24/04/2023
শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, আপনাদের পায়ে পড়ি, স্কুলশিক্ষা নিয়ে দুটো কথা লিখুন আপনাদের সোনার লেখনি দিয়ে। তাতে না-হয় কেউ সাময়িক একটু ক্ষুণ্ন হবে, যে পুরস্কার পরের মাসে পাওয়ার কথা,তা না হয় পরের বছর পাবেন ।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা মাধ্যম স্কুলের দুরবস্থা নিয়ে দুটো প্যারাগ্রাফ লিখুন না-হয় শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে আপনার জনপ্রিয়তায় একটুও ভাঁটা পড়বে না। এত এত কবিতা লেখেন, গান লেখেন, ভারি ভারি উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যকে ভারাক্রান্ত করেন প্রতিদিন, বাংলার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে গিয়ে শিক্ষক পাচ্ছে না, শেখার পরিবেশ পাচ্ছে না-- এই নিয়ে একটু লিখলে আপনার কলমের কালি কি ফুরিয়ে যাবে ?
বর্ষীয়ান কবি, মাননীয় জয় গোস্বামী, নমস্য ব্যক্তি আপনি। আপনার তো আর পাওয়ার কিছুই নেই। আপনি লিখুন না-হয় দু'-চার কথা এই নিয়ে ? আপনাদের লেখা তো উপরমহল পর্যন্ত পৌঁছায়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় স্যার, আপনি বলুন, বাচ্চা ছেলেদের যদি ঠিক করে লেখাপড়া শেখানো না হয়, আপনার 'দূরবীন' 'ঘুণপোকা' 'পার্থিব' 'মানবজমিন' - এইসব মোটা মোটা বই কারা পড়বে আর দশ-বিশ বছর পরে ? বাচ্চারা লেখাপড়া না শিখলে ঠাকুর অনূকুলচন্দ্র কি পারবেন এই সমাজকে রক্ষা করতে ?
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, আপনার অনবদ্য বাগ্মীতা দিয়ে একটা মিনিট-ছয়েকের ভিডিও ছাড়ুন না ! আপনার কণ্ঠস্বর তো চোদ্দতলা অবধি পৌছোবে ! নাকি আপনি এগুলোকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মনে করেন না আজকাল ?
মাননীয় মৃদুল দাশগুপ্ত, ইন্টারনেট দেখে জানতে পারলাম আপনি এখনও জীবিত। ক্লাস টুয়েলভে আপনার লেখা কবিতা পড়াতে গিয়ে খুব হাসি পায়। আপনার নাকি প্রগাঢ় সমাজচেতনা, সমাজের জন্য ভেবে নাকি আপনার নির্ঘুম রাত্রি কাটে ? আপনার বিবেক নাকি বারুদের মতো তেজালো, যখন তখন বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে চায় ? 'ক্রন্দনরতা জননী'র পাশে থাকবেন বলে আপনার প্রতিশ্রুতির কথা দ্বাদশ শ্রেণীর সদ্য তরুণেরা আর বিশ্বাস করতে চায় না, জানেন ! একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আপনার সমাজচেতনার চারাগাছটা কি ছাগলে মুড়িয়ে খেয়ে নিয়েছে ? নাকি, সমাজ অশিক্ষিত থাকলেই আপনাদের সমাজচেতনা আরও বেশি মাল্য-চন্দনে বিভূষিত হবার সম্ভাবনা ?
শ্রেণীব্যবস্থার উঁচু ডালে বসে রয়েছেন যেসব চিত্র পরিচালক, ছবি আঁকিয়ে, গাইয়ে-বাজিয়ে, অভিনেতা, অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী, বাচিকশিল্পী, যাঁরা ভালো সংস্কৃতি বানাবেন বলে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কিছুদিন পরে আপনাদের ভালো সংস্কৃতির খদ্দের জুটবে তো ? কে বুঝবে ভালো আর মন্দের ফারাক ? সেই চর্চা কোথায় ? সেই শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছে কতখানি-- খোঁজ নিয়ে দেখেছেন একবারও ? বাংলার বিদ্যালয়গুলো যদি মরুভূমি হয়ে যায়, শিক্ষাহীন ভিক্ষাসর্বস্ব জাতিতে যদি পরিণত হয় পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি, কে দেখবে আপনার বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমা-থিয়েটার ? কে শুনবে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, জগন্নাথ বসুর শ্রুতিনাটক ? নোংরা ইউটিউব ভিডিওর রমরমা পেরিয়ে, ওদের বিনোদন জগতে আপনাদের ঠাঁই হবে তো ?
ফ্রেন্ডলিস্টে যাঁরা রয়েছেন
মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম আর লার্নিং অ্যাপ দিয়ে বাচ্চার স্বর্ণপ্রসূ ভবিষ্যতের কল্পনায় বুঁদ হয়ে আছেন যাঁরা, তাঁরাও জানবেন, এই সমাজেই আপনাদের থাকতে হবে। এই শিক্ষাহীন-শৃঙ্খলাহীন প্রজন্মই কিন্তু আপনার সন্তানের সহনাগরিক হবে। হয়তো নেতা হয়ে মাথায় চড়ে বসবে কোনোদিন। নগর পুড়লে আপনার দেবালয় অক্ষত থাকবে না। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ শিক্ষা-সংস্কৃতিহীন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলে, কেউই আমরা নির্বিঘ্নে বাঁচতে পারবো না।
সবার উপরে, সবার আগে, সবকিছু ছেড়ে, আগে চাই শিক্ষা। আগে চাই শিক্ষক। স্কুলে চাই শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা। চাই শিক্ষার পরিবেশ। চাই পূর্ণ সময়ের শিক্ষামন্ত্রী। তাঁবেদার-মুক্ত, দক্ষ ও স্বচ্ছ একটা পরামর্শদাতা কমিটি, যাঁরা সবদিক বিবেচনা করে সময়োচিত পরামর্শ দিতে জানেন। চাই সৎ ও সুদক্ষ মূল্যায়ন ব্যবস্থা, উন্নত আধুনিক পরিকাঠামো। চাই এই সবকিছুই, কারণ, মানুষের বেঁচে থাকার মান উন্নত করার একমাত্র উপায় হলো মানুষকে শিক্ষিত করা।
এই পোস্ট শিক্ষার দাবিতে, শিক্ষকের দাবিতে। আমার-আপনার বাড়ির নিষ্পাপ কচিকাঁচাদের কণ্ঠস্বর এই লেখা। ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থ ছাড়া, অন্য কোনো মোটিভ নেই এই লেখার পিছনে রাজনৈতিক-বিরোধিতা নয়, সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি- তৃণমূল... কারোর পক্ষে বা বিপক্ষে নয় এই লেখা।
শেয়ার করে, কপি-পেস্ট করে, মুখে মুখে-- যেভাবে হোক ছড়িয়ে দিন এই লেখা, এই দাবি। পাড়ার চা-দোকানি থেকে হাইকোর্টের বিচারপতি-- সবার কানে পৌঁছে যাক জ্বলন্ত এই দাবি।
সবার উপরে, সবার আগে, সবকিছু ছেড়ে, প্রথমে চাই শিক্ষা। স্কুলে চাই যোগ্য শিক্ষক। চাই শিক্ষার যোগ্য পরিবেশ।
( সংগৃহীত)