11/05/2025
ছোট গল্প---মাহাত্ম্য !
দেবাশীষ হালদার ।
গ্রীষ্মের দুপুর রাজপথ থেকে বৃন্দাবন নেমে এল ঝুড়ি মাথায় কলোনীর পথে ৷ পথ চলতি অল্প সংখ্যক মানুষ ফেরিয়ালার এই রকম অদ্ভুত হাঁকডাকে অবাক ৷ ঝুড়িতে রয়েছে মাটির তৈরী নানা দেব —দেবীর মূর্তি ৷ পথ ছেড়ে গলিতে ঢুকেই এরকম অদ্ভুত হকারি " রাধা—শ্যাম বিক্রি আছে"— শুনে কমলা আর থাকতে পারল না ৷ জানলা দিয়ে ডেকে তাকে বাড়ির দরজায় আসতে বলল ৷
দরজা খুলতেই বৃন্দাবন দেখল হাসি হাসি মুখ এক সুন্দরী মহিলা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়া ,মাথার সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে আর তার পাদুটি কি সুন্দর আলতা রাঙা ৷ দেখেই মনটা কেমন মা —মা করে উঠল৷ সে বলল বলুন মা —আপনি কি নেবেন ?
মহিলা মিষ্টি গলায় বলে উঠলেন , বাছা আগে এই বারান্দাতে উঠে এসে ঝাঁকাটা নামাও৷ আমি কি ধরে দেব ? গরমে ঘেমে একসা ! গামছা দিয়ে মুখটা মুছে ফ্যানের তলায় বস৷ ৷ আমি তোমায় একটু শরবৎ দিচ্ছি খাও তারপর সব দেখব ৷
কমলা ঝুড়িতে দেখল লক্ষী— নারায়ণ, শিব —পার্বতী, কৃষ্ণ —রাধা, রাম— সীতা, আর ঠাকুর ও মা র যুগল মূর্তি রাখা ! কমলা অবাক হয়েই প্রশ্ন করে ফেলল সবই যুগল মূর্তি যে— আলাদা করে কিছু নেই ?
১৫—১৬ বছরের গৌরাঙ্গ বৃন্দাবনের সপ্রতিভ উত্তর মা গো এ সৃষ্টি তো এগিয়ে চলেছে দুজনেরই কৃপায় ! আর আমার সৃষ্টি কর্তা দুজনেই আমার জন্মের পরেই আমায় ছেড়ে গেছেন ৷ অনাথ আশ্রমই আমার আশ্রয় ! খুবই ছোট আমাদের আশ্রম ৷ আমাদের আশ্রমে সব যুগল মূর্তিই তৈরী করা রেওয়াজ! সবাই মিলে মিশে তৈরী করে এই মূর্তি নানা কল্পনায় মমত্ব দিয়ে এদের নানা উপাখ্যান শুনে ৷
আশ্রমের ১৪/১৫জন আমার বয়সি ছেলেরা যে যার মত নিজস্ব চেষ্টায়এই মূর্তি তৈরী করি যা আমাদের ওখানে শেখানো হয় ৷
কমলা অবাক হয়ে শুনে চলেছেন বৃন্দাবনের কথা ! কমলার চোখ দুটো ছলছল করছে ৷
মা — আপনি কোনটা নেবেন ? বালক বৃন্দাবনের ডাকে কমলা সম্বিত ফিরে পেল ,বলল হ্যাঁ ৷ তুমি আমায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ —মা সারদা র যুগল মূর্তিটাই দাও ৷
বৃন্দাবন আঁৎকে উঠে বলল ৷ মা কিছু মনে করবেন না ৷ এই মূর্তিটা আমি বেঁচতে পারব না ৷ এটা আমার জীবনের প্রথম বানানো মূর্তি আর এ মূর্তি খুব পুরানো ৷ রং ও অনেক জায়গায় চটে গেছে বরং আপনি অন্য যে কোন টা নিন ৷
আসলে এই মূর্তিটা আমার প্রথম বানানো নিজের বাবা —মা ভাবা মূর্তি ৷ নিজের বাবা—মা কে কি কেউ বিক্রি করতে পারে ? আমার নিজের বাবা—মা কেমন ছিল তা জানি না ৷ বোধ আসার পরই আশ্রমের মাতাজীকে আমার বাবা মা র কথা বললেই তিনি আশ্রমের মধ্যে রাখা এঁদের ছবি দেখিয়ে বলতেন এঁরাই তোর বাবা মা ৷ মাতাজী আমাকে বৃন্দাবনের রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তাই বৃন্দাবন বলেই ডাকেন ৷ আমি প্রথম যে মূর্তিটা বানাই সেটা এঁদের ৷ নিজের বাবা মা কে তো কাছে পাইনি তাই এই মূর্তিটা বিক্রি করতে পারব না ৷ এরা আমার সর্বক্ষনের সঙ্গী তাছাড়া ..........
তাছাড়া কি ? ------
একথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি বা বলতে পারিনি কিন্তু আজ মনে হচ্ছে মা আপনাকে বলে আমি একটু হালকা হই ৷ এই যুগল মুর্তিটা সবসময় আমার সাথে থাকে ৷ আশ্রমে থাকলে আমার বিছানার বালিশের পাশে এরা শুয়ে থাকেন ৷ প্রথম যেদিন বিক্রির জন্য বের হচ্ছিলাম ঝুড়ি নিয়ে সেদিন এঁদের বিছানায় রেখে ঝুড়ি তুলতে এসে দেখি ঝুড়ি তুলতে পারছি না ৷ ভাবলাম মূর্তির ভার বেশী হয়েছে তাই হয়ত তুলতে পারছি না ৷ তখনই আমার মন কেন জানি না এক অদ্ভুত কথা বলতে লাগল ----
"ওরে আমাদের বিছানা থেকে নিয়ে ঝুড়িতে রাখ ,তোর সঙ্গে থাকতে দে— তবে তো পারবি ঝুড়ি ওঠাতে ! "
ভাবলাম এসব কি ভাবছি— আবার ভাবলাম এরকম মনে হল কেন ?
দেখি তো একবার —বলে মুর্তিটা ঝুড়িতে রেখে তুলতেই ঝুড়ি অতি সহজে তুলতে পারলাম ৷ আমার তখন হাত পা শরীর সব কাঁপছে ৷ বিছানাতে অনেকক্ষন বসে রইলাম ৷ মন যেন বলে উঠল ভয় পাস না ৷ আমরা তোর সাথে থাকব আর কিছু নয়! ওঠ ৷ মূর্তি বেঁচতে বেড়ো ৷আর আমাদের কে বেঁচিস না ৷
আসলে বেশ কয়েকদিন আগে এক ভদ্রলোক জোরকরেই বলা যায় এ মূর্তিটা আমার কাছ থেকে নিতে ঝুড়ি থেকে মূর্তিটা তুলতে গিয়ে পারলেন না ৷ আর ঠিক তখনই হঠাৎ ধুলোর ঘুর্ণি ওখানে শুরু হল আর তার চোখে ধুলো পড়তে তিনি সেখান থেকে বিদায় নিলেন ৷ আমিও পালিয়ে বাঁচলাম ৷ তারপর থেকে আমার বাবা— মা র এই মূর্তিটা সঙ্গে থাকে তবে বিক্রির জন্য নয় ৷
মা — তবে এইরকমই অন্য মূর্তি চাইলে গড়িয়ে এনে দেব ৷ কিন্তু এটি কে আমি বিক্রি করি না অনেক টাকার লোভ দেখালেও না ৷ না জানি আবার কি অঘটন ঘটিয়ে দেন ৷ আসলে এঁরা দুজন এখন আমার সঙ্গে সত্যিকারের সমন্ধ পাতিয়েছেন ৷ কমলা বললেন এত ভার তুমি বয়ে বেড়াও কি করে ?
বৃন্দাবন বলল আমার তো মনেই হয় না কোন ভার বইছি ৷ উনারা থেকে আমার সব ভার বয়ে বেড়ান যে ৷
আমার সঙ্গে থেকে এই মূর্তি এই ঝুড়ির সমস্ত ভার নিজেরা নেন আমার মনেই হয় না আমি কোন ভার বয়ে নিয়ে চলেছি ৷ একথা মা আজ আমি প্রথম আপনাকে বললাম নিজের মা র মত ভেবে ৷ এই কথা কাউকে বলবেন না ৷ লোকে বিশ্বাস ও করবে না ৷ এটা তো এঁদের মাহাত্ম্য ৷ সবাই বুঝবে না ৷ কেন জানি না মনে হল আপনি বুঝবেন তাই বলে ফেললাম ৷
কমলার অবাক হওয়া ও ভয় দুটোই হল ৷ বৃন্দাবনের বাবা মা কে কেনার চেষ্টা না করে একটি লক্ষী নারায়ণের যুগল মূর্তি কিনে বালক বৃন্দাবনকে মূর্তির টাকা আর বৃন্দাবনকে দুপুরের আহার করিয়ে তবে ছাড়লেন ৷
ঠাকুর আর মা র বালকের প্রতি মাহাত্ম্য দেখে শুনে তাঁদের করুণা ধারা বুঝে তাঁদের উদ্দেশ্যে গভীর প্রণাম অন্তর থেকে করে তাঁদের কৃপা পাবার অপেক্ষায় রইলেন !
আর বৃন্দাবনকে বললেন সময় পেলেই এসে দেখা করে যেও—আমার ভাল লাগবে ৷
বৃন্দাবনও ভূমিষ্ট হয়ে কমলাকে প্রণাম করে বলল —হ্যাঁ মা৷ আসব !
------------------