20/09/2025
কে বলেছে চিঠিপত্রের যুগ আর নেই? পাগলিনীর কথা নইলে তো জানাই হত না! উন্মাদিনীদের ঝুলিতে নবতম সংযোজন, Suparna Abhaya Bhattacherjee লিখলেন। পড়ে দেখুন, চেনেন কি সেই পাগলিনীকে?
#চিঠি চার
পাগলিনী,
টুপ্ টুপ্ খসে যায়। বৃতি থেকে দলমণ্ডল । দলমণ্ডল থেকে একটি একটি বছর। স্মৃতির উড়নি আঁকড়ে ধরতে ধরতে পুকুর জল। এখনো কালের গালে থাপ্পর কষে আমার আমগাছে কোকিল ডাকে। ছলাক শব্দে নারকেল পড়ে জলে। আর সেই জল ঘিরে এখনো মাছেদের দাপাদাপি । ওই জল ছেঁচে পায়রার খোপের মতো ঘরবাড়ি,দূরবীনে! ওই দেখো আল বেয়ে আসছে সালমন চাচা। সবুজ ধানের কোলে হাওয়া শন্ শন্। এমন ছবি চোখ থেকে কেড়ে নেবার সাহস নেই তোমাদের দূরভাষের। আকাশে উড়োজাহাজ । একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাবার বস্তা করে চাল কিনে রাখা। ফিরে চল রে মেয়ে সে রূপকথার দেশে। যখন পাশের বাড়ির অমূল্যর বাঁশি শুনে নদীর গায়ের পাশে পরী নামত। ডানাদুটি খুলে রাখত ভিজে পাথরে। ফিরে চল রে মন কলি পার করে সত্য,ত্রেতা,দ্বাপরে।
পাথর করে দিক কেউ অভিশাপে।
উৎসবের বরণডালার উপাচারে স্বস্তিক চিহ্ন ম্লান। নবান্নের উৎসবে ক্ষিদের নকশীকাঁথা বোনা। কুয়াশায় মনের আকাশে জমাট বাঁধা পৌষের উৎসব।নতুন গুড়ের গন্ধে গোটা গাঁ ঘর মাতাল হয় কই?
তবু দেখ,নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। আমার জানালার কাছেই রাইটিং টেবিল। আজকাল হাত কাঁপে। হস্তলিপি তে মিশন স্কুলে ফুল মার্কস পেতাম ,এখনকার লেখা দেখে , বিশ্বাস হয় না । স্কুলে বড়দিনের উৎসব হতো।'
হো সান্না,হো সান্না,এলেন শান্তিরাজ/ধন্য ,তিনি ধন্য,পথ খুলো যীশুর জন্য/নিজ রাজ্য লইবেন আজ'।,
সাদা ফ্রক,লাল রিবন আমরা গাইছি।মুখরিত বাতাস সুরের দানায়।
সামনেই প্রতীক্ষার উৎসব।এবছর কেমন যেন পুজো পুজো গন্ধ নেই ঘরের উঠানে।মনে পড়ে, একবছর এই আশ্বিনের উৎসবে আমাদের খেলার সাথী অমরের দেশের বাড়ি দুগ্গা পুজো দেখতে গিয়েছিলাম সরিষায়। তখন কেমন একটা ক'রে দেশের বাড়ি থাকতো সকলের। আমাদেরও ছিলো এককালে।ঠাকুরদাদার বাড়ি, ঢাকার বিক্রমপুরে।সে বাড়ি আমি দেখেছি,ঠাকুমার চোখর আয়নায়।মায়ের রাতের গল্পে দিদুর নিজে হাতে সাজানো খুলনার বাড়ি।কোনোদিন আর যাওয়া হয়ে উঠল না আমাদের সেই সব স্বপ্নপুরীতে। একবার ত্রিপুরায় নাটকের আমন্ত্রণ শো করতে গিয়ে নদীর বুকে বাঁশের সাঁকোর উপর টলটল পায়ে পার হয়ে, নো ম্যানস ল্যাণ্ড পেরিয়ে শিলচর পুলিশ ব্যারাকে গিয়েছিলাম। আমার কেমন অদ্ভুত মনের অবস্থা হয়েছিল। গলার কাছে ব্যথা।চোখ ঝাপসা।
এখানেই ছিল আমাদের শিকড়।উপড়ে নিয়ে কোথায় ভাসিয়ে দিয়েছ গো তোমরা!
অন্য কথায় চলে গেলাম কেমন। বেলাশেষে উপুড়ঝুপুড় সব বলতে সাধ হয়।
যা বলছিলাম, গেছো মেয়ে ছিলাম,ফুটবল খেলতাম ছেলেদের সঙ্গে। তাই কাউকে তোয়াক্কা না করেই চলে গেলাম তাদের হাত ধ’রে। সে পুজোতেই কিশোরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার।তাদের নাটমন্দিরেই তো একচালার দুগ্গা ।অমরের জেঠুর ছেলে ছিল কিশোর।
শিউলি ফুল এনে দিয়েছিল সে আমাকে,মুঠোয় ভ'রে।
বিসর্জনের দিন ঢাক বাজছে তুমুল। অমরদের বাঁধানো পুকুরঘাটে প্রতিমা নামানো। লাল রঙের সিঁড়ি জলের কোল অবধি।
ঢাকিরা তুমুল শব্দে কাঠিতে বোল তুলছে।সব মায়েদের মুখ ভর্তি লাল টুকটুকে সিঁদুর।
এক পটে আঁকা ছবি। আমি যেন
প্রতিমার চোখের কোলে জল দেখলাম। হঠাৎ ঈশান কোন থেকে উড়ে এলো শঙ্খচিল । আমি আর কিশোর একসঙ্গে গুনলাম, এক ,দুই,তিন,,,,,মোট সাতটা। চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো প্রতিমার মাথার ওপর। তারপর চলে গেলো ওপরে,আরো ওপরে। প্রতিমার ডুব ,জলের বুদবুদ্। বিসর্জন।
আমাকে কিশোর কানে কানে বললো,'কাঁদিস না,বোকা মেয়ে। ’
বোকাই বটে। বোকার বোকা তস্য বোকা।
অমরের ঠামু দধিকর্মা তুলে দিলেন হাতে। এই এত্তো!আমি বললাম,’দেখো,কেমন অগরুর গন্ধ। ,’
কিশোর বলেছিল,’মানুষের ভালোবাসার বয়স বাড়লে অমন গন্ধ বের হয়। ’
পাকা ছিল সবুজ শ্যামল কিশোর।
কিশোর এখন প্রৌঢ়।অগরুর সৌরভ ধুয়ে গেছে শরীর থেকে।
কিশোরের ছেলে সাইকেল চালিয়ে অফিস যায়।আসতে যেতে তিনঘন্টা।শিরায় টান ধরে ছেলের রাতের গভীরে।
কিশোরের বৌ সুলেখা ,রসুন তেল মালিশ করে দেয় ছেলের পায়ে। কিশোরের ছেলের বৌ চলে গেছে,গুমোট সোঁদা ঘরের গন্ধ তার অসহ্য বোধ হয়েছিল কোন এক নববর্ষের উৎসবে।
সরিষার উৎসবে কিশোরের নাম রেখেছিলাম,' অমলতাস'।কিশোর ছেলের নাম রেখেছিল ' আনন্দ'।
কিশোর আমাকে আর আগের মতো চিঠি লেখেনা।এখন আর বন্ধু নই আমরা।সত্যিই কি তাই?
অমর,কিশোরদের দেশের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে,টুকরো টুকরো হয়ে।
আমি আমার উঠানের শিউলি গাছের ফুল মাটি থেকে তুলতে পারিনা,নীচু হয়ে।শিড়দাঁড়া জবাব দিয়েছে বহুদিন
এ শিউলি গাছ এনে বসিয়েছিলাম রথের উৎসবে।
একশত আটবার দূর্গা নাম লিখতে বসেছিলাম,সরিষা থেকে ফিরে এসে। মায়ের উনুন আঁচে নাড়ু পাক দেবার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল বাড়ির আনাচে,কানাচে। আমার শঙ্খচিল হতে ইচ্ছা হয়েছিল, লিখতে লিখতে। টুপ্ ক’রে একফোঁটা চোখের জলে কালির আখর ধুয়ে জলছবি। তখন পবিত্র মন ভয় পেয়েছিল 'দুগ্গা বুঝি রাগ করলেন।'
আজ হাসি পাক খায় বুকে। জেনে গেছি,প্রতিমার আসল কাঠামো মাটি ,খড় আর বাঁশ দিয়ে হয়।
আমি খড়খড়ে হাতের আঙুল দিয়ে জানালার গ্রীল ধ'রে দাঁড়িয়ে থাকি। ঈশান কোণের দিকে তাকিয়ে।
মেঘ পার ক'রে শঙ্খ চিলের উড়ান দেখার আশায়,,,
উ..ড়া...ন...
ভালোবাসা নিও গো মেয়ে,,,
***************************************
আপনিও কি লিখবেন এমন কোনও চিঠি যা লাল ডাকবাক্সটার মধ্যে ফেলাই হয়নি? পোস্ট করুন, #চিঠি হ্যাশট্যাগ দিন আর আমাদের ট্যাগ করুন যাতে পড়তে পারি।
মা আসছেন!
ছবিতে পিঁজরা নাটকের একটি উন্মাদ মুহূর্ত!