
26/08/2025
আট-দশ বছর বয়েস থেকে ‘গুরু’ বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। তাঁরই সাইকেলে চেপে ঘুরতেন। বুকের আড়ালে নিষিদ্ধ বই, টিফিন বক্সে রিভলভার। চলত পাচার করা।
তিনি বলেছিলেন, "আমার দৃঢ় বিশ্বাস দীনেশদা, বিনয়দা যদি বিদেশে জন্মাতেন, তবে তাদের জীবনী পাঠ্যপুস্তক হত - আমাদের দেশে খাঁটি মানুষ তৈরী হত | সকলে জানতেন কি জাতের দামাল ছেলে সোনার বাংলায় জন্মেছিল |"
ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালে ডাক্তারির ছাত্র বিনয় বসু-কর্তৃক কুখ্যাত আইজি প্রিজন লোম্যান-হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ, রোমহর্ষক বিবরণ ভানু নিজেই লিখে গিয়েছিলেন। যে বাঙালি কন্ট্র্যাক্টর পলায়নরত বিনয়কে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতালের মাঠে জাপটে ধরেছিল, বিনয়ের বলিষ্ঠ ঘুঁষিতে তার দাঁতের ‘অকালে খসে পড়া’র ঘটনা তিনি লিখেছেন সেখানে। হাসপাতালের মেথর সুষেন পাঁচিলের ছোট্ট দরজা খুলে তাঁর ‘বিনয়দা’কে পালাতে সাহায্য করেছিল, পরে পুলিশের অকথ্য অত্যাচারেও সে মাথা নোয়ায়নি। ‘সাধারণের চোখে ছোটলোক’ এই মানুষটির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ঝরে পড়েছে। দীনেশ গুপ্তর ফাঁসির পরদিন ভানু দেখেছেন, ঢাকার কুখ্যাত গুণ্ডা ভোলা মিঞা, যাকে অসামাজিক কাজের জন্য বেদম পেটাতেন দীনেশ গুপ্ত ও তাঁর ছেলেরা, দীনেশের মৃত্যুতে সেই লোকটাই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে।
দীনেশ গুপ্ত মারা যাওয়ার পর জড়িয়ে পড়েন ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র কাজে। ’৪১ সালে, যখন বিএ পড়ছেন, কোনও এক ব্রিটিশ ইনফর্মার খুন হল অনুশীলন সমিতির হাতে। সে দলের পাণ্ডা ছিলেন উনি। ফলে হুলিয়া জারি। পালিয়ে আসতে হল পুব বাংলা ছেড়ে। তা’ও আবার কীসে? না, বন্ধু গোপাল মিঞার গাড়িতে, সিটের নীচে পাটাতনে লুকিয়ে।
চল্লিশের দশকের শেষ। পুববাংলা থেকে তখন দলে দলে উদ্বাস্তু আসছে। মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে ‘ইস্টবেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ তাঁদের সাহায্য করতে সীমান্তে, স্টেশনে শিবির গড়ছে। শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত এক করে কাজ করছেন। সেই দলে ছিলেন ভানুও। তখন একটি অপেশাদার নাটকের দলও গড়েছিলেন। তারই এক সদস্য সলিল সেন উদ্বাস্তুদের নিয়ে লেখেন ‘নতুন ইহুদী’। সেই নাটকে ভানুর অভিনয় অভিভূত করে দেয় তখনকার তাবড় শিল্পীদের। লোকে বলে, এই সাফল্যই ওঁকে পুরোদস্তুর অভিনয়ে ফিরিয়ে দেয়।
মাস্টারদার সহযোদ্ধা বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে তিনি খুব ভক্তি করতেন । অনন্ত সিংহ তাঁর ছবির প্রযোজকও হয়েছিলেন। প্রথম দুটোই ডাহা ফ্লপ। ‘শেষ পরিচয়’, ‘নতুন প্রভাত’। পরেরটা অবশ্য ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। গল্পটা হলিউডি ছবি থেকে ধার করা। ছবির প্ল্যান-প্রোগ্রাম যখন সারা, তখনই খবর এল, ওই একই গল্প নিয়ে বিকাশ রায়ও ছবি করছেন। তখন পরিচালক আর প্রযোজকের সঙ্গে বসে গল্পটা আমূল বদলে দিয়েছিলেন তিনি । আর বাকিটা ইতিহাস | এর মধ্যে কয়েকটি ছবিতে শুধুমাত্র অনন্তের সম্মানে বিনা পারিশ্রমিকেও কাজ করে দিয়েছিলেন তিনি, যিনি কিনা কৌতুকাভিনেতাদের ‘লোক-হাসানো অভিনেতা’ তকমায় অভিহিত করা হতো বলে বরাবর যোগ্য সম্মান ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক দাবি করে বহু প্রযোজকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
১৯৭০-এর দশকে অনন্ত সিংহ গ্রেপ্তার হন। তাঁর মত বিপ্লবীর এহেন অবস্থা অনেককেই ব্যথিত করেছিল। এই সময় এক সাংবাদিক অনন্ত সিংহকে ডাকাত বললে তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তাঁকে গালাগাল দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। অনন্ত সিংহ তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন তাঁর মেয়ে বাসবীর বিবাহ সম্পন্ন হল। মেয়ের বিয়ের ভোজ নিজের হাতে জেলবন্দি অনন্তের জন্য পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি।
তিনি সাম্যময় ওরফে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় | ভানুর সম্পর্কে অনন্ত সিংহ বলতেন – ‘ছায়াছবির মাধ্যমে সামাজিক দুষ্কর্ম, সরকারের অক্ষমতা ও তথাকথিত নেতাদের প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর শ্লেষপূর্ণ ও বিদ্রুপাত্মক অভিনয় যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলবেন, ভানুবাবুর অন্তরে দেশপ্রেমের আগুন প্রজ্জ্বলিত আছে।’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
জন্মদিনে বিনম্র প্রণাম ।
© অহর্নিশ
তথ্য - আনন্দবাজার পত্রিকা, লেখালিখি(ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়)
===============
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমা জগতে এক চিরকালের নাম। অভিনেতা হিসাবে অবিকল্প। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় শুধুই কি নিছক একজন কমেডিয়ান? স্বাধীনতা সংগ্রামী, রস সাহিত্যস্রষ্টা থেকে একজন দরদী মানুষ 'ভানু'কে কতজনই বা জানেন! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আত্মকথা' এক সার্থক জীবন-স্মৃতি। অসাধারণ কলমে সেই সময়ের সমাজ, দেশভাগ ও ছিন্নমূল মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-বেদনা থেকে শুরু করে যাত্রা-নাটক-সিনেমা জগতের এক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, ফুটে উঠেছেন মানুষ 'ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।' পাশাপাশি তাঁর সম্পর্কে বরেণ্য মানুষদের স্মৃতিচারণ, কার্টুন, দুষ্প্রাপ্য ছবি...এই সবকিছু নিয়ে 'ভানু সমগ্র'। এক অদ্বিতীয় গ্রন্থ।
আমাজন লিংক : https://amzn.to/3HOBAsh