
10/09/2025
টাকা না সম্পর্ক—জীবনভর এই বিতর্কে আমরা অনেকেই ভুগি। কোনটা আমাদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনস্তত্ত্ববিদরা একটা চমকপ্রদ দিক তুলে ধরেছেন। তাঁদের মতে, মানুষ শুধু অন্য মানুষের সঙ্গেই নয়, একটি পোষ্যর সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, আর সেই সম্পর্কের মূল্য অনেক সময়েই টাকার থেকেও বেশি হয়।
এই ভাবনা নিয়েই বলা যায় রোহানের গল্প। রোহান ছিল একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক। তার কাছে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল টাকা। সে বিশ্বাস করত, টাকা থাকলে সম্মান, ক্ষমতা, সুখ—সবকিছুই কেনা যায়। তাই সে দিনের পর দিন নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখত। বন্ধুবান্ধব, পরিবার, সামাজিক জীবন সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে এনেছিল। তার একমাত্র সঙ্গী ছিল তার অফিসের ল্যাপটপ আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হিসেব।
একসময় রোহান তার লক্ষ্যে পৌঁছাল। তার একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, একটি দামী গাড়ি এবং একটি বিশাল অঙ্কের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হলো। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সে নিজেকে আগের থেকেও বেশি একা এবং শূন্য অনুভব করল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টটি যেন তাকে গ্রাস করতে আসত। দেওয়ালে ঝোলানো দামী শিল্পকর্ম, কোণায় রাখা দামী শোপিস—সবকিছুই যেন তাকে উপহাস করত।
একদিন, তার বিল্ডিংয়ের নিচে সে একটি ছোট্ট, লিকলিকে কুকুরছানাকে দেখতে পেল। সম্ভবত কেউ তাকে ফেলে গেছে। রোহান সাধারণত এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। কিন্তু আজ কেন জানি না, কুকুরছানাটির বিষণ্ণ চোখ তাকে আকর্ষণ করল। সে তাকে তুলে নিলো এবং বাড়িতে নিয়ে গেল। কুকুরছানাটির নাম দিল 'বাদাম'।
প্রথম ক'দিন বাদামকে নিয়ে সে বিরক্তই হয়েছিল। তার অফিস থেকে এসে বাদামের দেখভাল করা, তাকে খাওয়ানো—এসব কাজ তার কাছে বাড়তি ঝামেলা মনে হত। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু বদলে গেল। বাদামের সরলতা, তার নিঃশর্ত ভালোবাসা রোহানের মন জয় করে নিল। অফিস থেকে ফিরতেই বাদাম লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে আসত, তার জুতো কামড়াত আর সারা শরীরে যেন আনন্দ প্রকাশ করত।
রোহান খেয়াল করল, বাদামের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো তার জীবনে এক নতুন আনন্দ নিয়ে এসেছে। সে আর আগের মতো একা অনুভব করে না। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, একটি পোষ্যর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এক বিশেষ বন্ধন তৈরি করে, যা মানসিক চাপ কমাতে, একাকীত্ব দূর করতে এবং সামগ্রিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সাহায্য করে। বাদামের সঙ্গ তাকে এক নতুন জীবনের সন্ধান দিল। সে বাদামকে নিয়ে পার্কে যেত, তার সঙ্গে খেলা করত এবং সেই মুহূর্তগুলোতেই সে সত্যিকারের সুখ অনুভব করত, যা সে তার ব্যাঙ্কে জমানো টাকা দিয়ে কখনোই কিনতে পারেনি।
একটি দুর্ঘটনা এই সত্যটাকে আরও স্পষ্ট করে দিল। বাদাম একবার মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার চিকিৎসার জন্য এক বিশাল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হলো। রোহান এক মুহূর্তও দ্বিধা করেনি। সে তার জমানো টাকা থেকে সবটুকু খরচ করে বাদামের জীবন বাঁচাল। এই ঘটনা তাকে উপলব্ধি করাল, টাকার চেয়েও মূল্যবান হলো সম্পর্ক। বাদামের নিঃশর্ত ভালোবাসা, তার প্রতি রোহানের দায়িত্ববোধ—এসবের কাছে তার সব টাকা তুচ্ছ।
গল্পের শেষে, রোহান একজন সুখী মানুষ। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের অঙ্ক হয়তো আগের মতো বাড়ছে না, কিন্তু তার জীবন পরিপূর্ণ। সে বুঝতে পেরেছে, অর্থ একটি প্রয়োজন মাত্র, কিন্তু সম্পর্ক হলো জীবনের মূল ভিত্তি। টাকা দিয়ে হয়তো বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনা যায়, কিন্তু সেখানে সত্যিকারের ভালোবাসার একটি কুকুর যদি না থাকে, তবে তা শুধুই একটি কংক্রিটের কাঠামো। বাদাম তাকে শিখিয়েছিল, জীবন মানে শুধুই অর্জন নয়, সম্পর্ক দিয়ে জীবনকে পূর্ণ করা।