
13/04/2025
নিশিথে কুঞ্জবনে – একটি ভৌতিক গল্প (বাংলায়, ১০০০ শব্দের মধ্যে)
---
পল্লবপুর গ্রামটা ছিল শহর থেকে অনেক দূরে, কুয়াশায় ঢাকা এক নির্জন স্থান। গ্রামের প্রান্তে ছিল এক পুরনো বন—লোকেরা তাকে "কুঞ্জবন" বলে ডাকত। বলা হয়, ওই বনে রাত নামার পরে কারও ঢোকা নিষেধ। অনেক পুরনো গল্প ঘুরে বেড়াত—কেউ কেউ বলত, ওখানে নাকি ভূতের আস্তানা, কেউ বলত অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, আবার কেউ বলত বনের মধ্যে আলো জ্বলে, আবার নিভে যায়।
তবে এইসব গল্পকে পাত্তা দিত না অরণ্য। শহর থেকে পড়াশোনা শেষ করে সে সম্প্রতি গ্রামে ফিরেছে। যুক্তিবাদী, নির্ভীক—এইসব "গ্রামীণ গাঁজাখুরি"তে সে মোটেই বিশ্বাস করত না।
এক সন্ধ্যায় সে তার বন্ধুবান্ধবদের বলল, "আমি আজ রাতে কুঞ্জবনে যাব। দেখি কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে!"
সবাই চমকে গেল। "পাগল নাকি? সেখানে কেউ যায় না," বলল তার বন্ধু নিপু।
"তুমি গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না," ফিসফিস করল অরিন্দম।
অরণ্য হেসে উঠল, "ভয়ের কিছু নেই। আমি প্রমাণ করব এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছু না।"
রাত ১১টা। অরণ্য একটা টর্চ, ক্যামেরা আর একটা পকেট ডায়েরি নিয়ে রওনা দিল কুঞ্জবনের দিকে। রাতের বেলায় গ্রামটা যেন নিস্তব্ধতার পাথরে ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু শোঁ শোঁ বাতাস, আর মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক।
বনের ধারে পৌঁছেই অরণ্য টর্চ জ্বালাল। গা ছমছমে নিঃস্তব্ধতা চারপাশে। গাছগুলো যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে। পা ফেললেই শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। হঠাৎ এক জায়গায় এসে সে থমকে গেল—টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল, মাটিতে পায়ের ছাপ, একেবারে উলটো দিকে এগিয়ে গেছে। মানুষের মতোই, কিন্তু যেন একটু বড় আর লম্বা।
"হয়তো কারও দেরিতে ফেরা হয়েছে," অরণ্য নিজেকে বোঝাল।
তবুও সে এগিয়ে চলল। হঠাৎ একটা ঝোপের পাশ থেকে ভেসে এল এক মৃদু হাসির শব্দ। স্পষ্ট, কিন্তু অদ্ভুত।
"কে?" অরণ্য জিজ্ঞাসা করল।
কোনও উত্তর নেই। সে টর্চটা সেদিকে ফেলল—কিছুই নেই। কিন্তু টর্চ নিভে গেল। হঠাৎ করেই সব নিস্তব্ধ, আর গা ছমছমে হয়ে উঠল পরিবেশটা।
তৎক্ষণাৎ ঝোপের ভেতর থেকে দেখা গেল—এক জোড়া চোখ! জ্বলজ্বলে, গভীর, রক্তবর্ণ। অরণ্য পেছনে হটতে চাইলে দেখল, তার ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে!
সে ঘুরে তাকাতে না তাকাতে ঠাণ্ডা একটা নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশটা কুয়াশায় ঢেকে গেল। সে দৌড়াতে শুরু করল, কিন্তু তার পা যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। বনটা যেন বদলে গেছে—যে পথ দিয়ে ঢুকেছিল, সেটা যেন নেই আর। চারদিকে কেবল গাছ, কুয়াশা, আর অজানা ফিসফিসানি।
একটা পুরনো ঝরঝরে কুঁড়েঘরের সামনে এসে থামল সে। ভেতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। হালকা চিৎকারের মতো আওয়াজ আসছে। অরণ্য সাহস করে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
ঘরের মধ্যে ছিল একটা কাঠের টেবিল, তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের হাড়গোড়, আর এক কোণে বসে আছে এক বৃদ্ধা—চুল সাদা, চোখ দুটো গভীর কালো, ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি।
"এসেছো, অরণ্য," সে বলল।
"আপনি কে? আপনি জানেন আমার নাম?" অরণ্য চমকে উঠল।
"আমি অনেক কিছু জানি। আমি এই বনের রক্ষক। যারা অহংকার করে, যারা বিশ্বাস করে না, তাদের আমি স্বাগত জানাই... চিরকালের জন্য।"
হঠাৎ ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। অরণ্য চিৎকার করল, কিন্তু তার গলা থেকে শব্দ বেরোচ্ছে না। চারপাশটা ঘুরতে লাগল। সবকিছু একসঙ্গে ভেঙে পড়ল তার চারপাশে।
..
পরদিন সকাল। গ্রামের লোকেরা শুনল কুঞ্জবনের ভেতরে কারও চিৎকার।
পুলিশ আর কয়েকজন সাহসী গ্রামবাসী মিলে বন খুঁজতে গেল। তারা খুঁজে পেল একটা পুরনো কুঁড়েঘর—তবে সেটা ছিল ধ্বংসস্তূপ। ঘরের মাঝখানে ছিল অরণ্যের ক্যামেরা আর ডায়েরি।
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল:
"সে এসেছে। আমি জানতাম না... আমার ভুল হয়েছে। যারা পড়ছো, ফিরে যাও। এ বন মানুষকে ফিরতে দেয় না..."
গ্রামে আজও কুঞ্জবনের দিকে কেউ যায় না। রাতে বনের দিক থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে এক মৃদু হাসির শব্দ।
যেন অরণ্য এখনও কারও সাথে কথা বলছে।