
15/05/2025
❤️
•• রঙহীনার কল্পরঙ ••
এই শহরে, যেখানে রঙ-মাখানো আনন্দেরা অজস্র বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে জনারণ্যে, ঠিক সেই বিপরীতে—এক নারী, এক বসন্ত-বঞ্চিত আত্মা, সন্ধ্যার নির্জন ছায়া মেখে, নিঃশব্দে আশ্রয় নেয় বাসের জানালার ধারে।
অর্না, জন্ম থেকে তার জীবনের রং ছিল সংযমের ছদ্মবেশে ঢাকা, যেখানে প্রতিটি ইচ্ছের গায়ে চাপানো হত 'সংস্কার' নামক রঙহীন কাপড়। তার শৈশব মানে ছিল — প্রেম না করা,
নাচ না শেখা, সাজগোজ না করা; কারণ, মেয়েদের জন্ম হয় কেবল একটিমাত্র গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য—বিয়ে।
বাবার একরোখা কর্তৃত্বে যে সংসারে তার ফুলচন্দনের গন্ধ চাপা পড়ে গিয়েছিল আতঙ্কে, সেই সংসারেই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এক অচেনা পুরুষের শয্যায়— যার সঙ্গে শারীরিকতা ছিল, কিন্তু হৃদয়ের স্পর্শ ছিল না; যার সঙ্গে ছাদের ভাগ ছিল, কিন্তু স্বপ্নের কোনও সহবাস ছিল না।
অবশেষে এক দিন মৃ'ত্যু এসে তার কোলে শুয়ে থাকা স্বামীকে ছিনিয়ে নিল। আর সমাজ, তাকে উপহার দিল এক আজন্মপালিত শব্দ— 'বিধবা'।
তারপর থেকে রং তার শরীর ছেড়ে কেবল স্মৃতির আলমারিতে বন্দি হয়ে গেল।
ল্যাভেন্ডার, নীল, কাঁচা সবুজ — সব তার কাপড়ের গায়ে মরলো; আর জন্ম নিল শুধু ধূসর। যে ধূসর এমন এক যন্ত্রণার রঙ — যা বাঁচার মতো মৃ'ত্যু, আর মৃত্যুর মতো প্রতিদিনের বেঁচে থাকা।
না, অর্নার জীবনে কোনো প্রণয়পর্ব ছিল না, ছিল না এমন কেউ যে তার ঠোঁটে রং ছুঁয়ে দেবে। যা ছিল তা শুধুই সমাজস্বীকৃত এক বোঝা, যা অকালে শেষ হয় এক নিঃশব্দ শোকগাঁথায়। সেই থেকে তার শরীরের শাড়ি, তার ওড়নার প্রান্ত, সবটা হয়ে উঠেছে ধূসর বিবর্ণতায় মগ্ন। একটা স্থির চিত্র, যেখানে বসন্ত নিজেই বিস্মৃত।
তবে আজ, এই হোলির আগের সন্ধ্যায়, তার হাতের ব্যাগে রাখা নিমন্ত্রণপত্রের কম্পিত হস্তাক্ষর এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয় তার রক্তে— “রং যেখানে কথা বলে।”
সে ভাবে, এই কি সেই চিরকালীন নির্বাক প্রেমিক? যার চোখে সে দেখেছিল এক অপার্থিব কল্পলোক! যে তাকে ভালবেসেছিল, অথচ ছুঁয়েও দেখেনি। যার ক্যানভাসে সে ছিল একমাত্র মুখ, যার ঠোঁট হয়তো চুপ ছিল, কিন্তু তুলি ছিল নীরব অনুভূতির আর্তনাদে মগ্ন?
বাস থামে এক আর্ট গ্যালারির সম্মুখে। অর্না পা রাখে গ্যালারির ভেতরে, আর চারিদিকে ঝুলে থাকা রঙিন দাহ যেন তাকে গ্রাস করে মুহূর্তেই! সেইসব ছবিগুলো কেবল চিত্র নয়, ওগুলো যেন অসংখ্য অপ্রকাশিত অনুভূতির ব্যঞ্জনবর্ণ, যাদের রঙ কেবল চোখ নয়, হৃদয় শুষে নেয়;
ঠিক যেনো এক প্রেমিক হৃদয়ের মহাকাব্য — ক্যানভাসে ক্যানভাসে এঁকে রাখা তার মুখ, তার অভিমান, তার না-বলা কথা! তার শূন্য বুকের পাঁজরে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাস। একটি বিশেষ ক্যানভাসের সামনে থমকে যায় সে, চোখ দুটি তারই, মুখও তারই। কিন্তু পেছনে ছড়িয়ে থাকা রঙের বিস্ফোরণ যেন বলে দেয়, যে বাস্তবে রংহীন, সে'ই কারোর কল্পনায় সবচেয়ে রঙিন! ছবির নিচে লেখা— "প্রতীক্ষার রঙ – ২০০৮"
তার পেছনে তখন দাঁড়িয়ে চিত্রশিল্পী অর্ঘ্য,
যার চোখে রঙ নেই, তবু কণ্ঠে আগুন জ্বলে ওঠে, “অর্না, আমার ক্যানভাস কোনো দিন একা ছিল না। তুই ছিলি তার প্রতিটি রেখার শিরা-উপশিরায়, তুই ছিলি ছায়া হয়ে, রং তুলির প্রতিটি নিঃশ্বাসে। তুই বাস্তবে বিবর্ণ, কারণ সমাজ তোকে রাঙানোর অধিকার কোনও দিন আমার কণ্ঠে রাখেনি। কিন্তু কল্পনায়? আমি তোকে রোজই রাঙিয়েছি। কখনও অভিমানের গাঢ় লালতায়, কখনও নীরব চুম্বনের ধূসর নীলছায়ায়, আবার কখনও তোর শোকাতুর স্তব্ধতাকে জড়িয়ে তুলি দিয়েছি এক অনর্গল নিবিড় নিঃশ্বাসে।
তুই আমার রঙের ঈশ্বরী—
বাস্তবের অন্ধকারে যাকে ছুঁতে পারিনি,
তবু কল্পনার গোধূলি-আলোয় প্রতিদিন
তোর বুকের নিষিদ্ধ বেদনার উপর
রঙ ছুঁড়ে দিয়েছি প্রেমের আদিম ধর্মে।”
অর্না কিছু বলে না, শুধু তার চোখের কোণে জমে থাকা এক জলবিন্দু ধীরে ধীরে ক্যানভাসের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। সেই জল, যা রঙের চেয়ে অনেক বেশি রঙিন, হৃদয়ের অনুভূতির চেয়ে অনেক বেশি গভীর। আজ সে কারোর কেউ নয়, তবে সে সে'ই কেউ, যার জন্য সৃষ্টির প্রতিটি আঁচড়ে অজানা প্রেমের শিল্প জন্ম নেয়। সে শিল্পের মাঝে, ধূসর বাস্তবতার পরও, অর্না কল্পনার রঙে বেঁচে থাকে — যে রঙ বাস্তবে তার ছিল না, কিন্তু কল্পনা-লোকে সে বড্ড রঙিন।
• কলমে:- উর্মি ইভা
#ইশতেহার