03/06/2025
১৮৫৯ সালের এক অন্ধকারময় রাত। ভারতের রাজপুতানার প্রান্তে অবস্থিত ঝোপঝাড়ে ঘেরা ছোট্ট এক দুর্গ, যার চারপাশে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা এক সাহসী যোদ্ধা – রামচন্দ্র পান্ডুরং ইয়েওয়ালকর। তিনি জানতেন, ব্রিটিশ সেনারা তাঁর পিছু নিয়েছে, কিন্তু তবুও অদম্য চিত্তে পরিকল্পনা করে চলেছিলেন এক নতুন আঘাতের।
তাঁর সঙ্গে ছিলেন অল্প কয়েকজন অনুগত যোদ্ধা। তাঁরা গোপন সঙ্কেত ও ছায়ার মতো চলাফেরা করতেন। দৃষ্টির আড়ালে থেকেও ব্রিটিশদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু এইবার খেলাটা ছিল অন্যরকম।
১৮৫৭ সালে যখন সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন রামচন্দ্র পান্ডুরং, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই, নানাসাহেব ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে একত্রিত হন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি অসাধারণ গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে বহু যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
ঝাঁসির যুদ্ধে তিনি রানী লক্ষ্মীবাইয়ের পাশে থেকে ইংরেজ সেনাদের রীতিমতো নাকানিচোবানি খাইয়ে দেন। তাঁর কৌশল ছিল দ্রুত আক্রমণ করে স্থান পরিবর্তন, যাতে ব্রিটিশ বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। একবার তো তিনি ইংরেজদের সেনাঘাঁটিতে ভুয়া চিঠি পাঠিয়ে ভুল বার্তা ছড়িয়ে দেন, আর সেই ফাঁকে তিনি নিজে সৈন্য নিয়ে অন্য অঞ্চল দখল করে নেন। ব্রিটিশ বাহিনী এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে দমন করতে ব্যর্থ হয়।
বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা তাঁর ওপর পুরস্কার ঘোষণা করে। কিন্তু তিনি ছিলেন এক কৌশলী পালিয়ে বেড়ানোর মাস্টার। তিনি কখনও গোপনে বিদর্ভে, কখনও রাজপুতানায়, কখনও মধ্যপ্রদেশের গভীর অরণ্যে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান।
রাজা মনসিংহ, যার সঙ্গে রামচন্দ্র পান্ডুরং যুদ্ধের সময় জোট বেঁধেছিলেন।
এক রাতে তাঁকে গোপনে আমন্ত্রণ জানান মনসিংহ।
বলেছিলেন—
"আসুন, এখানে নিরাপদে থাকুন। ব্রিটিশরা এখানে ঘেঁষতেও পারবে না। আমার দুর্গ আপনার জন্য খোলা।"
রামচন্দ্র পান্ডুরং কিছুটা দ্বিধায় পড়লেও নিজের পুরনো সম্পর্কের খাতিরে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তাঁর সহযোদ্ধারা সন্দেহ করলেও, তিনি বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ পাননি।
মনসিংহের প্রাসাদে ঢোকার পর রামচন্দ্র একটি ছোট্ট কক্ষে বিশ্রাম নিতে যান। বাইরে পাহারা বসানো হয়েছে – কথিত “রক্ষীরা”। কিন্তু সেই পাহারার আড়ালেই লুকিয়ে ছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা।
রাত ঠিক তিনটা। হঠাৎই দরজায় প্রবল শব্দ। ঘরের জানালা দিয়ে আলোর ঝলকানি – ব্রিটিশ সেনারা হানা দিয়েছে। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি ধরা পড়েছেন। ছুরি হাতে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন, কিন্তু গায়ে ক্লান্তি, সৈন্য নেই পাশে। আধাঘণ্টার মাথায় তাঁকে জোরপূর্বক বন্দি করা হয়।
ব্রিটিশ অফিসার ক্যাপ্টেন হার্ডিং চিৎকার করে বলেন—
"Catch him alive! He is more dangerous than ten thousand men!"
রামচন্দ্র পান্ডুরং বন্দি অবস্থাতেও মাথা নিচু করেননি। ব্রিটিশদের মুখের দিকে তাকিয়ে কড়া ভাষায় বলেন—
"আমি ধরা পড়েছি, কিন্তু আমার বিশ্বাস ধরা পড়েনি। একদিন ভারত জেগে উঠবেই!"
মনসিংহ, মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন – চোখে লজ্জার ছায়া। কিন্তু খুব দেরি হয়ে গেছে। একজন ইতিহাসের নায়ক সেই রাতে বন্দি হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কাহিনি রয়ে গেছে চির জাগরুক।
কয়েক সপ্তাহ পরে রামচন্দ্র কে বিচারে দাঁড় করানো হয়। আদালত তাঁকে দেশদ্রোহী হিসাবে আখ্যা দেয়।
১৮৫৯ সালের ১৮ এপ্রিল তাঁর ফাঁসি হয়।
কিন্তু ব্রিটিশরা বুঝতে পারেনি— তারা রামচন্দ্র পান্ডুরং তোপে কে ফাঁসিতে ঝোলালেও, তিনি আগামীর বিপ্লবীদের কাছে আদর্শ হয়ে আর ভারতের ইতিহাসে বীর সংগ্রামী তাঁতিয়া টোপে নামেই জীবিত থেকে যান।
An Animesh