28/04/2025
সম্পাদকীয় ২৭/৪/২০২৫
পহেলগাঁওয়ের ঘটনা
এমন একটা সময় পহেলগাঁওতে হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক, সহিংস ঘটনা ঘটল, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশ বিহ্বলচিত্ত। যারা নিহত হলেন তারা ছিলেন নিরপরাধ। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মনোরম শোভার টানে সপরিবারে গিয়েছিলেন বেড়াতে। নিয়তির কাছে হলেন তারা অসহায়। প্রত্যেক মানুষের মৃত্যু দুঃখের ও বেদনার। স্বজনহারার বেদনায় শুধু পরিবারের লোকেরা নয়; অনুভূতিপ্রবণ সব মানুষই বেদনাহত হয়। যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল, তাতে কাশ্মীরের মানুষেরা সারা দেশবাসীর সঙ্গে কিন্তু একাত্মতা দেখিয়েছেন। সর্বাত্মক বনধ পালিত হয়েছে গোটা কাশ্মীরজুড়ে এবং তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে। সৈয়দ আদিল শাহ, যিনি টাট্টু ঘোড়ার সহিস, তিনি শহিদ হলেন।
মানবতাবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেলেন। ভিডিয়ো ফুটেজে তার স্ত্রী ও সন্তানদের কান্না বিজড়িত কণ্ঠ সমাজ মাধ্যমের বদৌলতে অনেকেই দেখেছেন। সেই কাশ্মীরের মানুষ, যিনি এক পর্যটককে নিজের পিঠের ওপর চড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই যে কাজ, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। পুরো কাশ্মীরের সমস্ত মসজিদ থেকে এই নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে আওয়াজ ভেসে উঠেছে। কাশ্মীরবাসীদের মনে যুগ যুগ ধরে অনেক দুঃখ, বেদনা পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। রক্তাক্ত এই কাশ্মীরের মানুষেরা ইনসানিয়াত তথা মানবতাকে ভুলে যাননি। তাদের চরিত্রের এই মূল্যায়ন সঠিক হওয়া দরকার। আজ অন্যান্য রাজ্যে কাশ্মীরি পড়ুয়াদের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে, তা ন্যক্কারজনক। এ হিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে মানবতাবাদীদের এগিয়ে আসতে হবে।
পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় যারা ঘোলা জলে মাছ ধরতে অভ্যস্ত, তারা মানবতার বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করেছে। রাজনীতির তুচ্ছ স্বার্থ তাদের কাছে সবসময়ই বড়। যারা ২৬-এর বদলে ২৬০ চান, তাদের রাজনীতির সবকটাই এমন ধরনের। প্রগলভতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, পাওয়ার পলিটিক্স – ক্ষমতার রাজনীতির নেশায় তারা মনোবিকারগ্রস্ত। তাদের চোখের চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি সবই একটি মানুষের পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পারভার্সান তথা বিকৃতি তাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। এরা ক্ষমতায় গেলে যে কী করবে তা সহজেই অনুমেয়। মনুষ্যত্বের সবক এদের নেই বলেই এমন আচরণ দেখা যাচ্ছে।
পুলওয়ামার ঘটনার পর আবার পহেলগাঁও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানা প্রশ্ন উত্থাপিত। যে প্রশ্নগুলির সঠিক জবাব সরকারের কাছে নেই। এতবড় একটা ঘটনা ঘটল প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটা সাংবাদিক সম্মেলন হল না। প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল না। সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অনুপস্থিত থাকলেন। তিনি চলে গেলেন আসন্ন বিহার বিধানসভার প্রচার অভিযানে মধুবনিতে। দেখলেঙ্গে – এই 'অমীয় বাণী' শুনালেন। অতীতেও নানা বিপর্যয়ের সময় এসব শোনা গেছে। রাজনীতিটাই এমন বিষম বস্তু!
পহেলগাঁওয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে ছিল না, সে বিষয়টি ষোলআনা খাঁটি। যারা ঘটনার জন্য দায়ী, তারা এত সময় পেল কী করে? সংঘটিত ঘটনার পর পালাতে পারল কীভাবে? সীমান্ত থেকে পহেলগাঁও ১৭০ কিলোমিটারেরও বেশি। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে কোথা থেকে এল? আর পালিয়ে কোথায় চলে গেল? কোন সদুত্তর নেই।
কলকাতার বিতানের মৃত্যু শোকে তার স্ত্রী সোহিনীকে নিয়ে যারা রাজনীতি করছে, তাদের মুখ পুড়ল নাকি? বিতানের দাদা সোহিনীর বিরুদ্ধে নানা জালিয়াতির যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা এখন সমাজ মাধ্যমে ঘুরছে। বিতানের দাদার কথাগুলির সত্যতার যাচাই হওয়া দরকার। যাহোক, পুলওয়ামার পর ভারত-পাক উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। আবার পহেলগাঁওয়ের পর একই অবস্থা।
বিহার নির্বাচন, ওয়াকফ আন্দোলন, ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের শাসানি – এমন সময় এই নৃশংস ঘটনা ঘটল।
পাশ্চাত্যের আগমার্কা রাজনীতিতে আসলেই মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু আছে কি? এখানে ক্ষমতাটাই আসল। যখনই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে, তখনই ধর্মের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে সেক্যুলার লোকেরা আত্মসুখ অনুভব করেন। আসলে আগমার্কা নানা মতবাদের কোলে-পিঠে মানুষ আর রাজনীতিটাই যে কদর্য, নোংরা হয়ে পড়েছে, সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। সব দোষ ধর্মের ওপর চাপিয়ে ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের আক্রমণে জর্জরিত সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন – এমন সহিংস ও কদর্য রাজনীতির মোকাবিলা না করতে পেরে ধর্মের ঘাড়ে দোষ চাপায়। নানা সংঘাতের কারণ ও তার প্রতিকারে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথে না গিয়ে, ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠিত না করে পৃথিবীতে কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান হওয়া দুষ্কর।
ধর্ম মানুষের চরিত্র গঠনে যে পথ দেখিয়েছে, তা সূর্যের মতো দেদীপ্যমান। যদি ধর্মের এই গুণ না থাকত, পৃথিবী একেবারে এবং আরো রসাতলে চলে যেতই।