17/08/2025
“কী ব্যাপার? এতদিনে বুঝি হরগেহিনীর তার এই অভাজন ভাই হরিকে মনে পড়ল?” আগন্তুকের কণ্ঠের স্বাভাবিক কৌতুকে ধীরে ধীরে চোখ খোলে পার্বতী। ইদানীং কৈলাসের নিত্যদিনের কাজ যথারীতি সারার পর সে নিজেকে হয় ব্যস্ত রাখে পড়াশুনার কাজে না হলে ধ্যানে। নানা বিষয়ে তার অসীম আগ্রহ। তাই নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে সে সদা সর্বদাই চর্চা করে যেতে পছন্দ করে। এছাড়াও কৈলাসে অবস্থান করলে সমগ্র আর্যাবর্তের রাজনীতি সম্বন্ধেও সে নিজেকে সম্যকভাবে অবহিত রাখে নিত্যদিন। এই বিষয়ে তার মাতৃকাগণ তাকে সংবাদ সরবরাহ করে থাকে। এখন অবশ্য সে মহাদেবের বসার আসনের বাম পাশে তার জন্য যে স্থান নির্দিষ্ট ছিল সেখানে বসেই ধ্যানে মগ্ন ছিল। নিজেকে জানাই যে ধ্যানের সবচেয়ে বড়ো উদ্দেশ্য। চোখ খুলে সে শ্রীহরি বিষ্ণুকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা এবং প্রণাম জানায়।
মহাদেবের অনুপস্থিতিতে পার্বতী নিত্যদিন তাঁর বসার আসন সুসজ্জিত করে রাখে। ব্যাঘ্রচর্মের যে আসনের উপর মহাদেব বসতে পছন্দ করে, সেই আসন সে নিজের হাতে পরিছন্ন করে পুষ্প দিয়ে সুশোভিত করে রাখে। দেবাদিদেব যে ব্যাঘ্রমুণ্ডের উপর নিজের পদ স্থাপন করে ধ্যানে নিমগ্ন থাকে সেই ব্যাঘ্রমুণ্ডের উপরেই পার্বতী প্রত্যহ বিল্বপত্র, ধুতুরা, আকন্দ প্রভৃতি মহাদেবের প্রিয় পুষ্প পল্লবের অর্ঘ্য রচনা করে। এই সকল পুষ্প, পল্লব হিমালয়ের এই তুষারাবৃত প্রান্তরে অতি বিরল। তা সত্ত্বেও মহাদেবের গণেরা পার্বতীর আদেশে এ সকল দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করে আনে। আর সেই সংগৃহীত পুষ্পপল্লব পার্বতী বিশেষ দ্রব্যের প্রভাবে সংরক্ষণ করে রাখে দীর্ঘদিন।
“আমার তো তাও মনে পড়েছে। আমার ভ্রাতার তো তাও পড়ে না। জগতের পালন করতে করতে সে তো নিজের ভগিনীকেই বিস্মৃত হয়েছে। তাও আমার কত ভাগ্যি যে তার দর্শন মিলল। অবশ্য তার জন্য এই বোনকে কম তপস্যা করতে হল না।” মহাদেবের বসার স্থান থেকে অদূরেই কৈলাস ভবন। পার্বতী মৃদু হেসে শ্রী বিষ্ণুকে সেদিকেই নিয়ে যেতে যেতে বলে।
বিষ্ণু এবার হো হো করে হেসে বলে, “তা ভগিনী ডাকলে কি আর ভ্রাতা না এসে পারে? তবে এখানে এসে একটি কথা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি যে আমার ভগিনী আর আগের মতো ছোটোটি নেই। বরং বাকচাতুর্যে তার জুড়ি মেলা এখন বড়ো দায়।”
“তা ভ্রাতার গুণ তো ভগিনীর মধ্যে থাকবেই, তাই না? ভুলে যেও না তুমি নারায়ণ হলে আমিও কিন্তু নারায়ণী।” পার্বতীর ইঙ্গিতে জয়া নারায়ণের দিকে পাদ্যের কলস এগিয়ে দেয়। তারপর শুষ্ক বস্ত্রে তার পা মুছিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায়।
“তা বটে… তা বটে।” কৈলাস ভবনে বিষ্ণু সুখাসন গ্রহণ করতে করতে বলে।
এবার তাকে তুলসী, শ্বেত পদ্ম আর শ্বেত গন্ধ পুষ্পের অর্ঘ্য প্রদান করে পার্বতী। সানন্দে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করে শ্রীহরি। বিজয়া এবার এগিয়ে এসে নারায়ণের হাতে তুলে দেয় তুলসীর মঞ্জরী দেওয়া আচমনীয়।
শ্রী বিষ্ণুর আচমন সমাপ্ত হলে পার্বতীর ইশারায় জয়া একটি স্বর্ণ থালির উপর দধি পাখাল ও পনকমের পাত্র নিয়ে উপস্থিত হয়। পার্বতী নিজের হাতে নারায়ণের দিকে সে থালি এগিয়ে দিতে দিতে বলে, “এতদূর থেকে এসেছ প্রথমে এই শীতল পানীয় সেবন করে নিজের শ্রান্তি দূর করো।” নারায়ণ তার অতি প্রিয় দুই পানীয়ই একে একে গ্রহণ করে। এবার বিজয়া পার্বতী নির্দেশে নিয়ে আসে লক্ষ্মী বিলাস, জগন্নাথ বল্লভ, খাজা, ছানাপোড়া, ক্ষীর, চূড়াকদম্ব, বিলাস, মগজ নাড়ু, রসাবলী, সপ্তপুরী প্রভৃতি মিষ্টান্নে সুসজ্জিত পাত্র। সেই পাত্র জগন্নাথের সম্মুখস্থ তেপায়ার উপর রেখে পার্বতী বলে, “সবগুলোই কিন্তু গ্রহণ করতে হবে ভ্রাতা। কোনওটিই যে অবশিষ্ট না থাকে।” সেই কোনকাল থেকে নারায়ণকে নিজের ভ্রাতা হিসাবে গ্রহণ করেছে সে। তাদের মধ্যে এই বন্ধন এতটাই দৃঢ় যে সচরাচর কেউ দেখলে বলবেই না যে তারা সহোদর নয়।
“মহেশগৃহিনী অন্নপূর্ণার দেখছি সবদিকেই দৃষ্টি। তার ভ্রাতার কোন কোন মিষ্টান্নগুলি প্রিয় তাও দেখছি স্মরণে আছে।” মৃদু হেসে নারায়ণ মিষ্টান্নে মন দেয়। ইত্যবসরে পার্বতী বিষ্ণু পত্নী লক্ষ্মীর কুশল সংবাদ জানার পর অনুযোগ করে যে কেন সে লক্ষ্মীকেও সঙ্গে নিয়ে এল না; তাহলে এই অবসরে সে একজন সঙ্গী পেত। এরকম একথা সেকথার পর নারায়ণ জানতে চায়, “আচ্ছা এবার বলো তো, স্কন্দমাতা হঠাৎ দেবর্ষি নারদের মাধ্যমে এরকম জরুরি সংবাদ প্রেরণ করল কেন?”
পার্বতী খানিক চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলে, “তুমি তো জানোই লক্ষ্মীকান্ত, দেবাদিদেব আজ অনেকদিন হল কৈলাসে নেই আর কুমার স্কন্দও দাক্ষিণাত্যে নিজের কর্তব্যকর্মে ব্যস্ত। দেবসেনাপতি সে। স্বর্গরাজ্যের সুরক্ষার ভারও তার কাঁধে। এমতাবস্থায় একাকিত্ব আমাকে ক্রমশই যেন গ্রাস করছে।” একটা সুগভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার অন্তর ভেদ করে।
“সমস্ত জগৎ সংসার যাকে মা বলে ডাকে, জয়া বিজয়া সহ চৌষট্টি কোটি যোগিনী যার নিত্য সহচরী, নন্দী ভৃঙ্গী সহ অন্যান্য গণেরা যার একটি মাত্র আদেশে সমগ্র পৃথিবী তোলপাড় করতে পারে তার কিনা একাকিত্ব? সত্যিই বলো তো দেবী এই একাকিত্ব কি তোমার নতুন কোনও লীলা?” নারায়ণ ঠোঁটের কোণে রহস্যের হাসি অঙ্কন করে জিজ্ঞাসা করে।
পার্বতী এই কথার কোনও উত্তর না দিয়ে একই রকম রহস্যের হাসি হাসে।
“বেশ তাহলে বলো, আমাকে স্মরণ করলে কেন? কী সেই বিশেষ কার্য যাতে আমারও ভূমিকা থাকবে?”
“আমি ঠিক করেছি আমি এক সন্তান সৃজন করব, যে হবে আমার একান্তই নিজের আত্মীয়।”
“কিন্তু… মহাদেব তো এখন কৈলাসে নেই। তাকে ছাড়া…”
“মহাদেবের বীজ বিনা এই কাজ সম্ভব নয় আমিও জানি। তাই তো তোমার শরণাপন্ন হয়েছি নারায়ণ। তোমার মনে আছে হয়তো কুমারের জন্মের আগে আমাদের মিলনকালে দেবতারা ব্যঘাত সৃষ্টি করে। আসলে তারকাসুরের অত্যাচারে তারা ছিল জর্জরিত। সেই সময় শিবের বীজ ধারণ করেছিলেন অগ্নিদেব। পরবর্তীকালে সেই শিব বীজ এবং আমার বীজের নিষেক করিয়ে স্থাপন করা হয় কৃত্তিকার গর্ভে। অবশ্য জ্যেষ্ঠা গঙ্গাকেও তার গর্ভ ঋণ দিতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি রাজিও ছিলেন, কিন্তু বৈদ্যরাজ জানিয়ে ছিলেন ওই ভ্রূণ গর্ভে ধারণে জ্যেষ্ঠা অসমর্থা। তখন আমরা বাধ্য হয়েই কৃত্তিকাদের শরণাপন্ন হই। সেই শিব বীজের কিয়দংশ এখনও সংরক্ষিত আছে হিমালয়ের অতি নিম্ন তাপমাত্রায়।”
“তারপরেও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।”
“জানি তুমি কী বলবে। ওই সন্তানও আমি গর্ভে ধারণ করব না। শিব আর শক্তির সেই সন্তান জন্ম নেবে এক অনন্য উপায়। আর সেই উপায় তোমার অজানা নয়। আমাকে সেই পন্থা দেখাও হে জনার্দন।”
“ভালো করে ভেবে নিয়েছ তো পার্বতী। মহাদেব এই সময় কৈলাসে নেই, তার অবর্তমানে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত… তাছাড়া তুমি যে পন্থা অবলম্বন করতে চাইছ সেই পন্থা কিন্তু এখন অবধি কেবলই এক তত্ত্ব মাত্র, বাস্তবায়িত হয়নি। এর ফলাফল যে কী হবে তাও এখনও সম্পূর্ণ জানা নেই। আসলে কী বলো তো এই পন্থাটা প্রকৃতি বিরুদ্ধই বলা চলে।”
“তোমরাই তো আমাকে প্রকৃতি বলো। বলো আমিই নাকি পরাৎপরা আদি শক্তি। তাহলে যে কাজ স্বয়ং প্রকৃতি করতে চাইছে সে কাজ প্রকৃতি বিরুদ্ধ হয় কী করে?” নারায়ণকে পুনরাচমনীয় এগিয়ে দিতে দিতে পার্বতী বলে। তার গলায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা খেলা করে বেড়াচ্ছে। এই জন্যই কি তাকে আদি দম্ভিতা বলে অভিহিত করেছিল বিন্ধ্যাচল নিবাসী ঋষিরা?
উপন্যাসিকাঃ হেরম্ব সম্ভব
বইঃ অষ্টক ২
লেখকঃ সৌরভ আঢ্য
প্রকাশনীঃ বৃতি প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩২০/-