17/10/2024
অমলের ঘরের লক্ষী যেন কোথায় হারিয়ে গেলো।। আজ কোজাগরী লক্ষী পূর্ণিমা, সকাল থেকেই পুজোর তোড়জোড় লেগে রয়েছে। অমলকে একা হাতেই সবটা সামলাতে হচ্ছে। বাড়ির অবস্থা বিশেষ ভালো না। প্রথমত তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা, পরশু তার ডেলিভারি। সে ইতিমধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি। তার উপর তার মায়ের বয়েস বেড়েছে। তার বাবার দেহত্যাগের পর থেকেই কেমন যেন মন মরা হয়ে গেছেন তিনি। আগে যেমন টা দাপুটে ছিলেন, তার থেকে অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছেন যেন। বাড়ির কোনো পুজো কর্মেই তার বিশেষ মন নেই, নিজের লেখালিখি ও বই পড়া নিয়েই সারাদিন থাকেন। তার স্ত্রী র সাথে তার মায়ের সম্পর্ক বেশ ভালো, মাঝে মধ্যে গল্প গুজব করে দুজনে। তার স্ত্রী ই তাকে বলে যে মায়ের মধ্যে অনেক বদল হয়েছে। সারাদিন কি যেন ভাবতে থাকেন তিনি। তার সাথে গল্প করার সময়েও বিশেষ কিছু বলেন না। এই হেন পরিস্থিতি তে আজকে এমন এক উটকো ঝামেলা এসে পড়বে অমল ভাবতেই পারেনি। সকাল বেলা ঠাকুর ঘরে ছোট্ট লক্ষীর মূর্তি টা এনে ঠাকুর ঘরটা একটু বন্ধ করেই রেখেছিলো অমল। বিড়াল ইঁদুর অনেক সময় ঢুকে পড়ে আর কি। বাইরে লক্ষী পুজোর সব বাজার করে এনে রেখে, দরজা খুলে দেখে, তার ঘরের লক্ষী নেই!!
যেন বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে মূর্তি টা। না চোর চুরি করলেও, ঠাকুর ঘরের ঠাকুরের গয়না না নিয়ে হঠাৎ মূর্তি চুরি কেন করবে?
দরজা খুলে এমন অদ্ভুত একটা চিত্র দেখে পেছন ঘুরে মায়ের ঘরের দিকে যেতে যাবে অমল হঠাৎ করেই, চারিদিক অন্ধকার। একি! এমন ভর দুপুর বেলা এতো অন্ধকার নেমে এলো কেন, মাথার ভেতর টা কেমন যেন দপদপ করতে শুরু করলো অমলের, অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলো। সেই অন্ধকার কে ভেদ করে হঠাৎ ই অমলের চোখে পড়লো একটা সাদা আলো, আলোটা এগিয়ে আসছে অমলের দিকে। কি এটা? তবে কি অমল মরীচিকা দেখছে জেগে জেগে, কি হচ্ছে তার সাথে? কিছু মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারায় অমল।
চোখ খুলতেই অমল অবাক হয়ে যায়! এ কোথায় এসে পড়েছে সে? একটা সবুজ আভা যেন জড়িয়ে রয়েছে গোটা জায়গা টায়। তার থেকে কিঞ্চিৎ দূরত্বে বসে, তার মা, একটা টেবিলের উপর কিছু একটা লিখছেন তিনি। হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে আসলো এসে, তার মায়ের কোলের উপর এসে বসলো। কি মিষ্টি দেখতে বাচ্চা মেয়েটা কে। পরনে ছোট্ট লাল শাড়ি, গায়ের রং সাদা তার মধ্যে একটা লালচে আভা মিশে, চোখে টানা টানা কাজল, কারুর সাথে যেন খুব মিল আছে মুখের! মেয়েটা কে জড়িয়ে আদর করতে থাকে তার মা, হঠাৎ, অমল খেয়াল করে, মেয়েটির পরনে ছোট্ট লাল শাড়িটা যেন ভিজে যাচ্ছে কিছুতে, লাল কোনো তরলে, রক্ত? একি মেয়েটির শাড়িটা এতো রক্তে ভিজছে কেন! তার সঙ্গে ভিজছে তার মায়ের কোল। হাহাকার করছে তার মা, মেয়েটির ওই সুন্দর ফুটফুটে মুখের উপর হঠাৎ করেই ফুটে উঠলো আঁচরের দাগ, এ কিসের ইঙ্গিত? যেন মনে হচ্ছে অনেক গুলো নখ একসাথে ক্ষত করছে মেয়েটির শরীরে। এইটুকু বাচ্চা মেয়ের শরীরে এতো গুলো ক্ষতর দাগ হঠাৎ কেন? তার মায়ের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো বাচ্চা মেয়েটি। ঠিক তার পরের মুহূর্তে, সেই খানে উপস্থিত হয় অমলের বাবা, বাবার বয়েস অনেকটা কম। সে তার মায়ের কাঁধে হাত রাখে এবং পরোমুহূর্তে, তার মায়ের কোলে একটা ছোট্ট ছেলে, এই ছেলেটির মুখ চিনতে দেরি হয়না অমলের, এ যে তার নিজের ছেলেবেলা! বাবা সেই ছোট্ট ছেলেটি কে বলছে -"দেখ বাবু আমি তো সারাজীবন থাকবো না, মায়ের বন্ধু হোস তুই, জানিস বাবু, মায়ের খুব কষ্ট! তুই হয়তো কোনোদিন জানবি না যে তোর দিদি তোর ই বয়েসে পৃথিবী ছেড়েছে, কিছু নৃশংস লোকেরা তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে, এই খবর তোকে তোর মা জানতে দিতে চায়না, আমি তোর মায়ের স্বামী নই ওর সব থেকে কাছের বন্ধু, সেই বন্ধুত্বের উপর ভর দিয়ে ও অনেক কিছুর সাথে মোকাবিলা করে, ওর বন্ধু হয়ে থাকিস সব সময়, আর তোর যখন বিয়ে হবে, ঘরে লক্ষী নয়, বন্ধু আনিস যে রান্না ঘর নয়, মনের ঘর টা কে গুছিয়ে রাখবে!"
অমলের মা ভেজা চোখে বলে ওঠে -"তোর ঘরেও একটা ছোট্ট বন্ধু আসবে বাবু দেখিস! লক্ষী বন্ধু! আমরা মেয়েরা তো সারাজীবন অন্যের হয়ে বাঁচি, ঘরের লক্ষী চাই লক্ষী চাই বলে দাসী আনি! তুই ঘরে বন্ধু আনিস! আমার ওটাই দরকার! আর যেই লক্ষী বন্ধু আসবে, তাকে বলিস কোনোদিন যেন নিজের সুরক্ষার জন্য তোকে না লাগে, তাকে যজ্ঞ বানাস তার নিজের সুরক্ষা সে নিজেই যেন করে!"
হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে অমল। এ কি শুনছে সে! মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে নানান চিন্তা! বড় হওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন হারিয়ে গেছে তার আর মায়ের বন্ধুত্ব। ব্যস্ততা গ্রাস করেছে তাকে, তার স্ত্রী যথেষ্ট তার মা কে শ্রদ্ধা করে কিন্তু সত্যি কি বন্ধু হতে পেরেছে? তার দিদির ঘটনা! সে তো কোনোদিন জানতো না! এতো কিছু একা চেপে কি ভাবে রেখেছে তার মা!"
নিমেষে চিত্র বদলায় আবার, সে চোখের সামনে শুধু দেখতে পারে আবারো সে দাঁড়িয়ে তার ঠাকুর ঘরে আর সামনে লক্ষী মূর্তি! না এতক্ষনে সে বুঝেছে কেন সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের মুখটা তার এতো চেনা লাগছিলো। সেই মুখটার সাথে এই মুখের যে অনেক মিল!
এই মুখটা সে আবারো দেখলো, ঠিক দুদিন পর হাসপাতালে! তার মেয়ে হয়েছে যে, তার মুখ টাও যেই সেদিন দেখা ওই বাচ্চা মেয়ের মুখের মতন। অনেকদিন পর, সেদিন তার মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করতে দেখেছে অমল। হ্যা এলো তবে, লক্ষ্মী পুজোর পর, লক্ষ্মী বন্ধু!
লক্ষ্মীদের গল্প এরম ই না বলা হয়!
ছেলেদের ছোট থেকেই বলা হয়, ঘরে লক্ষ্মী বৌ আনতে, বা মেয়ে জন্মালে, ঘরে লক্ষ্মী এলো, কখনো বলেনা, একটা বন্ধু এনো, যে শুধু রান্না করা ঘর মোছা নয়, সবার মনের রানী হয়ে থাকবে, কখনো বলা হয়না যে ঘরে শুধু লক্ষ্মী জন্মায় নি, এক দশভুজা জন্মেছে সে সবাইকে আগলে রাখবে।
লেখায় ~ পার্থ