09/10/2025
(১)
"এমন করে ডাকলে আমায়, মর্মভেদী ছুঁয়ে,
নয়নতারার কাজলাদিঘি তোমায় দিলাম সঁপে।
একটা প্রহর, দুইটা অধিক, বহু পক্ষকাল—
বর্ষ যাবৎ রইনু বসে তোমার অপেক্ষায়...
থাকবে তুমি অবলীলায়, পারবে আমায় ছাড়া?
বলতে পারো, নবমীনিশি— তোমার এত কিসের তাড়া?"
ডায়রী লিখতে লিখতে হঠাৎই মন্ডপের দিকে চোখ চলে গেল শৈলজার। ওর ঘরের ব্যালকনি থেকে সোজাসুজি চোখ রাখলে পাড়ার বারোয়ারী দুর্গা মন্ডপটা দেখা যায়। ঘণ্টাখানেক আগে ওখানে ঢাক বাজছিল, আরতি হচ্ছিল— সন্ধিপুজোর। কত লোক জুটেছিল তখন। এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। যে যার ঘরে ফিরে দোর দিয়েছে। রাত পোহালেই দশমী। এবারে নবমী-দশমী একদিনে পড়েছে কিনা! মন্ডপে মা একা ছেলেমেয়েদের সাথে। দূর থেকেও শৈলজার মনে হয় মা-এর চোখদুটো যেন আজ একটু বেশিই চিকচিক করছে। লাবণ্যময় ঐ মুখে আজ যেন বিষণ্ণতার ছাপ। এ কি শৈলজার মনের ভুল? নাকি ওর মতো মা দুর্গাও মনেপ্রাণে চাইছেন এই মহানবমীর রাত আরো কয়েক ঘন্টা বেশি স্থায়ী হোক। অথচ মহাকালের বিচার দেখো, যা আমরা সবচাইতে বেশি করে চাই, সে আমাদের থেকে সেইটেই সবথেকে আগে কেড়ে নেয়। সে' পুজোর কটা দিনই হোক, বা অন্যকিছু।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শৈলজা একবার আকাশের দিকে তাকায়। শুক্লানবমীর আধখানা চাঁদ আস্তে আস্তে মেঘের বুকে মুখ লুকোচ্ছে। সন্ধ্যের খবরে বলেছিল বটে রাতের দিকে বিচ্ছিন্ন বৃষ্টিপাত হতে পারে।
রাত একটা বাজতে যায়। ডায়রী লেখা বন্ধ করে শৈলজা এবার ঘরে ঢোকে। ব্যালকনির দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে বাইরে। মণ্ডপে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুগ্গা মা দাঁড়িয়ে থাকেন। এবার সত্যিই একা।
(২)
রাঙাপিসিদের বাড়ি থেকে বিজয়া করে বেরোতে বেরোতে ৭টা বেজে গেল। শৈলজা একবার ভেবেছিল শর্টকাট ধরে নেবে। কিন্তু রাস্তাটার বেশ বদনাম আছে। উপরন্তু, আজ ভাসানের দিন। দিনকাল ভালো না। তাই একটু ঘুরপথ হলেও, ও স্টেশনের রাস্তাটাই ধরল।
—কিরে...?
একটা অতি পরিচিত ডাকে শৈলজা থমকে গেল। পিছন ফিরতে না ফিরতেই ওর বুকটা ধড়াস করে উঠল। একটা বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ যেন মুক্তিবেগে এসে ওর গোটা শরীরটাকে বিদ্যুৎপিষ্ট করে দিয়ে মাটিতে মিশে গেল তৎক্ষণাৎ! ও শুধু স্থবিরের মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকল। নীলাদ্রি! গোটা একটা বছর পর! শৈলজা জানত পুজো আসবে, আর নীলাদ্রির সঙ্গে ওর দেখা হবে না, এ যে হতেই পারে না। সারা বছরের অপেক্ষা যে তবে মিথ্যে হয়ে যাবে। মা দুর্গা এত নিষ্ঠুর হতেই পারেন না।
—কিরে! চিনতেই তো পারছিস না...
শৈলজা এবার নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল
—না, মানে... আমি আসলে...
—থাক। বুঝেছি। এতদিন পর আমাকে এভাবে এক্সপেক্ট করিসনি তাই না?
—ঠিক তা নয়। অন্ধকারে প্রথমটায় তোকে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি রে।
—লেম এক্সকিউজ। বল, ভুলে গেছিস আমায়।
—এরম মনে হওয়ার কারণ?
—অনেক আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি...
—আপাতত একটা দিয়েই স্টার্ট কর।
—যেতে যেতে বলি?
—বেশ।
—আচ্ছা, তোর কি এখন খুব তাড়া আছে, শৈল?
—না তো। কেন?
—গঙ্গার ধারে যাবি? জেটিতে বসে গল্প করতাম। বহুদিন কথা হয় না তোর সাথে। অবশ্য যদি তোর কোনো প্রবলেম না থাকে তো।
—প্রবলেম নেই।
শৈলজা আড়চোখে একবার নীলাদ্রিকে দেখে নিল। হাঁটতে হাঁটতে এটা ওটা কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে। শৈলজা বুঝতে পারে অনেক বদলে গেছে নীল। কৈশোরের সেই পাগলপারা, বাউন্ডুলে ভাবটা আর নেই। এখন ওর সামনে যে আছে সে অনেক পরিণত, সংসারী একটা মানুষ।
(৩)
জেটিতে তেমন ভিড় নেই। লঞ্চগুলোও বেশ ফাঁকাই যাচ্ছে। অন্য ঘাটে মায়ের ভাসান হচ্ছে, গান বাজছে বেশ জোরে।
—কবে এলি, নীল?
—সপ্তমীতে।
—এখন কোথায় আছিস?
—দিল্লিতে।
—সাবাস! তা পানিপুরি কেমন লাগছে?
—ধুসস... আমাদের ফুচকার ধারেকাছেও কোনোদিন আসতে পারবে না।
—মানছিস তাহলে?
—আমি চিরকালই মেনে এসেছি রে, শৈল। নেহাত আমাদের বাংলার বরাত খারাপ, তাই আমাদের ইয়ং জেনারেশনকে ফুচকার স্বাদ পানিপুরি দিয়ে মেটাতে হচ্ছে! যাইহোক, বাদ দে ওসব। তোর খবর বল। কি করছিস এখন?
—আই.টি. সেক্টরে আছি মাস ছয়েক হল।
—বাহ্! তা, বিয়ে থা কবে করছিস?
—উমম... দেখা যাক...
—পাত্রটি কে?
—উঁহু, বলবো না। তার জন্য বিয়েতে আসতে হবে।
—সে তুই ইনভাইট করলে আমি দশদিনের সিক লিভ নিয়েও আসতে পারি তোর বিয়েতে।
—বলিস কি রে! দ..শ দিন! আলাদাই সুখে আছিস তো মনে হচ্ছে!
—হাহা! মজা করছিলাম।
—বুঝেছি।
—এই, তোর মনে আছে, এই লঞ্চঘাটে বসে বন্ধুরা মিলে কত আড্ডা মারা হত একসময়।
—তা আবার মনে থাকবে না! সেসব দিন কি ভোলা যায়?
—টাইম ফ্লাইস্, ম্যান... এখন সে সময়ও আর নেই, আর সব মানুষগুলোও...
—হুমম... সময় আর পরিস্থিতির স্রোতে কে কোথায় হারিয়ে গিয়েছি, খোঁজও রাখা হয়নি সেভাবে। কেবল তোর সাথেই যা বারবার দেখা হয়ে যায় আমার। কাকতালীয়ভাবেই, বল?
—একদম!
—সোশ্যাল মিডিয়াও আছে অবশ্য।
—সে আর কতটুকুই বা? আর তাই যদি হবে, তবে বাকিদের সাথে আর দেখা হয় না কেন বল?
—সেই...
—আচ্ছা, তোর মনে আছে, লাস্ট বার যখন আমাদের স্কুলের গ্রুপটা এখানে আসা হয়েছিল...
—হ্যাঁ... ২০১৪। এইচ. এস. -এর প্রিপারেশন তখন তুঙ্গে সবার। সব সামলে সেবার অষ্টমীতে ঠিক করা হয়েছিল সবাই মিলে এখানে এসে আড্ডা মারা হবে।
—কি দারুণ ছিল না দিনটা!
—দারুণই বটে! মেরুন-রঙা পাঞ্জাবী আর ব্লু জিন্স পরেছিলি তুই সেদিন। বাম হাতে ছিল তোর সেই চিরাচরিত রিস্ট ওয়াচটা। ঝাঁকড়া এলোমেলো চুলে, চোখে অনেকখানি মায়া নিয়ে গিটার বাজিয়ে বেশ গাইছিলি সেদিন...
"আমিও ছুটে যাই সে গভীরে,
আমিও ধেয়ে যাই কী নিবিড়ে।
তুমি কি, মরীচিকা না ধ্রুবতারা?
তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তরা,
কে জানে, কী আবেশে দিশাহারা।"
এই গানটা গেয়েই তো সেদিন প্রপোজ করেছিলি ঈশানীকে।
নীলাদ্রি অপলকে তাকিয়ে থাকে শৈল-র দিকে। এই কি সেই মেয়েটা যে একসময় মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত নীল গাইলে? ও একবার ডাকলে কি এই মেয়েটাই সব ফেলে ছুট্টে চলে আসত শুধু ওকে একটিবার দেখতে পাবে বলে? এ-ই কি সে যার ডায়রী নীল একবার চুরি করে পড়ে ফেলেছিল? কোমর ছোঁয়া খোলা চুল আর লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে কি অপূর্ব লাগছে ওকে আজ! আগে কখনো এত ভালো লাগেনি কেন? ওর চোখের দিকে তাকাতেই বা আজ নীলের এত ভয় করছে কেন? কেন এমন মনে হচ্ছে, যেন তাকালেই অতলে হারিয়ে যাবে! তাই, শৈল-র কপালের মাঝের লাল টিপ-টার দিকে চেয়ে নীল অস্ফুটে বলে ফেলে
—তু্ই একটুও বদলাসনি, শৈল।
—সবকিছু কি বদলে না গেলেই নয়, নীল?
—বদলাতে হয় যে...
—তাহলে, এই দশমীর সূর্যাস্ত বদলায় না কেন? মা'য়ের চলে যাওয়া বদলায় না কেন? প্রতিবারের অপেক্ষারা বদলায় না কেন?
—এই অপেক্ষাদের অবসান আছে তাই...
সব প্রশ্নের উত্তর যে এটাই হবে, শৈল তা জানত। তবু কিছু প্রশ্ন এমন থাকে যে না করলেই নয়। উত্তর আলাদা হলেও হতে পারে, সে মিথ্যে আশায় নয়। এমনকি যেচে কষ্ট পাওয়ার অহেতুক অভিপ্রায়েও নয়। কেবলই যে না বলতে পারা এতকাল কুরে কুরে পাঁজরের অস্থি-মজ্জা এক করে দিচ্ছিল, সে' কথাদের দিগন্ত পারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই এ প্রশ্ন। দিগন্ত যে আসলেই মরিচীকার মতো, তা ওদের বোঝা দরকার। এতে করে, কিছু পাওয়া যাক বা না যাক, আত্মার শান্তি মেলে।
—তারপর... তোরা বিয়ে করছিস কবে?
—সামনের অগ্রহায়ণে।
—কনগ্রাচুলেশনস্।
—থ্যাঙ্কস্।
—আর কদিন আছিস কলকাতায়?
—একদিনও না। আজ রাতের ফ্লাইট।
—আজই?
—এর বেশি ছুটি যে পেলাম না রে।
—সাবধানে যাস...
—ভালো থাকিস, শৈল। আসি আজ?
—আবার কবে আসবি?
নীলাদ্রি কোনো উত্তর দেয় না। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আর প্রশ্নকর্তাকে খু/ন করা সমান। গন্তব্যের পথে ধরে। ওকে যেতেই হবে এবার। নয়তো ফ্লাইট মিস করবে। ঈশানী দিল্লিতে অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
অতঃপর, নীলাদ্রি চলে যায়।
শৈল জানে নীল আর কখনো ফিরবে না। কোথাও একটা যেন পড়েছিল, প্রয়োজন ফুরালে এই ব্রহ্মাণ্ড নাকি আর কখনো দুটো মানুষকে মেলায় না, তা সে' তারা যত কাছাকাছিই থাকুক না কেন। দেশের দু'প্রান্তে থাকে দুজন, তাও তো বারবার নীলের সাথে দেখা হয়ে যায় শৈলর। আজও হয়েছিল। নিছকই কাকতালীয়? নাকি আজ সেই প্রয়োজন ফুরালো? বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করে। যে শূন্যতায় শুধু একটা সত্যিই অনুরণিত হতে থাকে, "শত চেষ্টাতেও আমার আর তোকে ভুলে যাওয়া হল না, নীল... ভুলে যাওয়া আর হল না তোকে..."। দীর্ঘশ্বাসে সেই অনুরণন মিলিয়ে যায় গাঙ্গেয় বাতাসে।
ওদিকের ঘাট থেকে ভেসে আসে, "বলো দুগ্গা মাঈকি!" মা দুর্গা ভাসানে যান। শৈলজা জোড়হাতে প্রণাম করতে করতে অস্ফুটেই বলে ফেলে, "আবার এসো মা"।
© সৃষ্টিছাড়া
Soumita Paul
ছবি: সংগ্রহীত
Care of Kolikata - কলিকাতা