20/09/2025
লেখক তুষার কান্তি মাহাতোর "দ্য ম্যাজিশিয়ান" উপন্যাসটি পড়ে মতামত জানিয়েছেন পাঠক সৌরভ মাহান্তী মহাশয়। লেখকের কৃতজ্ঞতা ও পাঠকের মূল আলোচনার অংশটুকু নিচে দেওয়া রইলো। কমেন্ট বক্সে দেওয়া রইলো বইটির অনলাইন অর্ডার লিংক। মনোযোগী ও আগ্রহী পাঠকরা অবশ্যই একবার হাতে তুলে নিন বইটা।
***************************************
#দ্য_ম্যাজিশিয়ান' উপন্যাস পড়ে অসাধারণ #পাঠ_প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সৌরভ মাহান্তী Sourav Mahanty ভাই। একরাশ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই সৌরভকে। সত্যি কথা বলতে কি, এই উপন্যাসটি লেখার পর পরই বেশ ধন্ধে ছিলাম। সম্পূর্ন ভিন্ন, অনালোকিত ও নিষিদ্ধ এক জগৎকে নিয়ে লেখালেখি পাঠক ঠিক কী ভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়ে সংশয় ছিল বৈকি ! কিন্তু সব আশঙ্কার অবসান ঘটে যখন পাঠক বইটি সম্পর্কে তাঁদের মতামত জানান। শ্রম সার্থক। তাঁদের ভালোলাগায় উৎসাহ যোগায়, নতুন কিছু সৃষ্টিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে জাগে। আর ঠিক এই কারণেই ভীষণ কঠিন ইমারজেন্সি ডিউটির মাঝে লেখালেখি করার রসদটুকুটা আপনা থেকেই পেয়ে যাই। আপনারা পাশে আছেন বলেই সব সম্ভব হচ্ছে এটা নিশ্চিত।
যাই হোক, সৌরভ মাহান্তী ভাইয়ের লেখা রিভিউ নীচে দিলাম। পড়ে দেখতে পারেন।
---------------------------------------------------------------
দ্য ম্যাজিশিয়ান : হেরে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া নয়, পর্দা উঠবেই...
—- সৌরভ মাহান্তী
ম্যাজিশিয়ান। হাজাররকম ম্যাজিক যার হাতে। ছোটবেলা থেকে ম্যাজিসিয়ান মানেই আমাদের কাছে যারা অন্য গ্রহের এক মানুষ। মানুষ নয় যেন দেবতা। মুহূর্তে শূন্য ঝোলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে পায়রা, ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে হাতের পয়সা। আবার ফিরেও আসছে কোন কোন সময়। এই ম্যাজিশিয়ানদের জীবন ঠিক কেমন হয়? কীভাবে বাঁচেন তারা? তাদের জীবনটাও কি এরকম ম্যাজিকের মতোই? এই সমস্ত প্রশ্ন মাথার মধ্যে নানান সময় ঘুরতে থাকে। তুষার কান্তি মাহাতোর দ্য ম্যাজিশিয়ান উপন্যাস পড়লাম।
উপন্যাসটির বিষয়বস্তু খানিকটা এরকমই। ম্যাজিশিয়ানের জীবন। জীবন মানেই শিল্প। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র — দুই দম্পতি, আনন্দ এবং ছবি; অপরদিকে নবীন এবং রত্না।
লেখক দেখাতে চাননি, ঝাঁ চকচকে মঞ্চের আলোয় আলোকিত ম্যাজিশিয়ানকে। তাই তিনি পথ নিয়েছেন অন্য। নবীন আসলে হাতের জাদুকর। উপচে পড়া ভিড় বাসে কিংবা ট্রেনে অনায়াসে পকেট কাটতে পারে সে, এক কথায় পকেটমার। কিন্তু নাহ! পকেটমার বলে তাকে হেয় করা যাচ্ছে না মোটেই। নবীন, নবীন মাস্টার। জীবনে হতে চেয়েছিল অনেক কিছুই, কিন্তু শেষমেষ হতে পারল না তেমন কিছু তাই এই পথ। এই পথে প্রতিনিয়ত নানান বাধা, ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে সে প্রতিনিয়ত পকেট মারে এবং একটা দ্বিধা কাজ করে তার মধ্যে তার কাজ সম্পর্কে তার অতীত সম্পর্কে। জীবনটাকে ঠিকমত গুছিয়ে নেওয়া হলো না তার। লেখক চমৎকারভাবে তার জীবনটাকে বর্ণনা করেছেন। সে আদর্শ প্রেমিক হতে পারেনি, হতে পারিনি আদর্শ পকেটমার কিংবা আদর্শ মানুষ। আর তাই বিবাহিত মহিলা রত্নার সঙ্গে প্রেম করার পরেও সে টুম্পা বৌদির প্রেমে পড়ে। প্রেম নাকি শরীরী মায়াজাল — এ বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। পকেটমারি করে কারো গুরুত্বপূর্ণ সার্টিফিকেট পেলে সেই সার্টিফিকেট সে ফিরিয়ে দেয়। অপরদিকে মন খুলে কাঁদতে পারেনা সে। এই উপন্যাসের সবচাইতে নিখুঁত চরিত্র এই নবীন মাস্টার। কেন নিখুঁত বললাম তার পরিচয় অবশ্য পরে দেব। অন্যান্য চরিত্র গুলোর কথা বলা যাক।
আনন্দ। আনন্দ জাদুকর। জাদুকর বলতে যা বুঝি আমরা, আনন্দ ঠিক তাই। মেলার মাঠে জাদু দেখায় সে। জাদু দেখায় ট্রেনের কামরায়। তবে বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে ঠিকমতো খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না সে। এ পথে আরও অনেক নতুন নতুন জাদুকররা এসে যা চকচক মঞ্চ বানিয়ে আলো এবং শব্দের খেলাতে জাদুকে যেন হারিয়ে দেয়। তাদের কাছে জাদু নেই ভেলকি আছে, আর মানুষ সেই সবই দেখছে। আনন্দ এ জন্যই প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে প্রতিদিন। তবে নিজেকে হেরো বলে মেনে নিতে সে রাজি নয়। তার জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠলো চালচুলোহীন ছবিরানী। ছবিরানীকে ঠিক চালচুলাহীন বলা যেতে পারে না, কেননা তার বাপ রয়েছে। কিন্তু সে বাবা মাতাল। তাই এই পথ। পালিয়ে যাওয়ার পথ।
এই উপন্যাসটির অদ্ভুত এক বাস্তবতা হলো — উপন্যাসিক প্রতিটি পাতায় পাতায় জীবনের বাস্তবতা কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর তাই আনন্দ কিংবা ছবি দুজনের জীবনের তুমুল বাস্তবতা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। জীবন সংগ্রামে কেউ হেরে যেতে রাজি নয়। নিজের সঙ্গে ‘হেরো’ ট্যাগ লাগাতে রাজি নয় কেউ। তাই দাঁতে দাঁত টিপে লড়ে যাওয়া। আনন্দ লড়তে চায়। কিন্তু শেষমেষ জীবন তাকে হারিয়ে দেয়।
উপন্যাসটি পাশাপাশি দুটি চরিত্রকে সামনে রেখে এগিয়েছে — নবীন এবং আনন্দ। একজন পকেটমার এবং একজন জাদুকর। আসলে দুজনেই ম্যাজিশিয়ান। দুজনের মধ্যেই রয়েছে চরম মেধা। হাতের খেলা জানে দুজনেই। এরা দুজন বন্ধু। জীবন তাদের আলাদা করে দিয়েছে। নবীনের ঘর বাঁধা হয়নি, আনন্দের হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হেরে গেছে তারা। আনন্দ অনেক দূরে চলে গেছে। নবীনকে একলা করে। নবীন ফিনিক্স পাখির মত তার জাদু দেখানোর প্রয়াস জারি রেখেছে।
অদেখাকে দেখা অচেনাকে চেনার আনন্দ অনেকখানি। যা পাইনি তা পাওয়ার আনন্দ অনেক খানি। যে আলো সবাই দেখে, তার অন্তরের অন্ধকারকে সবাই দেখেনা। উপন্যাসিক চেষ্টা করেছেন সেই অন্ধকারকে সামনে আনতে। তাই তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের কথা এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের যে সমস্ত গৌণ চরিত্র রয়েছে, তারা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ। নবীনকে কেন্দ্র করে ঘিরে থাকা তার সাঙ্গোপাঙ্গ, কিংবা ভিখারি স্বপ্নাসুন্দরী, গনেশ কাকা, গবেষক চিত্তপাল, টুম্পা বৌদি, মলয় হাজরা — এরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র নায়ক। কেন স্বতন্ত্র বললাম? একটি উদাহরণ দিই।
গবেষক চিত্ত পাল পকেটমারদের নিয়ে গবেষণা করতে চায় আর সেই সূত্রেই তার পরিচয় নবীন মাস্টারের সঙ্গে। নবীন মাস্টার বিদেশি মালের পরিবর্তে পকেটমারি শিল্পের আপাদমস্তক জানায় তাকে। গবেষকের সঙ্গে তার বাড়ি যায় নবীন মাস্টার। গবেষকের এলাকাকে হাওর বলা হয়। এই হাওরে এসে নবীন যেন নিজেকে খুঁজে পায়। এখানকার পরিবেশ তাকে উতলা করে তোলে। একজন পকেট মারকে হিজল ছায়া বড় অদ্ভুতভাবে একলা এবং নিঃসঙ্গ করে তোলে। হিজল ছায়ায় তার অতীতকে খুঁজে পায় মনে করে সবকিছু ছেড়েছুড়ে একলা কাঁদে। এইখানেই গনেশ কাকা চরিত্রের আবির্ভাব। গণেশ কাকা একজন সন্তান হারা পিতা। সন্তান হারার শোক তার বুকে, এই শোক নিয়ে কাঁদতে থাকে সে। নবীনের ইচ্ছে হয় গণেশ কাকার মত প্রাণ খুলেছে সে যেন কাঁদতে পারে। আর এই গণেশ কাকার শোককে সে যেন বুকের মধ্যে সঙ্গী করে আজীবন ভেসে বেড়ায়।
লেখক বেশ কিছু চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন উপন্যাসে। ম্যাজিক রিয়েলিজম ও সুরাইয়ালিজম এর নানান উপাদান এই উপন্যাসে লুকিয়ে রয়েছে। বউ কথা কও পাখির সঙ্গে নবীন মাস্টারের একাকীত্ব এবং যন্ত্রণাকে তিনি মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন।
দ্য ম্যাজিসিয়ান আসলে একটি ক্লাসিক ধর্মী রচনা। যেখানে উপন্যাসিক জীবন সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন। যে ছয়টি উপাদান নিয়ে উপন্যাস গড়ে ওঠে, সেই ছয়টি উপাদানের মধ্যে অন্যতম প্লট এবং লেখকের মনস্তত্ত্ব। প্লট নির্মাণের চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছেন লেখক, কিন্তু পাঠক হিসেবে একটি বিষয়ে আমার চোখে লেগেছে তা হল লেখক কাহিনীকে ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন এমন একটি রীতি, যেখানে তিনি আগেকার ঘটনার টুকরো টুকরো অংশ পুনরায় ব্যবহার করেছেন। এই রীতিটি অবশ্য অমনোযোগী পাঠকের জন্য উপকারী কিন্তু কেউ কেউ বিরক্ত হতে পারেন। উপন্যাসের মধ্যে লেখক এর মনস্তত্ত্ব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। একটি চরিত্র নির্মাণে তিনি অদ্ভুত দক্ষতা দেখিয়েছেন। উপন্যাসটি আসলে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নানান অদেখাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় নবীন মাস্টার আসলে আমাদেরই চারপাশে ঘুরে ফেরা হেরে যাওয়া মানুষের প্রতিনিধি। এই মানুষগুলো আমাদের পৃথিবীতে রয়েছে, আমাদের সমাজে রয়েছে। প্রতিযোগিতায় হারিয়ে গিয়েও হারিয়ে যায়নি তাঁরা। তাই নবীনকে সকলে ছেড়ে গেলেও সে নিজের রাস্তা ছাড়েনি সে আমাদের শিখিয়েছে — জীবন সংগ্রাম। আর তাই দ্য ম্যাজিশিয়ান আসলে জীবন সংগ্রামের উপন্যাস। লেখক কে অনেক শুভেচ্ছা রইল অপেক্ষা থাকলো পরবর্তী উপন্যাসের…
_________________________________________________
◆বই : দ্য ম্যাজিশিয়ান ( উপন্যাস)
◆লেখক : তুষারকান্তি মাহাতো
◆জ্যঁর : সামাজিক- ক্ল্যাসিকধর্মী
◆প্রকাশক : বিভা পাবলিকেশন
◆মুদ্রিত মূল্য : ২৫৫/-