15/09/2025
শেষ বিদ্রোহ - ঋষভ
গ্রামের উপকণ্ঠে নতুন এক বিশাল কারখানা উঠল। মালিক—মগনলালজি, বহিরাগত ব্যবসায়ী। ঝলমলে বিজ্ঞাপন, হাজার চাকরির প্রতিশ্রুতি। গরিব শ্রমিকেরা ছুটে এল কাজের আশায়। কারখানায় নতুন আলো জ্বলল।
প্রথমে সব ঠিকই চলছিল। শ্রমিকরা বাংলায় গান গাইতে গাইতে কাজ করত। কেউ কখনো “বাউল” গুনগুন করে, কেউ দুপুরে ভাত-ডাল ভাগাভাগি করে খেত। কিন্তু হঠাৎই একদিন মগনলালজি ঘোষণা দিল—
—“আমার কারখানায় শুধু হিন্দি আর ইংরেজি চলবে। যেই বাংলায় কথা বলবে, তার আর এখানে জায়গা নেই।”
সেদিন বিকেলেই দলে দলে শ্রমিক কাজ হারাল। চিৎকার, কান্না, হাহাকার ভরে উঠল কারখানার গেট।
রাতে কারখানার বাইরে দেখা গেল সেই শ্রমিকদের—ক্ষুধার্ত, অনাহারে কাতর। শিশুদের চোখে ক্ষিদের ছাপ স্পষ্ট, মায়েদের বুক ভেঙে যাচ্ছে।
সেই শ্রমিকদের একজন, গঙ্গাচরণ। ক্ষুধায় কাতর মৃতপ্রায় হলেও নিজের ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বাঁচতে চাইছিল। কিন্তু খাবার ছিল না। শিশুটি একরাতে বাবাকে বলল—
—“বাবা, আমাদের গ্রামের পূজারী অরিন্দমদা আছে না? শুনেছি উনি আগে ডাকাত ছিলেন, বন্দুক চালাতেন। তুমি গেলে উনি হয়তো ভয় দেখিয়ে আমাদের কাজ ফেরত দিতে পারতেন!”
গঙ্গাচরণের চোখে জল, কিন্তু সে অসুস্থ শরীরে যেতে পারল না। তাই ছেলেটিই গেল—অন্ধকার রাত পেরিয়ে অরিন্দমের কাছে।
অরিন্দম তখন নদীর ঘাটে বসে কালীমূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালাচ্ছিল। ডাকাতি ছেড়ে বহুদিন হলো সে পূজার কাজে মন দিয়েছে। ছেলেটি কেঁদে সব বলল—
“দাদা, আমাদের খাওয়ার নেই। মগনলালজি শুধু নাকি একটি কারণে আমাদের কাজ কেড়ে নিয়েছে, আমরা বাংলায় কথা বলি তাই।”
অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল। তার মনে পড়ল নিজের অতীত—কত নির্দয় রক্ত ঝরিয়েছে। আজ আবার কি বন্দুক হাতে নিতে হবে?
সকালে কারখানার গেটের সামনে ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের ভিড় জমেছে। চোখে তাদের ভয়ের ছায়া, পেটে ক্ষুধা। অরিন্দম লাল পোশাকে এগিয়ে এলো, হাতে পুরোনো বন্দুক। সোজা হেঁটে গিয়ে ঢুকলো মগনলাল এর কেবিনে।
ঢুকেই সে শান্ত গলায় বলল,
—“শ্রমিকদের কাজ ফিরিয়ে দিন, মগনলালজি। ভাষা মানুষের অপরাধ নয়।”
মগনলালজি হেসে উঠল। কণ্ঠে হিন্দি–বাংলা মিশে গেল।
—“আরে, তুম বাঙ্গালী লোগ সামাঝতে ক্যা হো আপনে আপ কো?বিজনেজ মে ইমোশান নাহি চালতা পূজারী জি . বাংলা, গান–কবিতা, আবেগ—এইসব চিজে পেট ভরবে ক্যা?”
অরিন্দম চোখে জল নিয়ে উত্তর দিল,
—“এই ভাষায় আমরা 'মা' ডাক শিখেছি, এটা আমাদের মাতৃভাষা, এই ভাষায় শ্রমিকেরা স্বপ্ন দেখে। পেট ভরানোই যদি সবকিছুর মাপকাঠি হয়, তবে আত্মা কোথায় যাবে?”
মগনলালজি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
—“আত্মা দিয়ে ভাত নাহি মিলতা।”
অরিন্দম হঠাৎ বন্দুক তুলে ধরল, আর বললো,
—"বাংলা ভাষা নিয়ে যা খুশি তাই বলে পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন মগনলালজি?"
চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই সে অতীতে ফিরে গেলো—ডাকাতির রাত, রক্ত ঝরানো পথ। বুক কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে সে বন্দুক নামিয়ে ফেলল।
মগনলালজি হো হো করে হেসে উঠল।
—“দেক্ষা? ডাকাতি ছাড়ার পর তুমি নরম মাটির পুতলা হয়ে গেছো।”
তারপর একেবারে তাচ্ছিল্যের সুরে চিৎকার করল,
—“এই বাংলার কি দাম আছে? আবেগ, আবেগ… স্যাব বাকওয়াস হায়!”
এই কথাগুলো বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করল অরিন্দমের হৃদয়ে। চোখ রক্তলাল হয়ে উঠল। ঠাণ্ডা স্বরে সে বলল,
—“তাহলে নাহয় এর উত্তর রক্ত দিয়েই দিতে হবে ।”
সে আবার বন্দুক তুলল। এক নিঃশ্বাস, কোনো কিছু না ভেবে আলতু ট্রিগার এ চাপ ,তারপর—
তীব্র গর্জন।
সেই শব্দে কারখানার দালান কেঁপে উঠল। শ্রমিকরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
Osi Risav
ছবি: সংগৃহীত
Care of Kolikata - কলিকাতা