
06/01/2025
Wayfarers foodprint - এর এবারের সফর Mr. Greyhound কে সিল্ক রুটের সেল্ফ ড্রাইভ। গ্যাংটকের থেকে শুরু করে মাঝে একরাত ছিলাম জুলুকের ওপরেই লুংথু গ্রামে এই অপরূপ সুন্দর সূর্যোদয়ের সাক্ষী হতে।
https://youtu.be/jU4k1V_VRhE
গত পর্বের শেষে আমরা ছানগু লেক, নতুন বাবা মন্দির দেখে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছেছিলাম কুপুপ গ্রামের বর্ডারে। রংলী বা গ্যাংটকের থেকে করা পারমিটের একটি জেরক্স এখানে জমা করে, অরিজিনাল কপিতে স্ট্যাম্প মেরে তবেই আগে যাওয়ার অনুমতি মেলে। পারমিটের নিয়ম আগের পর্বে বিস্তারিত জানিয়েছি।
চেকপোস্ট থেকে এগিয়েই প্রথমেই কুপুপের বিখ্যাত এলিফ্যান্ট লেকের দেখা মিলবে। লেকের পাশে যাওয়ার রাস্তা থাকলেও, সেটা শুধুই মিলিটারির জন্য। আমাদেরকে পাহাড়ের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভিউ পয়েন্ট থেকেই দেখতে হয়।
লেকের শেষে হাতির শুরের মতন অংশ থাকায় একে সবাই এলিফ্যান্ট লেক নামেই চেনেন।
সিল্ক রুটের এই অঞ্চলের উচ্চতা অনেকটাই বেশি তাই বছরের বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে অল্প বিস্তর বরফের দেখা মেলে। আমরাও একটা সুন্দর টুকলা ভ্যালির পাশে কিছুটা বরফ দেখেই গাড়ি থামালাম। তবে গাছপালা ও অক্সিজেনের অভাব বোধ হয়, তাই উত্তেজনায় বেশি দৌড়াদৌড়ি করলে শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা প্রবল। অক্টোবরের শেষে বরফের মজা নিয়ে এগিয়ে চললাম।
মার্চ এপ্রিলে এই রাস্তা পুরোটাই বরফে ঢেকে থাকে। আরো এগিয়ে এলাম বাবা হরভজন সিংহের পুরোনো মন্দির আর বানকার দেখতে।
গাড়ি পার্ক করে, উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় সেই বানকারে। এছাড়াও নীচে রয়েছে ইন্ডো চায়না বর্ডারের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনী। পাশেই আছে ওনার সাজানো মন্দির, ও গিফ্ট শপ। মন্দিরে ওনার ছবি, মিলিটারি পোশাক, আরো কত কিছু রয়েছে। মন্দিরে প্রসাদ হিসাবে ছিল কিসমিস। এই জায়গাটি খুবই সুন্দর, একটু বসে চারপাশটা দেখলাম, নিচে রয়েছে nathang ভ্যালি, সময় হলে আমরা সেই গ্রামটি ঘুরে ও যাবো, সেখানেও রাত্রি বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। মিষ্টি পতাকা ও দিক নির্দেশক দেয়া সেলফি পয়েন্টে ছবি তুললাম নিজেদের।
শেষে মিলিটারি ক্যান্টিনের গরম চা, কফি,ম্যাগি বা ধোসা খেতে একদম ভুলবেন না।
প্রসঙ্গে জানাই, এই ন্যাশনাল হাইওয়ে 717B রাস্তার পুরোটাই মিলিটারির ব্যবহারের জন্য তৈরি, তাই তাদের সন্মান করবেন, প্রয়োজন হলে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতেও হতে পারে।
খানিকটা এগোতেই চোখে পড়লো heart লেকের। গাড়ি থামিয়ে এলাম দেখতে। একবার ইচ্ছে আছে শীতকালে আসার, তখন চারদিকে সাদা বরফের মাঝে নীল জলের এই লেকের সৌন্দর্য দেখবো।
এবারে পাহাড়ের নীচে দেখা মিলল, নাথ্যাং ভ্যালির। কুপুপ থেকে নাথ্যাং ভ্যালির যাওয়ার দুটো রাস্তা, একটি সোজাসুজি নাথ্যাং ভ্যালি দিয়ে। আমরা যাচ্ছি, ওল্ড বাবা মন্দির ঘুরে নাথ্যাং ভ্যালির উল্টো দিকে দিয়ে ঢুকবো বলে। এখানে দেখার মতন একটি ব্রিটিশ কবরখানা, মোনাস্ট্রি ও মিস্টি নাথ্যাং গ্রাম। তবে ঘুরতে ঘুরতে এতই দেরি হয়ে গেল যে না থেমে, ১০কিলোমিটার দূরে লুংথু গ্রামে আমাদের হোম স্টের দিকে এগোলাম। প্রসঙ্গে জানাই, অনেকক্ষন পরে এখানে একটি ক্যাফে দেখি, যেখানে সবাই লাঞ্চ করছিল। আমাদের ইচ্ছে হলে এখানে লাঞ্চ করতে পারেন, আমরা যদিও হোম স্টে গিয়েই লাঞ্চ করবো। আমরা প্রথমে একরাত এখানে থাকবো ভাবলেও, অতিরিক্ত উচ্চতায় শ্বাসকষ্টের ভয়ে ও জুলুকের বিখ্যাত জিগজাগ রাস্তার সুন্দর ভিউ দেখার লোভে লুংথু গ্রামের সব থেকে উঁচু হোম স্টে বুক করি। নাথ্যাং ভ্যালির পরেই রাস্তা সরু হয়ে যাচ্ছে, আর শুরু হয় সেই আকর্ষণীয় বাঁক গুলো। সোনালীর গুল্মের রং এর মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝে লুংথু সানরাইজ পয়েন্ট পরে, যা নাথ্যাং ভ্যালি ও লুংথু গ্রামের ঠিক মাঝে। একটু থমকে, কিরকম ভিউ আসবে সেটার কল্পনা করে এগিয়ে চললাম। কালকে সকালে এখানেই আসবো।
এখন এডভেঞ্চারের নেশায় আমি জুলুকের জিগজাগ রাস্তা উপভোগ করে নীচে নামছি। একবার ডান দিকে আবার বা দিকে হেলে পড়ছি। আমরা নিচের দিকে নামছি তাই রাস্তা অপেক্ষাকৃত কম কঠিন, তবে জুলুকের থেকে ওপরে উঠতে ভালো রকমের ড্রাইভিং স্কিলের পরীক্ষা দিতে হয়। পাঁচ - ৬টি বাঁক পেরিয়ে নীচে নামতেই, ওই দেখুন দূরে আমাদের আজকে আস্তানা লুংথু গ্রাম দেখা যাচ্ছে। অবশেষে আমরা নীচে লুংথু গ্রামে এসে বুঝলাম, আমাদের হোম স্টে গ্রামের ঠিক ওপরে, তাই গাড়ি ঘুরিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম।
আমরা আগেই জানিয়েছিলাম এখানে মিলিটারি ট্রাকের আনাগোনা আছে, তাই খুবই সাবধানে গাড়ি চালানোর অনুরোধ রইল।
রাস্তার পাশে পার্ক করতে হয়, তারপরে কিছু সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হবে। সামনেই খাদের পাশে জুলুকের আঁকা বাঁকা রাস্তার দারুন ভিউ। গ্রামে ঢুকে কনকনে ঠান্ডা হওয়া জাঁকিয়ে বসেছে। দূরের ওই উঁচু পাহাড় হলো প্রায় কিলোমিটার দূরের জুলুক গ্রাম।
পৌঁছেই ঘরে ফ্রেশ হয়ে আগে এলাম লাঞ্চ করতে, আগেই বলা ছিল, তাই গরম গরম খাবার চলে এলো। খাওয়া দাওয়া তো হলো, এবার চলুন হোম স্টে ঘুরিয়ে দেখাই। তবে আগেই জানিয়ে রাখি, লাক্সারি কিছু খুঁজলে এই জায়গা আপনার জন্য নয়। তারজন্য নীচে জুলুকে বা পদমচেনে থাকতে পারেন। এখানে ঘরে আছে বড় খাট আর লেপ কম্বল আর আছে একটি বিশাল কাঁচের জানলা, যেখান থেকে একটু আগেই জুলুকের রাস্তা দেখা গেলেও এখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। পরিস্কার ওয়েস্টার্ন টয়লেট রয়েছে, তবে গিজার নেই। গরম জল চাইলে ওনারা দিয়ে যান। রাতে তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নেমে যায়, অক্সিজেনের অভাব বোধ হয়। তাও কেন এখানে থাকলাম, সেটা জানাবো কালকে সকালের ভিউ দেখিয়ে। ওহ! আমরা ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে মেঘের আনাগোনা দেখতে থাকলাম। রাতে রুম হিটার চাইলে এক্সট্রা ৪০০টাকা লাগবে, শীতের সময় থাকলে অবশ্যই সেটা নেবেন রাতে ভালো করে ঘুমাতে।
সূর্যাস্তের সময় রান্নাঘরের পাশে এলাম। সোনালী রঙের কয়েকটি টাইমলাপ্স তুলে রাখলাম। ওদিকে দিগন্তরেখায় সূর্য মিলিয়ে যাচ্ছে। বাঁদিকে উঁকি দিচ্ছেন মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা। মাঝে দু কাপ চায়ের চুমুক দিয়ে, অনেকক্ষণ সেখানেই বসে রইলাম। বিকেলে প্যাকেজের পেয়াজি আর আলাদা করে বলা চিকেন পাকোড়া ফ্রাই নিয়েছিলাম। রাতে নিচের পাহাড়ে জোনাকির আলো জ্বলে উঠল। মাঝে মাঝে লাল, হলুদ গাড়ির লাইট একে বেঁকে চলে যাচ্ছে। ডিনার করতে এসে ডাইনিং রুমের কাঠের আগুনের হিটারে একটু আগুনের আঁচে হাত সেকে নিলাম। রাতের খাবার ভাত, মুরগির মাংস আর পাঁপড়। রাতে ঠান্ডায় ভালো ঘুম হয়নি, তাও সকাল ৫টায় গাড়িতে বসে দেখি কাঁচের ওপরে কুয়াশার বরফ জমে। গাড়ি স্টার্ট নিলেও, চালানো কঠিন। তাও সানরাইজ পয়েন্টের দিকে যেতেই একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে দেখি মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। তাও একটু এগোলাম। তবে আর একটা বাঁক ঘুরে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ, সানরাইজ পয়েন্ট যেতে গেলে উল্টে বিপদ ডেকে আনবো। কাঁচের ওপরের বরফে রাস্তার শেষ দেখা যাচ্ছে না। তাই এখানে দাঁড়িয়েই সূর্যোদয়ের শোভা উপভোগ করবো। আমার সামনে ২০০° উন্মুক্ত ভিউ। ডানদিকে কোনায় মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ আর বা দিকে সূর্যোদয় হচ্ছে। সূর্যের দেখা না পাওয়া গেলেও তার আলো চারিদিকে আসতে আসতে ছড়িয়ে পড়ছে। স্লিপিং বুদ্ধের মাথা থেকে পাও আস্তে আস্তে সোনালী রঙে সেজে উঠছে। কালকে সারারাত ঠান্ডায় ভালো ঘুম হয়নি। -৩℃ এর নীচে চলে গিয়েছিল তাপমাত্রা, অক্সিজেনের অভাবে মাথা ধরে গেছিল, তাও এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সব কষ্ট লাঘভ হয়ে যায়।
পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ সারা রাত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে, তার সৌন্দর্য অন্য রকমের। আবার অমাবস্যায় একটু ওপরে উঠলে নাকি দুর্দান্ত এস্ট্রো ফটোগ্রাফি করা যায় এখান থেকে। তাই সিল্ক রুটে ঘুরতে আসলে এই জায়গায় থাকা মাস্ট।
মোটা জ্যাকেট, লেয়ার করে জামা, গ্লাভস পরেও হাড় কনকনে হাওয়ার দাপটে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল।
ওদিকে আবার সিল্ক রুটের জুলুকের মাথায় দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। চারদিকে নাম না দেওয়া পাহাড়ের লাইন, সবাই নীল রঙের পোশাক পরে সেজে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। প্রচুর ছবি তুললাম, তুললাম অনেক টাইম লাপ্স তবে তারপরেও শুধু বেঁচে রইলো আমাদের মনের মেমোরি কার্ডেই। ফিরে এলাম হোম স্টে, ব্রেকফাস্ট সেরে নীচে নামবো।
জুলুক, পদমচেনে ঘুরে রংলি থেকে যাবো আরিতার। সিল্ক রুটের শুরু করেছিলাম ডোবান ভ্যালি দিয়ে শেষ হবে আবার সেদিকেই। আগামী পর্বে ফিরে আসবো মায়াবী আরিতারকে নিয়ে তাহলে পর্বটি মিস না করতে চাইলে এখুনি সাবস্ক্রাইব করে নিন, আর দেখা হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি।
https://youtu.be/jU4k1V_VRhE
Oct, 2023
#ভালোখেয়েভালোথেকো