফিক জানে, মোস্তফার কথাটা সত্যি। তার হাতে এখন দুটো পথ খোলা। হয় সে চক্রান্তের কথা লুকিয়ে দলের ক্ষমতা রক্ষা করবে, অথবা সত্যটা প্রকাশ করে নিজের আদর্শের কাছে ফিরবে।
কিন্তু যদি সে সত্যটা প্রকাশ করে, তবে তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যাবে। আর যদি লুকিয়ে রাখে, তবে সে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবে। ঢাকার এই গভীর রাতে, এই রাজনৈতিক গল্পে শফিক নামের নেতাটি এক কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে সিদ্ধান্ত শুধু তার জীবন নয়, হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথও বদলে দিতে পারে।