18/10/2024
পুজোর_লেখা/১
একেই_বলে_সভ্যতা
সভ্য মানুষ কাদের বলে জানেন?
সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙ্গুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসীসমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের পর সত্যজিতের মতন করে বাঙালিদের মধ্যে এই সভ্যতাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে আর কে ই বা পেরেছেন! নিজের আশি বছর বয়স অতিক্রান্ত হবার পর রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত চিত্তে সমগ্র মানবজাতির জীবনে দেখেছেন 'সভ্যতার সংকট'।নিজেদের ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নখ-দন্ত বের করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে। কবি যখন সভ্যতার সংকট লিখছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুরু হয়ে গেছে।রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, ‘মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ চরিত্রে। তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম’। অতঃপর রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ,"প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে"।
মোহভঙ্গই সভ্যতার চিরকেলে সুর।
চরম বৈপরীত্যই সভ্যতার দস্তুর। একদিকে আলো, অন্যদিকে অন্ধকার। একদিকে যন্ত্রণা, হাহাকার এবং সেই যন্ত্রণা বিদ্ধ মানুষের পাশে বেশকিছু মানুষের অবস্থান, অন্যদিকে আরো কিছু মানুষের তির্যক মন্তব্যে তাঁদের বিদ্ধ করা। এটাই তো চিরাচরিত সভ্যতার রূপ। দুনিয়াজুড়েই।
বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া যখন প্রতিটি মানুষের মুখে রুটি তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, সাম্যের বাণী দিয়ে মানবসভ্যতার উত্তরণের সিঁড়ি তৈরি করার চেষ্টা করছিলো, এর বিপরীতে এদেশে অন্য ছবিও দেখেছিলাম আমরা।
সেই ছবি কোনো সাধারণ মানুষের মধ্যে নয়, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেই। নাম, নলিনীকান্ত গুপ্ত। তিনি শ্রীঅরবিন্দের শিষ্য।
শ্রীঅরবিন্দ পণ্ডিচেরী যাবার পর তিনিও ছয় মাস পরে মণীন্দ্রনাথ রায় ছদ্মনামে পণ্ডিচেরী চলে যান । এখানে তিনি সাহিত্যসাধনা এবং যোগসাধনা শুরু করেন । এই নলিনীকান্ত 'বলসেভিক' বিপ্লবকে আক্রমণ করেছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। তখন তো আর সোস্যাল মিডিয়া ছিলো না। পত্রপত্রিকাই ছিলো মাধ্যম। তো, নলিনীবাবু'র অভিযোগ ছিলো এই যে, "উহা ( বলসেভিক বিপ্লবের বাণী)নাস্তিক্য-বুদ্ধি,গীতার কথায়, তামসজ্ঞান প্রসূত। গীতা দিয়ে তিনি বলসেভিক বিপ্লবের বিচার করে সকলের মুখে রুটি নয়, অমৃত তুলে দেওয়ার নিদান দিয়েছিলেন এবং রুটি রিজেক্ট করেছিলেন। নলিনীকান্তের এহেন উক্তি পড়ে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল। শিবরাম চক্রবর্তী, যাঁকে আমরা রস সাহিত্য সৃষ্টিকর্তা হিসেবে জানি, তিনি লিখে ফেললেন," মস্কো বনাম পন্ডিচেরি"। জানিনা বইটা কতজন পড়েছেন! এই বইয়ে আমরা এক অন্য শিবরাম চক্রবর্তীকে পেলাম। শ্রদ্ধায় মাথা নত করলাম। না, এখানে পন্ডিচেরি'র বিরোধিতা নয়, তাঁর লেখার মূল লক্ষ্য নলিনীকান্ত গুপ্ত।
সভ্যতার প্রতিটি মাইলস্টোনেই এই বিরোধিতা লক্ষ্য করি আমরা। একদল বিরোধীকে আপনি পাবেনই। মজার কথা হ'ল, এই বিরোধিতা শিক্ষিত সমাজের একাংশের মধ্য থেকেই উঠে আসে। এদেশে যখন ট্রেন চালু হওয়ার তোরজোর চলছিলো, এদেশের বিদ্বজ্জনেরাই আপত্তি তুলে চিঠি দিয়েছিলো। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে।ট্রেনের হুইসেল শুনে মাঠেঘাটে গরু চমকে দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সমস্যাটা আম জনতাকে নিয়ে নয়। যাঁরা শিক্ষিত সম্প্রদায়, টনটনে অক্ষরজ্ঞান, রেফারেন্স টেনে কথা বলেন....এই সভ্যতা বারেবারে তাঁদের দ্বারাই বেশি আক্রান্ত হয়। কেন মহাষ্টমীর দিন বেলুড়ে কুমারী পূজায় শুধুমাত্র খাঁটি ব্রাহ্মণ কন্যাকেই পুজো করা হবে, অন্য জাতের নয় ; এ প্রশ্ন করায় আমি উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের দ্বারাই শব্দব্রহ্মে আক্রান্ত হয়েছি।
এটাই তো হওয়ার কথা। এটাই সভ্যতার দস্তুর।
আর তাই সত্যজিতের শেষ ছবির মনমোহন মিত্র শেষ দৃশ্যে আশ্রয় নেন শান্তিনিকেতনের জনজাতিদের মধ্যে। বিদ্যাসাগর ঘৃণায় এই শহুরে সভ্যতা থেকে সরে গিয়ে বাসা বাঁধেন কার্মাটাড়ে।
আর যা যা উহ্য রাখলাম,পাঠকের মগজাস্ত্রের খাদ্য হিসেবে রেখে গেলাম।
সংগৃহীত