22/09/2025
অধ্যাপক গৌতম রায়ের লেখা "অস্তিত্বের সংকটে ভারতীয় মুসলমান সমাজ" বইটি পড়ে অয়ন হালদার মহাশয় একটি সুচিন্তিত রিভিউ দিয়েছেন :-
বিশিষ্ট অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক শ্রী গৌতম রায় তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘অস্তিত্বের সংকটে ভারতীয় মুসলমান সমাজ’ বইটি প্রসঙ্গে লেখেনঃ “… এই বইটি কোনো সাংবাদিক প্রতিবেদন নয়, কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ভাষ্য নয়—এটি এক দীর্ঘকালীন চিন্তার, পর্যবেক্ষণের এবং তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ফল। বইটি ভারতীয় মুসলমানের বর্তমান বাস্তবতা, রাজনৈতিক অবস্থান, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান, ইতিহাসবিকৃতি, গণমাধ্যমে চিত্রায়ন, এবং রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান—এই সমস্ত বিষয়ের একটি প্রামাণ্য নথি হয়ে উঠতে চায়।“ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে যখন ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশের সম্প্রীতির পরিবেশ নিয়মিত কলুষিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে এমন একটি বই যে অত্যন্ত সময়োপযোগী তা বলা বাহুল্য। লেখকের মতে, তাঁর এই বই ‘কোনো অভিযোগপত্র নয়, বরং একটি সচেতনতার দলিল’। তিনি দায়িত্ববান নাগরিকের দরবারে কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন এনে হাজির করেছেন। সেসব প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসার দায়ভার তিনি নাগরিকদের উপরই ন্যস্ত করেছেন। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মিডিয়া স্টাডিজ এবং মনোবিজ্ঞানের এক আন্তঃবিভাগীয় পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি সজাগ দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক ক্ষতের গভীরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান করেছেন। সরকারি নথি, প্রতিবেদন, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তিনি তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। লেখক যত্নশীল উপায়ে অপরায়নের চিহ্নগুলিকে শনাক্ত করে বিমানবিকীকরণের প্রবণতাকে বেআব্রু করেছেন।অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাবশিষ্য শ্রী গৌতম রায় তাঁর পথপ্রদর্শকের প্রতি আনতচিত্তে ঋণস্বীকার করেছেন। অগ্রজকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন: "শৈশবে জ্ঞান হওয়া ইস্তক যে মানুষটির পায়ের নীচে বসে মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা পেয়েছিলাম, উনিশ শতকের নবজাগরণের শেষ প্রতিনিধি অন্নদাশঙ্কর রায়, যেভাবে হাতে ধরে আমাকে তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান ব্রত হিন্দু মুসলমান সম্পর্ককে শিখিয়েছেন, সে শিক্ষা যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় রাখতে পারি।" ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং তার সাথে সম্পর্কিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জী ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এই বিষয়টি ভারতীয় মুসলমানদের অস্তিত্ব সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে তাঁর স্পষ্ট অভিমত। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় অপচেষ্টাকে তিনি বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কখনো বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করেছেন, আবার কখনো বা প্রশাসনিক কাঠামোর আপাত-ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র সম্পর্ক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় নজরদারির বিবিধ উদাহরণ পেশ করে দেখিয়েছেন যে "নিরাপত্তার নামে (মুসলমান) নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় গুরুতর হস্তক্ষেপ ঘটছে।" উচ্চশিক্ষার প্রসঙ্গে তাঁর মত এই যে, বিভিন্ন নামী সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্বশাসনে হস্তক্ষেপ প্রকারান্তরে দমননীতির নামান্তর, যা মূলত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল করার প্রয়াস। লেখক শ্রী গৌতম রায় ২০০৬ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উল্লেখজনক ঘাটতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রতি অবজ্ঞা এবং বৈষম্যের বিষয়টিও উপস্থাপিত করেছেন। শহরাঞ্চলের মুসলিম নাগরিকদের দারিদ্র্য, সরকারি চাকরিতে মুসলিম নাগরিকদের কম অংশগ্রহণ, মুসলিম কৃষকদের কৃষিঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চনা ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিম ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের বঞ্চনার চিত্রটি তিনি বর্ণনা করেছেন। এভাবে মুসলিম সহনাগরিকদের permanent underclass হিসেবে পর্যবসিত হওয়ার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির পিছনে রাষ্ট্রীয় অভিসন্ধিগুলি তিনি তথ্যনিষ্ঠ উপায়ে উন্মোচন করেছেন। রাজাবাজার, মেটিয়াব্রুজ, ঘুসুড়ি, কাটোয়া, বহরমপুর প্রভৃতি মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলের সামগ্রিক অনুন্নয়ন তাঁকে ব্যথিত করে। সামাজিক-অর্থনৈতিক মানদণ্ডে মুসলিম সহনাগরিকদের ক্রমশঃ প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেওয়ার যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কূট উদ্দেশ্যগুলি তাঁর আলোচনার মর্মবস্তু হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সংখ্যাগুরু মতাদর্শের যৌথ নির্মাণের ফলশ্রুতি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে তীব্র বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার এবং বিচারবহির্ভূত জনহত্যা। ঘৃণার সংস্কৃতি কেবল শারীরিক নিপীড়ন বা আর্থ-সামাজিক পরিসরে মুসলিম সহনাগরিকদের দুর্বল করবার অসদুপায়ে সীমাবদ্ধ নয়। লেখক NCERT পাঠ্যক্রম থেকে মুঘল যুগ, সুলতানি যুগ, সুফী আন্দোলনের নির্বাচিত অংশ বাদ দেওয়া, মুসলিম বুদ্ধিজীবী, কবি, ঐতিহাসিক, দার্শনিকদের উপেক্ষা করবার মধ্যে selective historical erasure-এর প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন।প্রিন্ট এবং ডিজিটাল মিডিয়ার সহযোগিতায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কৌশলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিরন্তর জিহাদি, দেশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কেবলমাত্র মুসলিম সহনাগরিকদের জীবন-জীবিকার প্রতি আক্রমণ নয়, তাঁদের সামাজিক সম্মানহানির প্রচেষ্টাও নিশ্চিতভাবে এক নিন্দনীয় ঘটনা। লেখক শ্রী গৌতম রায় রাজ্যের মুসলিম নারীদের আত্মপরিচয়ের সংকট প্রসঙ্গে তাঁদের 'দ্বিগুন প্রান্তিকতা'র বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ধর্ম এবং লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়নের কারণে মুসলিম নারীরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোতে যেমন বৈষম্যের শিকার হন, তেমনই ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য নিয়ত রাষ্ট্রীয় ঔদাসিন্য-জাত সামাজিক বঞ্চনার সম্মুখীন হতে হয়। মুসলিম নারীদের সামাজিক সুরক্ষা এবং মৌলিক নাগরিক অধিকার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সীমাহীন অবহেলার প্রতি দিক-নির্দেশ করে তিনি লেখেন: " (রাষ্ট্র) কেবল তাঁকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাখে না, বরং এক প্রকার 'সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা'র মধ্যে ঠেলে দেয়, যেখানে তাঁর স্বর ক্রমশঃ নিঃশব্দ হয়ে যায়। অথচ সেই নিঃশব্দতাই আজ বাংলার ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ-- যতদিন না আমরা বুঝতে পারছি, মুসলিম নারীর মুক্তি মানেই সমাজের সামগ্রিক মুক্তি।" গণমাধ্যমগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন অপপ্রচার থেকে বিনোদনের দুনিয়ায় ইতিহাসবিকৃতি-- প্রাবন্ধিক শ্রী গৌতম রায়ের পরিসংখ্যান-ভিত্তিক আলোচনায় মুসলিম নাগরিকদের আস্তিত্বিক সংকটের বর্তমান পরিস্থিতিটি সম্যকভাবে উত্থাপিত হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রনোদিত, নেতিবাচক প্রচারের বিপরীতে সামাজিক গণমাধ্যমগুলির সদর্থক ভূমিকার প্রয়োজন সম্পর্কে তিনি অবগত করেছেন। লেখক এই সময়কালে তরুণ প্রজন্মের উপযুক্ত মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব তীব্রভাবে বোধ করেছেন। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি ব্যতীত মুসলিম সমাজের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি রাজনীতির আঙিনায় অধুনা আলোচিত কয়েকটি ইসলামী সংগঠনের সময়োপযোগী কার্যকলাপে আশার আলো দেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন। সমস্ত রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মুসলিম সমাজের তরুণ প্রজন্মের ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে আত্মপ্রতিরোধ এক সম্মিলিত প্রতিস্পর্ধী কণ্ঠস্বরের জন্ম দিচ্ছে বলে তাঁর বিশ্বাস। লেখক শিক্ষিত, রুচিশীল, সংস্কৃতিমনা, আত্মবিশ্বাসী মুসলিম তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আধিপত্যবাদের বিপ্রতীপে, অপরিসীম ঘৃণার উত্তরে দৃঢ় কণ্ঠে আত্মমর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হওয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের দ্বারা বিকল্প ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাস পুনরুদ্ধারের পক্ষে প্রস্তাব রেখেছেন। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে অস্বীকার আদতে আত্মবিস্মৃতির নামান্তর। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে মুসলিম সহনাগরিকদের উজ্জ্বল অবদানকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করা সময়ের দাবি। লেখক শ্রী গৌতম রায় ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। তিনি মুসলিম সমাজের জন্য কয়েকটি করণীয় কাজের কথা লিখেছেন-- স্থানীয় শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, আইনি সহায়তা সংস্থা গঠন, আন্ত:সম্প্রদায়িক সংলাপ উদ্যোগ, সংবিধান-ভিত্তিক অধিকার সচেতনতা কর্মসূচি। অমুসলিম সমাজের প্রতি তাঁর জরুরি আহ্বান-- মুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো, গুজব ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ, সংবিধান ও মানবতার ভিত্তিতে সংহতি গড়ে তোলা প্রভৃতি। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটির পরিশেষে তিনি ২০১৪ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি সংঘঠিত নৃশংস রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের একটি পর্যায়ক্রমিক তালিকা যুক্ত করেছেন। প্রাবন্ধিক শ্রী গৌতম রায়ের নিবিড় সমাজবীক্ষণ-প্রসূত, গভীর সমানুভূতি-সঞ্জাত এই গ্রন্থ নৈরাশ্যের অমানিশা দূর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান-কেন্দ্রিক এক অনন্ত সম্ভাবনাময় আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত করে।