07/04/2025
আজকে কলেজের প্রথম দিন ছিল গৌরবের। দিন বেশ ভালোই কেটেছে তার। কলেজ থেকে ফিরে নিজের হোস্টেল রুমে ঢুকে সব জিনিস সরিয়ে রেখে একটু বিছানার সাথে গা এলিয়েছিল সে, কখন যে চোখ লেগে আসে বোঝেনি। রাত তখন গভীর চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন...হুট্ করে সেই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে এক নারীর পায়ের নুপুরের শব্দ বেজে উঠলো তার কানে। সে ঘুমের ঘরেই অনুভব করলো তার শরীরে এক নারী মূর্তির স্পর্শ। সে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারছে, সেই হাত আসতে আসতে তার পা বেয়ে উঠে তার পেট হয়ে উঠে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো তার বুকের ওপর। আসতে আসতে সে বুঝতে লাগলো তার বুকের ওপর হাত বোলাচ্ছে সেই নারী, সে চুম্বনের অনুভব করতে লাগলো তার ঘাড়ে। আসতে আসতে গৌরবের সেই স্বর্গ সুখ এক বিভীষিকায় রূপান্তরিত হয়ে গেলো... মনে হলো তার বুকের মধ্যে কেউ তার বাঘিনীর বড়ো ধারালো নখ দিয়ে আছড়ে দিচ্ছে শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে তার।
সে ধড়ফরিয়ে উঠে বসলো বিছানায়, নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের ঘরে। সারাদিনের ক্লান্তিতে এটা নিতান্তই তার কল্পনা ভেবে এবং এমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখায় মনে মনে একটু লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে। পরের দিন কলেজে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে স্নান করার সময় বুকে আবিষ্কার করে সেই আঁচড়ের দাগ। মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পরে খানিক্ষণের জন্য তবে পরক্ষণেই নিজের মনকে বুঝিয়ে, স্নান করে তৈরী হয়ে কলেজের জন্য বেড়িয়ে পরে।
অনেক দিন যেতে লাগলো। সবই ঠিক ছিল কিন্তু সেই রাতে ঘুমোনোর পর সেই নারীর তার গুপ্ত জায়গায় স্পর্শ করা থেকে শুরু করে আরো যা যা অনুভূতি সেইগুলো বাড়তে লাগলো।
কলেজের বেশ কিছু দিন তার ভালোই কাটলো। বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো...গৌরব তাদের তার রুমে ডাকলো, হটাৎ কথায় কথায় তার হোস্টেলের কথাখানা আসতেই সবাই চুপ করে গেলো। কেউ সেই প্রসঙ্গে তেমন উৎসাহ দেখিয়ে কথা বললো না।
শুধু গৌরব কে বললো — "ভাই যদি কোনো দরকার পরে আমাদের রুমে এসে থাকতে পারিস। অথবা ডাকতে পারিস রাতে কোনো অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় জানাস ভাই।"
ওদের হুট্ করে এমন আচরণে রুমে যাওয়া অস্বীকার করা ঠিক মনে ধরলো না। পরে হয়তো ভাবলো সে নতুন বলে তার সুবিধা অসুবিধার কথা খেয়াল রাখতে যেতে সে বিরক্ত বোধ না করে।
কলেজ শেষে নিজের রুমে এসে গৌরব গা, হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে লক্ষ্য করলো....তার রাখা কিছু জিনিস এই ধার থেকে ঐধার ওলোট পালোট হয়ে আছে। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে সে ফোনের চার্জারখানা বিছানার অপর রেখেছিলো।
এইবার আসতে আসতে একটু অস্বস্তি হতে লাগলো গৌরবের। হুট্ করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হতে লাগলো এই রুমে সে একা না আছে কেউ তার সাথে।
সে যখন থেকে ঢুকেছে রুমে তাকে কেও লক্ষ্য করে যাচ্ছে সমানতালে। তার স্নান করার সময়ে তার নগ্ন দেহর দিকে কারোর দৃষ্টি থাকে, সে ঘুমোলে তার কাছে আসে সে, সে কোনো কাজ করলে তার পেছন দিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে। এই রুমের কোনো এক দেয়াল থেকে দুটো চোখ যেন দেখছে তাকে।
হুট্ করে সে তার ঘাড়ে একটি হাতের স্পর্শ পেলো। কেঁপে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তার এক বন্ধু ঋষভ।
ঋষভ — ভাই কতক্ষণ ধরে কল করছি! বাধ্য হয়ে চলেই এলাম তোর খাতাটা নিয়ে। তুই ক্লাসে ফেলে এসেছিলি...নে ধর...... আসি রে।
গৌরব — ঋষভ দাঁড়া! ভাই তোর সাথে কিছু কথা ছিল.....
ঋষভ — হ্যাঁ বল না, কি বলবি ?
গৌরব — আজ রাতটা একটু তোর সাথে থাকতে দিবি রে ভাই তোর রুমে?
ঋষভ — হ্যাঁ কেন দেবো না? এতে আবার এভাবে বলার কী আছে? তুই আমার ভাইয়ের মতন রে, নিশ্চয়ই চলে আয়।
সারা সন্ধ্যে কোনো অসুবিধা হয়নি। দুই বন্ধু একসাথে খেয়ে-পড়ে উঠে ঘুমিয়েছে....রাত তখন গভীর।
গৌরবের চোখ নুপুরের ছমছম আওয়াজে খোলে। সে চোখ মেলে দেখে বারান্দা দিয়ে এক নারী মূর্তি কার্নিশের ওপর হাঁটছে আর গৌরবের দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্করভাবে হাসছে। গৌরব আতঙ্কে চোখ সরাতেই রুমের সিলিং এর ওপর দেখে সেই নারী মূর্তি উল্টো ঝুলে তাকিয়ে আছে!
এটা কী ভাবে সম্ভব!?
পাশে হাত দিয়ে দেখে তো সেখানে ঋষভ নেই!
তার জায়গায় সেই নারী মূর্তি শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে এখন তার গায়ের ওপর উঠে, তার বুকে সমানতালে আঁচড়াচ্ছে।
গৌরব একটি জোরে আর্তনাদে করে উঠে পরে উঠে সে চেঁচাতে আরাম্ভ করে তার এহেনো আর্তনাথ শুনে ঋষভ ঘরে ঢুকে বলে...
ঋষভ — কী হয়েছে ভাই? চিৎকার করছিস কেন? আরে আমি একটু ওয়াশরুম গেছিলাম তার মধ্যে তুই উঠে পড়েছিস কেন?...একি গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!
গৌরব — ওই মেয়েটা....ও আমাকে মেরে ফেলবে! ওর উপস্থিতি আমি প্রতি মুহূর্তে টের পাই, আতঙ্কে জর্জরিত করে রাখে আমাকে...আমি আর বাঁচবো না।
জোরে কাতরাতে কাতরাতে গৌরব বলতে থাকে
ঋষভ — আহঃ! তুই দাঁড়া আমি জল পট্টির ব্যবস্থা করছি, জ্বরের ঘোরে ভুল বোকছিস তুই...
সেই রাতরা কাটে কোনো ভাবে সকালে গৌরবকে চোখ খুলতে দেখে তার মাথার কাছে ঋষভের সাথে তার বন্ধু অনিমেষ দাঁড়িয়ে আছে।
অনিমেষ — হ্যাঁ রে ভাই! কিসব শুনছি? তুই নাকি মাঝরাতে চিৎকার করছিলি...তার পরেই নাকি জ্বর এসেছে
ঋষভ — গৌরব, কোনো অসুবিধা হলে আমাদের বলতে পারিস...
গৌরব — তোরা কেউ বুঝতে পারছিস না! ওই মেয়েটা!! মেয়েটা শেষ করে দেবে আমাকে!!!
বলে সে আবার চিৎকার করতে শুরু করলো।
ঋষভ — আচ্ছা আচ্ছা বলতে হবে না তুই শান্ত হয়ে শুয়ে থাক এখন উত্তেজিত হোশ না।
কয়েকদিনের মধ্যে আর তেমন কোনো অসুবিধা হয়না আসতে আসতে গৌরব সুস্থ হয়।
এই কয়েকদিন ঋষভ আর অনিমেষ ছিল তার সাথে তার রুমে, আসতে আসতে যে যার কাজে বেস্ত হয়ে পরে। এই কয়েক দিনে অনেক অ্যাসাইন্মেন্ট জমে গেছে কলেজে গৌরবের। ফলেই সে তার বিছানার অপর বসে বসে সেই গুলো শেষ করা আরম্ভ করে। মনোযোগ সহকারে কাজ করছিলো সে, তখন প্রায় রাত ২:৩০ তার জানলায় সে কারোর জোরে জোরে প্রহর করার শব্দ শুনতে পেলো। সে দেখতে লাগতো তার সাড়া ঘরের দেয়াল থোড় থোড় করে কেঁপে চলেছে। সে মনে সাহস সঞ্চয় করে জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেখলো কার্নিশ দিয়ে একটি নারী মূর্তি তার দিকে তাকিয়ে ঝুলছে। সে আর ১ মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কল করে ঋষভ কে।
গৌরব – ঋষভ, ভাই জেগে আছিস?
ঋষভ – কি হয়েছে কি আবার?
গৌরব – তুই যথাসম্ভব আমার রুমে একটিবার আসবি ভাই প্লিজ? জানালার বাইরে না কে ঝুলছে! পুরো ঘর কাঁপছে আমার।
ঋষভ – কিসব আজে বাজে বকছিস বলতো? দাঁড়া আসছি আমি, এসে দেখছি।
ঋষভ এসে সমানে দরজা ধাক্কাতে থাকে কিন্তু গৌরব কিছুতেই দরজা না খোলায়ে সে ঘাবড়ে যায়। ঋষভ ছুট্টে গিয়ে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন সহ আরো কয়েকজন কে ডেকে আনে। সবাই মিলে ডাকলেও গৌরব দরজা না খুলতে শেষে দরজা ভাঙা হয়। সবাই দেখে গৌরবের অর্ধনগ্ন শরীর বিছানার ওপর পরে আছে। হোস্টেলের ওয়ার্ডেন এবং ঋষভ জল ছেটাতে থাকে খানিকক্ষন পর গৌরবের জ্ঞান ফেরে সে পাগলের মতন করতে থাকে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে গৌরব উত্তর দেয়ে সে কিছু মনে করতে পারছেনা সে শুধুই "সেই মেয়েটা, সেই মেয়েটা" করে রীতিমতো চিৎকার করতে থাকে। গৌরবের মুখে "সেই মেয়েটা" শুনে ওয়ার্ডেনের মুখে চিন্তার ছাপ আসে। সেটা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনির্বান ঠিক লক্ষ্য করে।
পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গৌরবের রুম বন্ধ থাকবে এবং সে তার সমস্ত যাবতীয় বস্তু নিয়ে ঋষভের ঘরে শিপ্ট করবে।
বেশ কয়েক মাস পর...। অনির্বান জোরে জোরে ঋষভের এবং গৌরবের রুমের দরজা ধাক্কাতে থাকে...।
অনির্বান – ভাই, ভাই দরজা খোল ভাই!!
ঋষভ – কি হয়েছে? এমন করে কে ধাক্কায় ভাই!
গৌরব – আচ্ছা আসতে আসতে হ্যাঁ রে ওকে একটু জল দে।
অনির্বান – ঐসব ছাড় ভাই আমি যেটা বলছি ওটা আগে শোন্! গৌরবের আগের রুম টার সম্পর্কে আমি বহুদিন ধরে খোঁজ চালিয়েছি আলটিমেটলি জানতে পেরেছি ওই ঘরের রহস্য।
তারপর যা বললো অনির্বান সেটা শুনে পুরো রুমটা শান্ত হয়ে যায়, সবাই স্থির হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষন।
গৌরবের ওই রুমটি তে থাকত একটি মেয়ে। একদিন এক সিনিয়রের প্রপোসাল একসেপ্ট না করার জন্য তাকে তার ই রুমে গ্যাং রেপ করা হয়ে এবং তাকে সেই দেওয়াল খুঁড়ে ওখানেই দাফন করে দেওয়া হয়ে। এবং ক্ষমতাবান হওয়ার ফলে ঘটনাটি ওখানেই চাপা পরে যায়।
আচ্ছা এই সমাজে সত্যিই কি মেয়েদের "না" শব্দটি উচ্চারণ করার কোনো অধিকার নেই? কিছু পুরুষের ইগো, আত্মঅহংকার, পুরুষত্ব কি এতটাই ঠুনকো, যে একটি না শব্দ ভেঙে দিতে পারে? হিন্দু ধর্মে নারী শক্তিকে পুজো করা হয়, তাহলে নারীদের কেন কোনো সম্মান নেই বলতে পারেন?? আজ ২০২৫ সমাজ অনেক উন্নত। কিন্তু ইচ্ছে হলো লেখার ভাষায় প্রতিবাদ করার আগের কিচ্ছু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
কলমে - #অলিগলি_কালান্তর
ছবি সংগৃহীত