07/11/2025
প্রায়ই ল্যাবরেটরিতে তাঁর ছাত্রছাত্রী ও সহ-বিজ্ঞানীদের বলতেন, “পোলোনিয়াম আর রেডিয়াম আমার ওপর রাগ পুষে রেখেছে।” শুরুর দিন থেকেই নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নিজের গবেষণাই তাঁকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে | তবুও তিনি গবেষণার কাজে কোনো অবহেলা করেননি। বরং স্বাভাবিকভাবেই গবেষণার চালিয়ে গেছেন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করা আর মৃত্যু সমার্থক | তাই তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুব একটা সতর্কতা মানার অভ্যাস তার ছিল না। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ লেগে থাকা টেস্টটিউব পকেটে নিয়ে চলাফেরা করতেন | এগুলো সংরক্ষণে ডেস্কের ড্রয়ার ব্যবহার করতেন। বুকপকেটে করে গবেষণার জন্যে রাতে বাড়িতেও নিয়ে আসতেন রেডিয়াম | রাতে না ঘুমিয়ে বাড়িতে বসে রেডিয়াম নিয়ে গবেষণা করতেন | কি অদ্ভুত তাই না !
বোহেমিয়া থেকে যখন পিচব্লেন্ডের টিন আসত ল্যাবরেটরিতে, উত্তেজনার বশে অনেক সময় তিনি ইলেক্ট্রোমিটার নিয়ে পিচব্লেন্ডের ভেতরে সরাসরি হাত ডুবিয়ে দিতেন। কোনওরকম সুরক্ষা না নিয়েই। পিচব্লেন্ডের গোপন রহস্য জানার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে পড়তেন, যে নিজের সুরক্ষা নেওয়ার সময়টুকু নষ্ট করতে চাইতেন না। অথচ তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের তেজস্ক্রিয় মৌলের টেস্ট টিউব ধরতে বলতেন চিমটা দিয়ে। তাঁদের সুরক্ষিত করতেন সিসার আস্তরণ দেওয়া দস্তানা পরিয়ে।
১৮৮৯ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত তিনি যে নোটবুক ব্যবহার করেছেন সেটা আজও রাখা আছে প্যারিসের "বিবলিয়োথেক ন্যাশনাল’-এ | সেই নোটবুক থেকে যে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ছে সেটা আগামী ১৫০০ বছর অবধি চলবে | হ্যাঁ ঠিক শুনছেন | ১৫০০ বছর | কারণ এই সমস্ত জিনিসপত্রে লেগে আছে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম-২২৬, যার তেজস্ক্রিয়তার আয়ু ১৫০০ বছর | আজ যদি কোনও গবেষক ওগুলো ঘাঁটতে চান, তা হলে তাঁকে মুচলেকা দিয়ে ঘোষণা করতে হয় তিনি বিপদ বুঝে কাজে নামছেন , তার জীবন ঝুঁকিতে পড়লে সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। তবে আজও মহান এই বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পরও তার প্রতি জ্ঞানপিপাসুদের আগ্রহ কমেনি। আজও অনেকেই তাঁর ডায়েরি, গবেষণার কাজে ব্যবহার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে গবেষণা করেন। যদিও তেজস্ক্রিয় নিরাপত্তার বিশেষ পোশাক পরে তবেই মেরি কুরির জিনিসপত্রে হাত দেওয়ার অনুমতি মেলে।
© অহর্নিশ
৪ জুলাই, ১৯৩৪ |
মায়ের বিছানা থেকে একটু দূরে বসেছিলেন ছোট মেয়ে ইভ। বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করছিলেন, “মা কেন চুপচাপ হয়ে গেল! আর কেন কাঁপছে না মায়ের হাত দু’টো।”
মাকে ছোঁয়ার অনুমতি ছিল না। মেরি কুরির হাত দু’টি ক্রমশ শক্ত হতে শুরু করেছিল। হাতের চামড়ার জায়গায় জায়গায় পুড়ে যাওয়ার মত অসংখ্য কালো কুচকুচে দাগ দেখতে পাচ্ছিলেন ইভ। সেগুলি তেজস্ক্রিয়তার চুম্বনের চিনহ। ক্রমশ দ্রুত হতে শুরু করেছিল ঘরের ভিতরে চিকিৎসক ও নার্সদের চলাফেরা।
একসময় মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসক। যাওয়ার আগে ইভকে বলে গিয়েছিলেন,” মেরি আর নেই।” সূর্য্যের শেষ রশ্মি গায়ে মেখে পৃথিবী ছেড়েছিলেন কুরি। মৃত্যুর কারণ ‘অ্যাপ্লাস্টিক পার্নিসিয়াস অ্যানিমিয়া’। ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তার ফলে কার্যক্ষমতা হারিয়েছিল কুরির হাড়ের ভেতরে থাকা মজ্জা। মাদাম কুরির শরীরে রক্তকণিকা তৈরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চিরতরে।
© অহর্নিশ
মৃত্যুর পর মাদাম কুরিকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত একটি বিখ্যাত সমাধিক্ষেত্রে। যেখানে শুয়ে ছিলেন দার্শনিক রুশো, ভলতেয়ার সহ ফ্রান্সের আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ।
মৃত্যুর পরেও মাদাম কুরির শরীর ছড়িয়ে চলেছিল তেজস্ক্রিয়তা। তাই তাঁর দেহের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে, মাদাম কুরির কফিনকে মুড়ে ফেলা হয়েছিল এক ইঞ্চি পুরু সিসার আস্তরণ দিয়ে।
এবার এক অজানা ঘটনা শুনুন | শুনলে অনেকেই চমকে উঠবেন | মেরি কুরিকে কিন্তু ১৯০৩ সালে নোবেল পুরস্কার দিতেই চায়নি নোবেল কমিটি | এমনকি তাঁর নাম মনোনীতও হয়নি | সেই বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন পান পিয়ের কুরি (মেরি কুরির স্বামী) এবং হেনরি বেকারেল | কিন্তু এতে বেঁকে বসেন পিয়ের কুরি | দাবি স্পষ্ট - মেরির নাম না থাকলে তিনি কোনওভাবে পুরস্কার গ্রহণ করবেন না | এরপর নড়েচড়ে বসে নোবেল কমিটি | মেরি কুরির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় | তিনজনেই একত্রে নোবেল পান |
দ্বিতীয়বার যখন নোবেল পেলেন নোবেল কমিটি মেরিকে বলেছিল আপনি পুরস্কার না নিতে এলেই মঙ্গল ! এ বার মনোনীত হয়েছেন কেমিস্ট্রি প্রাইজের জন্য। পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য | অর্থাৎ, মাত্র আট বছরের ব্যবধানে দু’-দু’বার দুই আলাদা বিষয়ে নোবেল। এ হেন বিজয়িনীর তো মহাসমারোহে অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা। তাঁকে কিনা চিঠি লিখে জানানো হল, আপনি পুরস্কার নিতে না এলে ভাল হয় ! কিন্তু কেন এমন বলা হল ? কারণ মানুষের কুৎসা আর তাঁর অবৈধ প্রেমকাহিনি নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা প্রচার | কেউ তাঁকে বলত ‘ডাইনি’, কেউ বলত ‘ঘর-ভাঙানি’।তথাকথিত প্রগতিশীল দেশ ফ্রান্সের মানুষের বিষনজর ছিল তাঁর উপর | তবুও শেষমেশ তিনি নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন |
© অহর্নিশ
এত কুৎসার পরেও মেরি কুরি নিজের গবেষণায় ছিলেন অবিচল | হয়ত এই কারণেই প্রায়ই বলতেন “Be less curious about people and more curious about ideas.” যে ফ্রান্সের মানুষরা তাঁর নামে কুৎসা ছড়িয়েছিল,প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের পাশেই দাঁড়ালেন তিনি | ফরাসি সেনাদের চিকিৎসায় ১৮টা ভ্যানে এক্স-রে মেশিন নিয়ে ছুটে বেড়ালেন লড়াইয়ের ময়দানে | তিনি এমনই !
মেরি কুরি বিশ্বের প্রথম মহিলা যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন |
তিনি বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যাকে দুইবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে |
তিনি আজ অবধি বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুটি পৃথক বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন |
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মোট ছ’বার, তার মধ্যে পাঁচবার একই বিষয়ে, একসঙ্গে। শুরুটা হয়েছিল ১৯০৩ সালে, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন পিয়ের ও মেরি কুরি একত্রে (হেনরি বেকারেলের সঙ্গে)। মজার কথা হল এর পরেই যে স্বামী-স্ত্রী জুটি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁরা এঁদেরই মেয়ে-জামাই আইরিন জোলিও-কুরি আর ফ্রেডরিক জোলিও। তাঁরা এই পুরস্কার পান রসায়নে ১৯৩৫ সালে। একই পরিবারের চারজন নোবেল পুরস্কার প্রাপক | সুতরাং স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও বাবা-মেয়ে, মা-মেয়ে, বাবা-জামাই, মা-জামাই সকলেই হলেন নোবেল প্রাপক | এমন পরিবার আজ অবধি পৃথিবীতে একটিই - কুরি পরিবার |
সাফল্য সবাই দেখে | মাঝের লড়াইয়ের বছরগুলোর কথা কতজনই বা জানে !
মারি স্ক্লোদাওস্কা কুরি | মেরি কুরি | এক লড়াইয়ের নাম | আজ এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিবস |
প্রণাম ও শ্রদ্ধার্ঘ্য !
© অহর্নিশ
তথ্য : রূপাঞ্জন গোস্বামী (the wall ), তেজস্বিনী - পথিক গুহ - আনন্দবাজার পত্রিকা , উইকিপিডিয়া, রোর বাংলা
(ছবিতে স্বামী পিয়ের কুরির সাথে মেরি কুরি)
বিস্তারিত জানতে পড়ুন The Life and Times of Madame Curie
আমাজন লিংক : https://amzn.to/3CV5lBx