01/07/2025
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'নৈশ অপেরা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন পায়েল দত্ত। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।......................................................
নৈশ অপেরা || শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
সুপ্রকাশ, ৫৪০ টাকা
“মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়;
অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে...”
- জীবনানন্দ দাশ
'শেষ মৃত পাখি'-র অসামান্য অভিঘাতে বিহ্বল পাঠক হৃদয় প্রায় তিন বছর অপেক্ষায় ছিল এমনই কোনো বৃহৎ রহস্যপোন্যাসের, যেখানে ফিরে আসবে ব্যস্ত শহর থেকে দূরে অবস্থিত ছোট একটি জনপদ ও তার দীর্ণ বাসিন্দাদের বিষাদ পরম্পরার আখ্যান আর সেই বিষাদের মধ্যে এসে পড়বে তনয়া – জার্নালিস্ট তনয়া, যে নিজের বিবিধ বিষণ্ণতার সঙ্গে ক্রমাগত লড়াইয়ে প্রায় বিপর্যস্ত থেকেও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সত্যানুসন্ধানের অমোঘ টানে জড়িয়ে পড়ে সেই পরম্পরার ভেতরে এবং অনিবার্য মানবিক সংবেদের ফলে আরও গভীর বিষণ্ণতার মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকে। অপরাধ এখানে নিমিত্ত, যদিও একমাত্র নিমিত্ত নয়।
অতঃপর বেলা পড়ে আসা নির্জন বর্ষণশ্রান্ত আষাঢ়ের দিনে, না দেখা এবং নাম না জানা এক পাখির তীব্র ও তীক্ষ্ণ চিৎকার সহযোগে উড়ে যাওয়ার মাঝে – চিৎকারের গতিপথে যে উড়ান অনুভব করা গেল মাত্র – শুরু করা এই বিষাদ আখ্যান ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে থাকল এক অখ্যাত গঞ্জের বিষণ্ণ বৃষ্টি ও কুয়াশা মাখা কয়েকটি নিঝুম দিন রাত ও অমীমাংসিত, অ্যাবসার্ড অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিছু রহস্যের মধ্যে – যার সমাধান না হওয়াই হয়ত ভালো ছিল।
উপন্যাসের কাহিনী সেই অর্থে খুব অভিনব নয়। নব্বইয়ের সময়কালে আপাত অখ্যাত এক গঞ্জে বসবাসকারী একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে ভরা দুপুর বেলা সবার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যায় একটি শিশু – যে আর ফিরে আসেনি কোনোদিন। তবুও সে বারবার ফিরে এসেছে, দেখা দিয়েছে পরিবারটির বাসিন্দাদের। কখনও একা, কখনো সকলকে একসাথে। কখনও বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন মানুষকেও। এই ঘটনার ছ' বছর আগে গঞ্জ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল আরও একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে। সেও আর ফিরে আসেনি কোনোদিন, তবুও বারবার ফিরে এসেছে, বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা দিয়েছে গোটা কমিউনিটির প্রায় সমস্ত মানুষকে। পাঠককে বিশ্বাস করতে হবে এই কাহিনীতে এতটুকু অলৌকিকতা নেই। তাহলে কীভাবে ? বলা ভালো, কেন ? এই অনুসন্ধানই আসলে উপন্যাসের নির্যাস।
অনুসন্ধানের চরিত্রটুকু হৃদয়ঙ্গম করার সুবিধার্থে উপন্যাস থেকে কয়েক লাইন তুলে দেওয়া যাক।
|| “ক্রিস কেন হারিয়ে গেল, এটাই আসল।... আমরা মাথার চুল ছিঁড়ি অপরাধ কীভাবে ঘটল আর কীভাবে অপরাধীকে ধরা হবে সেই নিয়ে। কিন্তু কেন একটা অপরাধ ঘটল, তার ফলশ্রুতি কী হতে পারে, একটা খুন করার পরে মানুষ একইরকম থাকে কি না, সেগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ... আমি মানুষের ক্ষয় নিয়ে ইন্টারেস্টেড। কেন একজন মানুষ নৈরাশ্যের মধ্যে ক্ষয়ে যেতে যেতেও নিজেকে গ্রেস পাবার সান্ত্বনায় ভোলায়। যদি ভোলায়-বা, সে তার পরে একটা অপরাধ কীভাবে করতে পারে ? কীভাবে অপরাধী তৈরি হয় ?...”||
এই আপাত সাধারণ ঘটনা পরম্পরা ও তার ইতিহাস অনুসন্ধানের পেছনে লুকিয়ে থাকে বংশানুক্রমিক পাপ ও তার ইডিপাসীয় বিবর্তনের করুণ আলেখ্য। রহস্য উদঘাটনের পর্যায়ে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় বহুস্তরীয় ঘটনাবলীর বিবিধ লুকানো অবয়ব। পাপ কখনোই একমাত্রিক নয় and the characters can never be fully black or white. গল্পের চরিত্রগুলোও, অতএব, বহুবর্ণীয় কারুকার্যে বিন্যস্ত। পড়তে পড়তে প্রত্যেকটি চরিত্রের সঙ্গে – তাদের বিবিধ মানবিক ও চারিত্রিক দোষ গুণ উন্মত্ততা নির্বিশেষে – অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হতে থাকে। অপরাধী চোখের সামনেই আছে, এই সত্য সিদ্ধান্তে স্থির থেকেও পাঠক মন যেন তা থেকে দৃষ্টি দূরেই রাখতে চায়। অথচ অনুসন্ধিৎসা – মানব চরিত্রের যা অবশ্যম্ভাবী বৈশিষ্ট্য – বারেবারে বিপথগামী দৃষ্টিকে মূলস্রোতে সঞ্চরমান রাখার প্রয়াস করে।
কাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী দিক তার সার্থক আবহ সৃষ্টি। একটি চরিত্র তাই গল্প বলার ফাঁকে বলে – ‘ডিটেকটিভ গল্প শুনবেন এদিকে আবহ তৈরি হবে না, এ হয় নাকি ?’ সমস্ত কাহিনী জুড়ে ঘন কুয়াশা ও ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির অনুষঙ্গ এক চাপা বিষাদ ও লুকিয়ে রাখা প্রাচীন পাপের অভিঘাতকে পাঠকের দৃষ্টি সমীপে উপস্থাপন করে। লেখকের অসম্ভব স্মার্ট গদ্য ও কাহিনীর ততোধিক বুদ্ধিদীপ্ত চলন পাঠককে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করায় যে 'শেষ মৃত পাখি' শুধুই কোনো একদিবসীয় সাময়িক ফর্মের সম্ভাবনা নয়, পরন্তু স্থায়ী ও দীর্ঘ ক্লাসের উত্তরাধিকার নিয়েই শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের জঁর ফিকশনের আঙিনায় ব্যাট করতে নেমেছেন।
পাঠকালে 'পুরুষ' (উত্তম পুরুষ - মধ্যম পুরুষ - প্রথম পুরুষ) ও কাল (অতীত - বর্তমান, অতীতের ভেতর অতীত অথবা বর্তমানের ভেতর বর্তমান) -এর ক্রমাগত সঞ্চরণ, প্রতি অনুচ্ছেদ এমনকি প্রতি বাক্যে অবাধ অনায়াস ক্রমাগত যাতায়াত পাঠকের অখন্ড মনোযোগ দাবি করে। মুহূর্তের জন্য মনোযোগ ছিন্ন হলে গল্পের স্থান কাল পাত্রের খেই হারিয়ে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা। বস্তুত এ যেন সময়ের অভ্যন্তরে ধরে রাখা আরও এক প্রাচীন সময়ের বিষাদগাথা, এক চরিত্রের অভ্যন্তরে অন্য কোনো চরিত্রের ছায়া, হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার মধ্যে অনপনেয় দূরত্ব এবং নৈকট্যের খোয়াব বন্দিশ।
রহস্য ও তার অনুসন্ধানের দিকটি ছাড়াও যে দিকটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে তা হল গঞ্জ – যা আমাদের অত্যন্ত চেনা একটি অঞ্চল, ঝাড়খন্ডের সুপরিচিত একটি পাহাড়-মালভূমি সম্বলিত ভূখন্ড এবং পর্যটকদের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গন্তব্য, ফলতঃ নাম না নিলেও যাকে সহজেই চিনে নেওয়া যায় – অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটির আবাস হিসেবে তার ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক বিবরণ, যদিও তা পরিমিত ও কাহিনীর রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী সীমিত। এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটির সঙ্গে স্থানীয় ও মূলনিবাসী জনজাতির আর্থ সামাজিক সম্পর্কটি অত্যন্ত যথাযথ ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে উপন্যাসে। অবিনাশ যাদব বা অ্যালফ্রেড হেমব্রমদের শোষিত হওয়ার যে চিরকালীন লিগ্যাসি সেটিও বোঝা যায় উক্ত চরিত্রগুলির নিজস্ব জবানবন্দীতে এবং তা আরও গভীরভাবে বোঝা যায় মুন্না, সমর দোসাদ অথবা নির্মলার করুণ পরিণতিতে। আর কে না জানে, শোষণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বয়ে আনে এবং এই অস্থিরতার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে জনপদটির সার্বিক স্থানীয় বৈশিষ্ট্য। বিক্রি হয়ে যাওয়া একের পর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কটেজ, গুটিকয় প্রাচীন অ্যাংলো মানুষ যাদের শরীরে নীল রক্তের উপস্থিতি অথচ আক্ষরিক অর্থেই তাদের কোথাও যাওয়ার নেই, প্রাচীন এই জনপদে বিষাদ কূপের মধ্যে পচে মরাই হয়তো তাদের নিয়তি। এই নিয়তি তাদের স্বহস্ত নির্মিত, কারণ এই নিয়তি তাদের প্রাচীন পাপেরই ফলাফল।
গোটা কাহিনীতে আবহ সঙ্গীতের মতো অজস্র ফিসফিসানি জুড়ে তৈরি হয়েছে এক অলীক নৈঃশব্দ্য, শেষে গিয়ে যা এক অনুচ্চার বিস্ফোরণ ঘটায়। পাঠক – যথারীতি – স্তব্ধ হয়, কাঁদে, বিলাপ করে, ভাবে 'কেন সব জানা হলো, না জানা থাকাই ছিল ভালো!' ফিরে আসা প্রাচীন পাপ অথবা রহস্যের উন্মোচন সহ্য করা সহজ হয় না মোটেও। তবু গল্প জুড়ে এক আশ্চর্য ভালোবাসা টপিংয়ের মতো ছড়িয়ে থাকে। একটা গঞ্জ, তার স্মৃতি, তার ঘনিয়ে আসা জঙ্গল, তার ভেতর গুটিকয় মানুষের পাগলামো আর নৃশংসতা অভিশাপের মতো, নাছোড় স্মৃতির মতো, শোকের গ্রন্থিগুলোর খুলতে না পারা গিঁটের মতো, অনপনেয় বেদনার মতো জড়িয়ে রাখে পাঠককে।
উপন্যাস শেষ হলে বই বন্ধ করে চোখ বুজে কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসে থাকে মূঢ় পাঠক। ঘোর কাটতে সময় লাগবে তার।
অতঃপর শুরু হবে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গোনা ফের। তনয়ার জন্য, তার সঙ্গে অন্য কোনো বিষাদক্লিন্ন উন্মোচনের জন্য হৃদয়ভার নিয়েও অপেক্ষা করবে সে।