Suprokash

Suprokash বাংলা সাহিত্যের প্রকাশনা। সুপ্রকাশ আগামীতে হয়ে উঠতে চায় সার্বিক সাংস্কৃতিক উদ্যোগ।

বাংলা সাহিত্যের প্রকাশনা। আলোকবৃত্তের বিপ্রতীপে থাকা মানুষের আখ্যান, ধ্রুপদী কথাসাহিত্য, চিন্তাপ্রধান গদ্য এবং স্মৃতি জুড়ে থাকা মানুষের ইতিহাসের কথা বলাই সুপ্রকাশের স্বনির্বাচিত দায়।

ভারতীয় সেনা ঢোকে ঢাকা শহরে!সুতো ছাড়ার সময় যাঁরা ছিলেন, সুতো গোটানোর সময় তাঁদেরই ব্যস্ত দেখা যায়। শরণার্থী শিবিরগুলো ভেঙে...
05/11/2025

ভারতীয় সেনা ঢোকে ঢাকা শহরে!

সুতো ছাড়ার সময় যাঁরা ছিলেন, সুতো গোটানোর সময় তাঁদেরই ব্যস্ত দেখা যায়। শরণার্থী শিবিরগুলো ভেঙে ফেলা হয়, স্কুলগুলো খালি হতে থাকে। মানুষজন ফিরে যেতে থাকেন তাঁদের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাসভূমিতে— পোড়া ভিটে, ভাঙা গ্রাম আর চালের ওপর একদা যত্নে তুলে দেওয়া লাউ-চালকুমড়ো লতার সবুজে, ঘরের পাশের গাঁদা গাছটির সান্নিধ্যে।

শিবেশ্বরদার কবিবন্ধুও ফিরে যান দেশে, স্বাধীন দেশে—তাঁকে আবার কবিতার কাগজটা বার করতে হবে। আতিথ্যের জন্য ধন্যবাদ আর তাঁর কাগজে লেখার জন্য সকলকে দরাজ আমন্ত্রণ জানিয়ে যান তিনি— এমন-কী এই আমন্ত্রণ থেকে কবি চঞ্চলও বাদ যায় না।

ফলত দাদার সঙ্গে আমীরাও ফিরে যায়।

এই শহর, তার পুরোনো পুরোনো বাড়ি, সোঁদা-গন্ধের শতাব্দী-প্রাচীন স্কুলবাড়িগুলি তেমনই রয়ে যায়। থেকে যায়— এক-একটি অঞ্চলে জড়াজড়ি করে এক এক সম্প্রদায়ের বিভাজিত বাসভূমি।

যেদিন আমীরারা চলে যায়, তার পরদিন গিয়ে মেজর দেবেশ্বরকে বাড়িতে পাই না আমরা।
তাকে আবিষ্কার করি বেজনা বিলের ধারে।

দেবেশ্বরের রোগাটে মুখে, সর্বাঙ্গে স্বপ্নঘোরের মতো বিষাদের আল্পনা। সহসা মনে হয়— একটা কুসুম-কুসুম গন্ধ, শব্দহীন কবোষ্ণ এক ছায়া, মোমের মতো মসৃণ দর্শনাতীত-স্পর্শাতীত এক অনুভূতি— এসবের গভীরে এক অপ্রতিরোধ্য বেদনা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বিম্বিত বিলের জলে।

শহরে মিছিল বেরোয়।
অর্থাৎ শহর স্বাভাবিক হয়ে আসে।

স্কুল-কলেজ খুলে যায়। বাজারে আবার থলি হাতে অভিভাবকদের গল্প করতে, দরদাম নিয়ে অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

এত বড়ো একটা রাষ্ট্রীয় ক্রান্তিকালে যে-যার কাজে ব্যস্ত থাকায় এই সাত-প্যাঁচালো শহরে কানাকানি হওয়ার অবকাশ থাকে না। সিনেমা হলগুলি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে, ব্ল্যাকারদের ব্যবসায় সামান্য মন্দা দেখা যায়, দেবানন্দ জ্যাকেট গায়ে সামান্য ঘাড় কাত করে দেওয়ালে দেওয়ালে তাকিয়েই থাকেন।

লিডার, মেজর দেবেশ্বরের বুক খোলা জামার ভেতরে স্তব্ধ হয়ে থাকা অভাবিতপূর্ব বেদনার খোঁজ রাখার সময় থাকে না কারও। কিন্তু আমরা? মাণিক্য বলে—'দেবেশ্বরটা যেমনই হোক, আমাদের রিপাবলিকেরই তো পাবলিক!'

মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহের স্তূপ পেরিয়ে, জাহির রায়হানের ঠিকানার চিরকূট উড়িয়ে আলো জ্বলে ঢাকা শহরে। কবিতায় ভরে ওঠা চঞ্চলের খাতাটি আচ্ছন্নতা আর গাঢ় অবসাদে ভারি হয়ে ওঠে।
আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা

সুপ্রকাশ

গত বছরের মতো এবারও অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম থেকেই বাঘের উপদ্রব শুরু হয়। সাতখানা গ্রামের লোক ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। জাফরনগরের...
05/11/2025

গত বছরের মতো এবারও অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম থেকেই বাঘের উপদ্রব শুরু হয়। সাতখানা গ্রামের লোক ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। জাফরনগরের বীর আসরে নেমেছেন।
আজ হিজুলী, কাল হালালপুর, তার পরের দিন জাফরনগর, প্রত্যহই গো হত্যার সংবাদ আসতে থাকে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বীরের অভিযান হয় শুরু। প্রত্যহই খোরাকের জন্য চাই একটা আস্ত গরু আর তাছাড়া জলযোগের জন্য দেশী কুকুর, ছাগল ও ভেড়া প্রায়ই প্রয়োজন হয়।
স্থানীয় শিকারী মহলে সাড়া জাগে। কেউ জানোয়ার চলা পথের উপর মাচা বাঁধলেন, কেউ মরী'র উপর বসে রাত কাটালেন, কেউবা লোক দিয়ে জঙ্গল ঘিরিয়ে বন পেটালেন; কিন্তু সবই বিফল হল। জাফরনগরের বীর যে বিভীষণের পরমায়ু নিয়ে এসেছে, ওকে মারে কে?
সংবাদটা মহাকুমা হতে সদরে গেল এবং সেখান থেকে গেল কলকাতা শহর পর্য্যন্ত।
এবার কলকাতা হতে মোটর বোঝাই হয়ে শিকারীর আমদানী হতে লাগলো; কিন্তু ফল কিছু হল না। টিফিন কেরিয়ার খালি করে ক্লান্ত দেহে ফিরে যেতে লাগলো।
সংবাদ পেয়ে আমেরিকান সৈনিকের দল এসে তাঁবু গাড়লেন জাফরনগরের বনের কিনারে। উজ্জ্বল তাদের স্বাস্থ্য, লোভনীয় তাদের পরিচ্ছদ, আর সকলের হাতেই একটা করে দামী মানুষ মারা রাইফেল।
গ্রামে গ্রামে সাড়া জাগে। এবার বাঘ মরবে নিশ্চয়ই। আমেরিকান কায়দায় শিকার আরম্ভ হ'ল। জাফরনগরের বীরের উপর একটা গুলিও পড়ল; কিন্তু ফল সেই পূর্ব্বের মতই রয়ে গেল।
তাঁবু উঠলো; কিন্তু গোহত্যা থামলো না। চৈত্র মাসের মধ্যে-ই বীর 'সেঞ্চুরী আপ' করলে।
অবশেষে :
২৪শে জ্যৈষ্ঠ। সকাল থেকেই অকাল বাদল নেমেছে। বিকেল বেলা তরুণ শিকারী শঙ্করনাথ কেবল চায়ের পেয়ালাটী শেষ করেছে এমন সময় বন্ধু অপূর্ব্বকুমারের চাপরাশী এসে সংবাদ দিল, জাফরনগরে গত রাতে এক বৃহৎ গরু মেরেছে, ডাক্তারবাবু (অপূর্ব্বকুমার) আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন, এখুনি যেতে হবে।
শঙ্করনাথ মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে মনটাকে শান্ত করবার চেষ্টা করলে; কিন্তু গাজনের সন্ন্যাসী চড়কের বাজনা শুনলে নাকি আর স্থির থাকতে পারে না—তাই তাকে সেই দুর্যোগের মধ্যে দিয়েই যাত্রা করতে হল।
ওরা যখন জাফরনগরে এসে পৌছাল তখন মেঘলা দিনের সন্ধ্যা নামতে আর বেশী দেরী ছিল না।
গত রাতে যার গরু নিহত হয়েছিল সেই পথ দেখিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌছে দিয়ে গেল। নিবিড় জঙ্গলের মাঝে মৃত গরুটা পড়ে আছে। পাশেই নরম কাদার উপর পড়ে রয়েছে জাফরনগরের বীরের পদচিহ্ন।
অপূর্ব্বকুমার শঙ্করনাথকে সেই পদচিহ্ন দেখিয়ে বল্লে,—ধোঁয়া দেখে আগুনের গুরুত্বটা বোঝ।
শঙ্করনাথ মোটা গলায় শুধু একটা হুঁ দিল।
আকাশ থেকে আবার এক পশলা বৃষ্টি নামলো। এবার ওদের মুস্কিলে পড়তে হল। কাছাকাছি বসবার মত একটাও গাছ নেই। আর এখন এত দেরী হয়ে গেছে যে গ্রামের থেকে লোকও উপকরণ নিয়ে এসে মাচা বাঁধার সময় পাবে না। এদিকে বনের বুকে সন্ধ্যার ছোঁয়া লেগেছে।
অন্য কোন উপায় না পেয়ে ওরা মৃত গরুটার কাছ হতে হাত কুড়ি দূরে একটা বন তুলসীর ঝোপের মধ্যে ঢুকে বসে পড়লো।
অন্ধকারে ডুবে গেল সারা বনানী। পাশাপাশি স্থিরাসনে বসে দুই বন্ধু বাঘের ধ্যানে মগ্ন হ'ল। এদিকে জাফরনগরের বনের বনিয়াদি মশককুল ওদের ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ করলে—তাদের রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ তারা কিছুতেই সহ্য করতে রাজী নয়। এর উপর প্রকৃতির অত্যাচার শুরু হল। শরৎকালের মত এক একখানা মেঘ ভেসে আসে, আর ওদের সঙ্গে একটু রসিকতা করে যায়।
বীর সাধকদ্বয়কে মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়। হাত পা ও মুখের অনাবৃত অংশে মশক স্পর্শে যে জ্বালা ধরে, বিরহের জ্বালার চেয়ে সে জ্বালা কিছু কম নয়।
রাত মনে হয় তখন আটটা হবে, খস্ খস্ করে একটা শব্দ এলো আর সেই শব্দটা মৃত গরুটার কাছ পর্য্যন্ত এসে থেমে গেল। দুই বন্ধুর স্নায়বিক কেন্দ্রে জেগে উঠল চেতনা।
অপূর্ব্বকুমার বন্দুক তুলে ধরে টর্চের বোতাম টিপলে। অন্ধকারের কালো পর্দা ভেদ করে ছুটলো আলোর তীর। আর সেই আলোতে বন্ধুদ্বয় দেখতে পেলো, মৃত গরুটার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বৃহৎ শেয়াল।
চোখে আলোর ধাঁধা কাটতেই শেয়ালটা খ্যাক খ্যাক শব্দ করে ছুটলো বনের মধ্যে, আর শঙ্করনাথ মোটা গলায় উচ্চারণ করলো—'হোপলেস'।
আলো নিভে গেল। আবার সুরু হল সাধনা। রাত প্রায় তখন ৯টা হবে সেই সময় ওদের কানে ভেসে এলো আবার জানোয়ারের পদশব্দ।
অপূর্ব্বকুমার ফিস ফিস করে বললে— শালার শেয়ালটা জ্বালালে। শঙ্করনাথ অপূর্ব্বকুমারের গায়ে একটা চাপ দিয়ে আলো জ্বালাবার সঙ্কেত করে। নিতান্ত অনিচ্ছা ভরে অপূর্ব্বকুমার টর্চ এর বোতাম টিপলে। সাদা আলোর মধ্যে দিয়ে সে দেখতে পেলো মাত্র কুড়ি হাত দূরে মৃত গরুটার উপর দীপ্ত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে জাফরনগরের বীর। অপূর্ব্বকুমারের সারা দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
সময়ের সমুদ্র হ'তে মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড ঝরে পড়ে! শঙ্করনাথের বন্দুকের দক্ষিণ নল হতে অগ্নি বর্ষণ হল— নিস্তব্ধ বনানীর মাঝখানে জেগে ওঠে বেমানান শব্দ।
অপূর্ব্বকুমারের হাতের আলো নিভে গেল। উত্তেজনায় ওদের স্নায়ুমণ্ডলীতে আক্ষেপ জেগেছে— তাই ওদের নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত তালে। গভীর অন্ধকারের মাঝে, বুকে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে বসে আছে দু'জনে, কারও মুখ দিয়ে কথা সরে না।
জাফরনগরের শের
মিহিরলাল চট্টোপাধ্যায়...................................
বাঙালির শিকার স্মৃতি
সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা

সুপ্রকাশ

 #নির্মুখোশ_নতুন_ধারাবাহিক #প্রতি_রোববার_নির্মুখোশ_ডট_ইন_এএকদিকে নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০), অন্যদিকে সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭)...
04/11/2025

#নির্মুখোশ_নতুন_ধারাবাহিক
#প্রতি_রোববার_নির্মুখোশ_ডট_ইন_এ

একদিকে নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০), অন্যদিকে সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), এই দুইয়ের প্রাক্কালে কোলস্ওয়ার্দি গ্রান্ট (১৮১৩-১৮৮০) বাংলার নদীয়া, ২৪ পরগনা অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। মূলত নীলকর সাহেবদের অতিথি হয়ে। শিল্পী হিসেবে তখন তিনি বহুখ্যাত। বড়লাটের স্নেহধন্য। এই বাংলায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লন্ডনে তাঁর বোনেদের চিঠি লেখেন। ১৮৬০ সালে এইসব চিঠি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নাম, ‘রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল’। পাতায় পাতায় অসামান্য সব স্কেচ। তৎকালীন বাংলার গ্রামজীবন রেখায়-লেখায় জীবন্ত হয়ে বইয়ের পাতায় উঠে এল। অনূদিত হচ্ছে সেই গ্রন্থ। অনুবাদ করছেন অর্ণব রায়।

প্রথম পর্ব সম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক : https://nirmukhosh.in/bengal-1/

গঞ্জ ও মফস্বলের যে-কাল, যে-দশক, ও শতাব্দী অধুনালুপ্ত তারই বিবিধ সংকেত ও চিহ্নবাহী উপাদান নিয়ে, এই গ্রন্থের আখ্যানগুলি সে...
04/11/2025

গঞ্জ ও মফস্বলের যে-কাল, যে-দশক, ও শতাব্দী অধুনালুপ্ত তারই বিবিধ সংকেত ও চিহ্নবাহী উপাদান নিয়ে, এই গ্রন্থের আখ্যানগুলি সেই সময়, পাল্টে যাওয়া সমকাল ও নাগরিক জীবনের টানাপোড়েনের ভাষ্য। গঞ্জ ও নগরজীবনের বৈচিত্র্য, সংকট, স্থানিক ও কালিক বিবর্তন লিখতে সচেষ্ট এই গ্রন্থের বহুবিধ এগারোটি আখ্যান।

এই আখ্যানগুলি কাঁসাইয়ের মাটির বাঁধ ধরে পাথরআড়া অভিমুখে হেঁটে যাওয়া নিমাই পাত্র ও বলরাম বাস্কের বিচিত্র আন্তঃসম্পর্কের, রাধু খাঁড়ার বুড়াশোল থেকে কলকাতাব্যাপী দ্বন্দ্ব-দোলাচলের, রিষড়ার ব্যর্থ স্ট্রাইকারের আপ্রাণ ঘুরে দাঁড়ানোর, পুরোনো জেলাশহরে ফিরে অচেনা ফ্লাইওভার আবিষ্কারের।
টুক্কা
কৌশিক ঘোষ

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

সত্যদার কথা বলেছি। সত্যদা—মানে, সত্য মজুমদার। পেশায় প্রযুক্তিবিদ, নেশায় বেহালাবাদক। বেহালা ছিল তাঁর আনন্দ, তাঁর আবেগ। সু...
04/11/2025

সত্যদার কথা বলেছি। সত্যদা—মানে, সত্য মজুমদার। পেশায় প্রযুক্তিবিদ, নেশায় বেহালাবাদক। বেহালা ছিল তাঁর আনন্দ, তাঁর আবেগ। সুরের সাধনায় তিনি নির্জন হয়ে যেতেন নিজের ভেতর। বোধ হয় তাঁর কখনো মন খারাপ করত না। কখনো মন এপাশ-ওপাশ করলেই বেহালায় ছড় টেনে সুরের নদীতে সাঁতার কাটতেন। ডুবসাঁতার। স্নাত হলে কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টির আঁচল ছড়িয়ে দিতেন নীলিমে। তারপর মৃদু হেসে বলতেন, বলো।

বলার কিছু থাকে কি? শুধু তাঁর সঙ্গে স্নাত হওয়া ছাড়া। সুরের এই ঝরনাতলায় স্নান ছাড়া আর কী-ই-বা হতে পারে! সুরের মতোই তাঁর গভীর দু-চোখে ছিল আলোকবর্ণ। মাঝে মাঝে মনে হত, সারাদিন লোহালক্কড়ের সঙ্গে সহবাস করেও একটা সুরেলা মন কীভাবে পুষে রাখা যায় হৃদয় কোটরে! পরে বুঝেছি, সুর ও সংগীত পারে মানুষকে এভাবে গড়ে তুলতে।
কোন ছোট্টবেলা থেকে দেখেছি তাঁকে। যখন আমরা পুব-পাকিস্তানের দর্শনায় ছিলাম, বাবা দর্শনার কেন অ্যান্ড কোম্পানির চিনির কলে ছিলেন, সেখানেও ছিলেন তিনি। যখন আমরা চলে এলাম এপারের পলাশিতে, তিনিও এলেন। রামনগর কেরু অ্যান্ড সুগার কোম্পানি। সত্তর দশক পর্যন্ত রমরম করে চলত। পলাশির চিনি বিদেশে রপ্তানি হত। বাংলার বাজারে আসত। সত্তরের দশকেই মূলত শ্রমিক অসন্তোষ, একইসঙ্গে আখচাষিদের উৎপাদনে অনীহা, এই কারখানাকে দুর্বল করে দিল। এখন কারখানা নেই হয়ে গেছে। কত মানুষ কাজ করতেন সেখানে! কত দপ্তর! কত আবাসন! সবমিলিয়ে যেন একটা উপনগরী। কোম্পানির নিজস্ব হাসপাতাল, সমবায়িকা। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে একটি বিদ্যালয়। এই উপনগরীর গায়ে গা লাগিয়ে দুটো গ্রাম-- তেজনগর আর পলাশি। চিনি কারখানার এই উপনগরীকে বলা হল মিল নগরী বা মিল কলোনি।

পলাশিতে এসেও সংগীত সাধনা অব্যাহত ছিল সত্যদার। এই মিল কলোনির পরিধির মধ্যেই ছিল একটা বড়ো পুকুর। লোকে বলত কালীন্দ, তার পাড়ে ইংরেজ বিজয়ের স্মারক, আর সরকারি ডাকবাংলো। এই পুকুরের দু-প্রান্তে দুটি ঝুরিনামা শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছ। একটা মনুমেন্টের পাশে, অন্যটা মিল কোয়ার্টারের গায়ে। দুটো বটগাছই ছিল বালক-বালিকাদের খেলার জায়গা। বটের ঝুরি ধরে দোল খাওয়া। দোল খেতে খেতে কতবার যে ঝুরি ছিঁড়ে ধপাস, তার ইয়ত্তা নেই। তা, সেই বটতলায় ছিল কালীর স্থান। সেখানে ঘটা করে কালীপূজা হত। আর, কালীপুজো উপলক্ষে হত বিচিত্রানুষ্ঠান, নাটক। দু-দিন ধরে চলত। সেই নাটকের নেপথ্যে শোনা যেত তাঁর বেহালা। আবার মিল আবাসনের অন্য একটাদিকে এক অশ্বত্থ গাছের নীচে যখন অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন হত, সেখানেও বালকদের তালিম দিয়ে গান গাওয়াতেন। এভাবেই তিনি শুধু মিল কলোনি নয়, আশেপাশের গ্রামের‍ও শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন। সেই একই ধারা বজায় ছিল বীরভূমের আমোদপুরে এসেও। আমৃত্যু। সুরের সঙ্গে বসবাস আর অমায়িক ব্যবহার তাঁকে সম্মাননীয় করে তুলেছিল।

সত্যদার মতোই আরেক সাধকের সন্ধান মিলেছিল পলাশিতেই। সুগার মিলেই কাজ করতেন মান্নাবাবু। দীর্ঘ বছরের অচর্চায় নামটা হারিয়ে গেছে। শুধু পদবিটা জেগে আছে শুশুকের মতো। ছড়ানো-ছিটোনো মিল কলোনির পুবপ্রান্তে হাসপাতাল। তার সামনে একটা বিস্তৃত মাঠ। মাঠের একপাশ থেকে শুরু হয়েছে শ্রমিক আবাসন। অন্যপাশে বিস্তৃত আমবাগান, যা তেজনগর গ্রামের সীমানা। এই মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেয়ে সাদা সিঁথি পথ। গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হয় রমণক্লান্ত বিধবার মতো নেতিয়ে আছে। সেই পথের একধারে, আমবাগানের কোল ঘেঁষে একাকী দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ি। তার হাত চারেক দূরে বিশালকায় তেঁতুলগাছ, অন্যদিকে কয়েক পা এগিয়ে বেলগাছ। এই একাকী নির্জন আবাসে থাকতেন মান্নাবাবু। বলতাম মান্নাকাকু। চাকরি করতেন কোম্পানির অফিসঘরে। চলতি কথায় ঘড়িঘর। বাকি সময় নানা কাজ তাঁর। স্বপাকে আহার। সংসারী হয়েও সংসারবিহীন তাঁর যাপন। অন্য কোনো জেলায় থাকতেন তাঁর পরিবার। পলাশিতে তিনি ধ্যানস্থ ঋষি। ছোটোদের কাছে আকর্ষণ ছিল তাঁর গবেষণাগার। সদর দরজা, তিনি থাকাকালীন অবস্থায় হাট করে খোলা। প্রবেশ, প্রস্থান অবাধ। কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি তাঁকে। নিজের কাজ করতে করতেই উত্তর দিতেন নানা প্রশ্নের। সহাস্যে। যেন তিনি মজা পেতেন।

আমরা যাওয়া-আসার পথে কখনো-সখনো ঢুকে যেতাম তাঁর ঘরে। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে তিনি তখন কোনো রেডিয়ো নিয়ে নিরীক্ষা করছেন। ঘরে একটা চৌকির ওপর নানা আকার-প্রকারের রেডিয়ো। কেউ কেউ হয়তো সারাতে দিয়েছেন। তখন ভাল্‌ব রেডিয়োর যুগ। একদিন দেখি একটা বড়ো রেডিয়োর গায়ে একটা কালো গোলাকৃতি সুইচ লাগাচ্ছেন। বাড়িতে আলো জ্বালানো, পাখা চালানোর জন্য ওরকম কালো-সাদা সুইচ ব্যবহার করা হত। সেই সুইচ লাগিয়ে দিলেন রেডিয়োর গায়ে। তারপর একটা বড়ো তার ঘরে বাতি জ্বালানোর সুইচ কেটে প্লাগ লাগানোর যে সকেট থাকে তাতে গুঁজে দিলেন। বেশ চলল-- আকাশবাণী কলকাতা। বার দুই সুইচ অফ-অন করে দেখে নিলেন ঠিকঠাক শব্দ বেরোচ্ছে কি না।
কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী করলেন?

-ডাইরেক্ট করে দিলাম।
মিল কলোনির কালো রেডিয়ো খারাপ হলেই দিয়ে আসত মান্নাবাবুকে। তিনি হাসিমুখে সারিয়ে দিতেন। কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। এটা ছিল তাঁর প্যাশন। শুধু রেডিয়ো নয়, পাশের ঘর যেটা ছিল শোবার ঘর, একটা চৌকির ওপর সামান্য বিছানা পাতা, আর একটা কাঠের হাতলঅলা চেয়ার, সে-ঘরটা ছিল অদ্ভুত। ঘরের দেয়ালে ঝুলছে তারসানাই, বেহালা, চৌকির এককোণে দাঁড়িয়ে আছে তানপুরা। একধারে হারমোনিয়াম বসে আছে আলগোছে। একমাত্র কাঠের টেবিলের ওপর তবলা। একটা কাঠের বেঞ্চিতে বাক্স-প্যাঁটরার ওপর শুয়ে থাকত সেতার। অনেকটা বয়স পেরিয়ে এসে সংগীতসাধক ভি. বালসারার ঘরে এরকম দেখেছিলাম। তবে, সেটা ছিল তাঁর মিউজিক রুম। গণসংগীত শিল্পী অজিত পাণ্ডের বাড়িতেও দেওয়ালে বাদুড়ের মতো ঝুলত নানা বাজনা। একটা রাশিয়ান বাজনাও দেখেছিলাম। এখন দেখতে দেখতে সেই হাফপ্যান্ট বয়সে দেখা মান্নাবাবুর কথা মনে পড়ল। একজন নির্জনপ্রবাসী সুরসাধক।

মান্নাবাবুর বাড়িতে মাঝে মাঝে বসত গানের আসর। বেশ রাতে। এলাকার সংগীতসাধকরা আসতেন। চলত শাস্ত্রীয় সুরের চর্চা। তিনি নিজেও কণ্ঠচর্চা করতেন। অনেকরকম বাজনা ছিল তাঁর অধিগত। পাড়ার দু-একটি মেয়ে রোববার সকালে তাঁর কাছে গান শিখত। শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতেও তালিম দিতেন। এই সুরের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ল উড়নচণ্ডীও। কী কারণে জানি না, তারসানাইয়ের দিকেই তার মন গেল। মান্নাকাকুর তত্ত্বাবধানে চলল বছরখানেকের চর্চা। তারপর পড়াশুনোর স্বার্থে পলাশি ত্যাগ করার পর সে-বাসনায় ছাই পড়ল। অন্য আকর্ষণে পলাশি সরতে লাগল। ক্রমশ ধূসর হয়ে গেলেন মান্নাকাকু।
...........................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা..........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।

মানববর্জ্য এবং আবর্জনায় ভরে রয়েছে সংকীর্ণ গলিপথ। তাঁর নিজের নৈতিকতা-বিবর্জিত, উৎকোচে ভরা এবং অজস্র অযোগ্য বিচারে কলুষিত ...
04/11/2025

মানববর্জ্য এবং আবর্জনায় ভরে রয়েছে সংকীর্ণ গলিপথ। তাঁর নিজের নৈতিকতা-বিবর্জিত, উৎকোচে ভরা এবং অজস্র অযোগ্য বিচারে কলুষিত জীবনের মতোই দুর্গন্ধময় পথটুকু পিলেত নিঃসংকোচে পার করলেন। শহরের দুই প্রধান রাস্তার সংযোগকারী সংকীর্ণ গলির অপরপ্রান্তে পৌঁছে বিদ্রোহী ফুসফুসকে শান্ত হতে কিছুটা সময় দিলেন তিনি। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে জরিপ করে নিলেন এ প্রান্তের পরিবেশ। স্বাভাবিক। কয়েক পা দূরে রাস্তার পাশে পরপর কয়েকটা দোকান। এক বৃদ্ধা সম্ভবত তাঁর বংশজকে নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত। ব্রোঞ্জের তৈরি একটা ছোট্ট ঘোড়া নিয়ে দোকানির সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। স্বস্তির শ্বাস নিলেন বর্তমানে রোমের সবচেয়ে চর্চিত মানুষটি।

'তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো।' সন্ত্রস্ত ভৃত্যদের নির্দেশ দিয়ে পিলেত গলিমুখ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর ক্লান্ত পায়ে দরদামে নাছোড় দোকানির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সম্ভ্রান্ত পোশাকে উঁচুদরের ক্রেতা ভেবে দোকানি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

'আমি কি এখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে পারি?' ভেঙে পড়া স্বরে অনুরোধ জানালেন এক সময়ের আদেশকারী জুডেয়ার প্রশাসনিক প্রধান। দোকানিকে প্রথমে হতাশ দেখাল। কয়েক মুহূর্ত সে নিষ্পলকে চেয়ে রইল মুনাফার মোটা দাঁও ভেবে বসা সম্ভ্রান্ত পোশাকের মানুষটির দিকে। তারপরেই প্রবল উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল, 'পিলেত! জুডেয়ার পয়েন্টাস পিলেত! তাহলে খবরটা মিথ্যে নয়!'

যে বৃদ্ধা এতক্ষণ ধরে সাজিয়ে রাখা পসরা থেকে সঙ্গের শিশুটির নতুন পছন্দ খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন, দোকানির আচমকা চিৎকারে চমকে উঠলেন। আতঙ্কিত নজরে ধূসর চুলের বৃদ্ধ পিলেতকে আপাদমস্তক মেপে পাশের অত্যুৎসাহী শিশুকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর যেন ভয়ংকর কোনো জান্তব শক্তি তাঁকে তাড়া করেছে এমনভাবে ছুটতে শুরু করলেন। একইসঙ্গে পয়েন্টাস পিলেতের নাম ঘৃণাভরে দু-পাশে ছড়িয়ে দিতে ভুললেন না।

'হা ঈশ্বর!' হাহাকারের মতো শোনাল পিলেতের কণ্ঠস্বর। 'নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর সমস্ত ইহুদিদের কাছে আমি নরপিশাচ! সকলের কাছে অস্পৃশ্য।'........................................
সৌভাগ্যশলাকা
অলোক সান্যাল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।

বাংলার জমিদার, মহারাজা বা উচ্চবিত্ত বাঙালি শিকারীরা, যখনই শিকার স্মৃতি লিখতে বসেছেন, অরণ্যের সৌন্দর্য থেকে কেউ কিন্তু মু...
03/11/2025

বাংলার জমিদার, মহারাজা বা উচ্চবিত্ত বাঙালি শিকারীরা, যখনই শিকার স্মৃতি লিখতে বসেছেন, অরণ্যের সৌন্দর্য থেকে কেউ কিন্তু মুখ ফিরিয়ে থাকেননি। অরণ্যমধ্যে পরিত্যক্ত বাসভূমি সূর্যকান্ত আচার্যর হৃদয় আর্দ্র করেছে। ময়ূরভঞ্জের বর্ষার রূপ মুগ্ধ করেছে অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়কে। অরণ্যের রূপ-রস-গন্ধকে না চিনলে হয়ত শিকারী হওয়া যায় না। অথচ, বন্যপ্রাণ—যা, অরণ্যেরই অংশ স্বরূপ, তা নিধনের পর এদের বিজয়-উল্লাস বড় পীড়াদায়ক। এমন মনস্তাত্ত্বিক বৈপরীত্য সম্ভব! এ কি, শিক্ষিত তথাকথিত সংস্কৃতিবান বাঙালির চারিত্রিক দ্বিচারিতা?

এ স্মৃতি-মালা বিগত যুগের মুষ্টিমেয় বাঙালির শৌর্য, বীরত্বের গৌরবগাথার নাকি, প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণ বিনাশের আঁধার ইতিহাসে বাঙালির লজ্জাজনক আখ্যান এবং একই সঙ্গে এক উৎকেন্দ্রিক দেশীয় অভিজাত শ্রেণীর স্বরূপ উন্মোচনের উপাদান, তা সমাজ-ইতিহাসে মনোযোগী পাঠক অনায়াসেই বুঝতে পারবেন।
বাঙালির শিকার স্মৃতি
সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা

সুপ্রকাশ

অনেকদিন পর স্মৃতির শহরে পা দিয়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অবিরত চেনামুখগুলো কোথাও ধূসর, কোথাও ছায়া ভেঙে সামনে চলে আসে। কখ...
03/11/2025

অনেকদিন পর স্মৃতির শহরে পা দিয়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অবিরত চেনামুখগুলো কোথাও ধূসর, কোথাও ছায়া ভেঙে সামনে চলে আসে। কখনো আবার কোনো প্রাচীন ঘোলাটে চোখ তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। তারপর দন্তবিহীন মাড়ি ছাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, কীরে, কেমন আছিস? কবে এলি?
তখন তার ঘোলাটে চোখ চকচক করে ওঠে। বেরিয়ে আসতে চায় দ্যুতি। ছুটোছুটি করতে চায় সামনে ছড়িয়ে থাকা সবুজ মাঠের ওপর।
তাকিয়ে থাকি আমিও। উত্তর দিই, ভালো। কাল এসেছি। তুমি কেমন আছ?
—এই আছি। তোর ঘরের খবর কী? সব ভালো তো?
কুশল সংবাদ বিনিময় চলছে, আর আমি ভেতরে ভেতরে হাতড়ে চলেছি নাম। এই প্রাচীনের নামটা মনে করতে পারছি না। প্রাচীনত্ব কিছুক্ষণ দম ধরে বসে রইল। তারপর পেনাল্টি কিক মারার মতো শব্দ ছিটকে দেয়, ‘মনাটা মরে গেল।’ কোনো আবেগ নেই। দুঃখ নেই, শুধু সংবাদ। সেই ছিটকে আসা শব্দ দু-হাতে লুফে নিয়ে বললাম, ও তো আলাদা বাড়ি করেছিল।
—বড়দাকে মনে আছে? সুনীলদা? সেও মারা গেছে।
—শুনেছি।
কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে নামটা ভেসে উঠল-- নীরজদা। ভালো ফুটবল খেলত। শহরে প্রথম ডিভিশনে খেলত। কাজ করত কারখানায়। খেলা, কাজ আর সংসার নিয়েই ছিল তার যাপন। এখন, এই প্রাচীন বয়সে বাড়ির সামনে একটা গুমটি চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে থাকে। নিজের উত্তরে কথা বলতে বলতে দিন গোনে জীবন অবশেষের।
এগিয়ে চলি। চেনামুখের ভিড় পাতলা হয়ে আসছে। অচেনা তরুণ মুখের মিছিল। স্বাভাবিক। এটাই তো হওয়ার কথা। তারই মাঝে কালের সাক্ষী হয়ে কেউ কেউ বয়ে যায়। আর রয়ে যায় বলেই এই নতুনের হাটেও তারা সমান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।
এই ভাবনা মেনে নিতে নিতে স্মৃতির পথ ধরে হাঁটি। জীবনের নুড়িপাথর বিছোনো পথে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতেই চোখ যায় সামনের দিকে। ঢোলা পাজামা, লম্বা পাঞ্জাবির, গোঁফ-দাড়ি আচ্ছাদিত এক মৌলবি এগিয়ে আসছে। মাথায় টুপি। হাঁটার ছন্দ পরিচিত। যত কাছে আসছে, তত আগল খুলছে। মুখোমুখি হতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। হজ।
প্রত্যুত্তর না-দিয়েই জড়িয়ে ধরল। কতদিন পর দেখা। কেমন আছ? তোমার সব খবরই পাই।
—তুমি কেমন হজ? তোমার দোকান?
—আছে, দোকান আছে। এখন কিতাব গড়াই।
—কবিতা লিখছ?
—লিখছি। সব পত্রপত্রিকায়। এবার একটা বই করব ভাবছি। ক-দিন আছ?
—আছি, দিনতিনেক।
—বিকেলে দোকানে এসো। গল্প করা যাবে। শুনেছ, মালি মারা গেছে?
—তাই নাকি? কবে? কোথায় মারা গেল?
—তা, মাস ছয়েক হয়ে গেল। ওপারেই মরেছে। মরার আগে একবার এল।
মালি— সেই মালি। সবসময় ছিল হজরতের জিগরি দোস্ত। পরে ঘোর শত্রু। আরও পরে সহজ সম্পর্ক। মালি ছিল হজরতের ইস্কুলের বন্ধু। পাড়ারও বন্ধু। ওদের একটা দল ছিল। যতরকমের বদবুদ্ধি ওদের মাথায় ঘুরত। তবে সকলেই যে সমান ছিল, এমন নয়। যেমন, মালি ছিল মারামারিতে ওস্তাদ। দুবলা-পাতলা দেহ নিয়েই ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ করত। ভালো লাঠি চালাতে শিখেছিল ওই বয়সেই। আবার হজ ছিল শান্ত প্রকৃতির। সে বুদ্ধি জোগাত। স্কুলে হজ বেশ ভালোই ফল করত। মালি ততটা নয়। অনেক সময় ঘষটে ঘষটে পাশ করত। দু-জনেই পড়ত মিশনারি স্কুলে। ইস্কুলে কিন্তু কোনো খারাপ কাজের নিদর্শন ছিল না। বরং, কিছুটা আড়ালেই থাকত তারা, অন্য অনেকের মতো। তা, হজের চোখ একদিন কানা হয়ে গেল। হয় সেই মালির জন্যই।
ওরা আমবাগানে ঢুকে গাছে লক্ষ্যভেদ করছিল একটা ধারালো চাকু নিয়ে। এটা নতুন খেলা। সেদিনই শুরু করেছিল। গাছে একটা দাগ কেটে দূর থেকে ছুরি ছুড়তে হবে, গাছের গুঁড়িতে দাগ দেওয়া জায়গায় বিঁধতে হবে। মোটা আমগাছের গোড়া ছিল বেশ শক্ত। সকলেই ছোড়ে, ছুরি পড়ে যায়। গাছে আর বেঁধে না। হজ দু-বার ব্যর্থ হওয়ার পর, তৃতীয়বারে গাছের অনেকটা কাছে গিয়ে চাকু ছুড়ল। চাকুটা গাছে না-বিঁধে, ধাক্কা মেরে উলটো হয়ে ফিরে এল। কেউ কিছু বোঝার আগেই চাকুর ফলাটা হজের এক চোখে বিঁধে মাটিতে পড়ে গেল। রক্ত পড়তে লাগল হজের চোখ থেকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা। সঙ্গেসঙ্গে, সদর হাসপাতাল। চোখে ব্যান্ডেজ। ওষুধ, ইঞ্জেকশন। বাড়িতে পড়ে রইল বেশ কিছুদিন। সব দোষটা পড়ল মালির ঘাড়ে। কারণ, সে-ই ছিল পালের গোদা। হজ কারুকে দোষ দিল না। কিন্তু, ওর বাড়ির লোকেরা মালিকে কাঠগড়ায় তুলল। মালি ভয়ে কোথায় গা-ঢাকা দিল।
প্রায় মাসদেড়েক পরে হজ স্কুলে গেল। একটা চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেল। আরও ভালো চিকিৎসার পয়সা তাদের ছিল না। বাপ ছিল দিনমজুর। তখনকার দিনে কতই-বা রোজগার। আর, শহরে তখন ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে, হজকে একটা চোখ নিয়েই দিনযাপন করতে হল।...........................................
উড়নচণ্ডীর পাঁচালি
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা..........................................
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য।

করোটি পাহাড়ে উঠে আসার মুখে, একটা পাথরে নিজের ভর সঁপে বসে ছিল গায়াস। তার সেনা-পোশাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ শুকিয়ে গাঢ় হয়েছ...
02/11/2025

করোটি পাহাড়ে উঠে আসার মুখে, একটা পাথরে নিজের ভর সঁপে বসে ছিল গায়াস। তার সেনা-পোশাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ শুকিয়ে গাঢ় হয়েছে। গতকালের ভিড় অদৃশ্য হয়েছিল সন্ধের আগেই। তারপর থেকে ক্রুশবিদ্ধ শরীরগুলো পালা করে পাহারা দিয়ে গেছে অধীনস্থ সামারিটান সৈন্যরা। ক্লান্ত ছিল তারাও। আটদিন ধরে চলা নিস্তারপর্বে শহরে বহু পুণ্যার্থীদের আসা যাওয়া লেগে থাকে। সেই সময় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে কম শক্তিক্ষয় হয় না। নিস্তারপর্ব মিটতে না মিটতেই আবার বিচারসভা বসেছিল। সে-ও এক অশান্তির পরিবেশ। আর তারপর গতকালের অস্থিরতা। সবকিছু সামলানোর পরে একটু বিশ্রাম তাদেরও প্রাপ্য।

এক রোমান সেঞ্চুরিয়ানকে করোটি পাহাড়ের মুখে উঠে আসতে দেখে নিজের ভাবনা থেকে সরে এল গায়াস। একটু দূরেই গভর্নর পিলেতের ব্যক্তিগত সচিব ম্যালিনাস উদাস মুখে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি বাঁধা পড়ে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ নাজরাতীয় জিশুর নিষ্প্রাণ শরীরে। ম্যালিনাসকে আগে কখনো এতটা বিচলিত হতে দেখেনি গায়াস। বিচার শেষে এমন পরিণতি নতুন নয়। গলগাথার রাস্তায় এমন সারিবদ্ধ ক্রুশের অবস্থিতি বিষণ্ণতা এবং ভয় মিশ্রিত এক ধরনের অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জন্ম দেয় বটে, তবে তা সাধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেক্রেটারি ম্যালিনাস, সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কিংবা সামারিটান সৈন্যদল, যারা বিশ্রামে গিয়েছে তাদের কাছে এ এক অতিপরিচিত স্বাভাবিক দৃশ্য। অথচ গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিবটি গতকাল থেকে একই কথা আউড়ে চলেছেন,

'আমরা পাপ করেছি, গায়াস! নাজরাতীয় জিশু প্রকৃতপক্ষেই স্বর্গপ্রেরিত দেবদূত। সে ঈশ্বরের সন্তান। আমরা তার প্রতি অবিচার করেছি!'

গায়াস এতদিন ক্রুশে ঝুলন্ত শরীরটাকে মানুষ বলেই মনে করত। জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং অবশ্যই, দয়ালু একজন মানুষ। দুঃখী মানুষের ব্যাধি জাদু প্রয়োগ করে দূর করতে দেখছে। গায়াসের নিজের ভৃত্যকেই সুস্থ করেছিল নাজরাতীয় জিশু। সেসবে বাকি ভক্তের দল ঐশ্বরিক ক্ষমতা খুঁজে পেলেও, গায়াস পেয়েছিল কৌশল। বিভিন্ন জমায়েতে তার বলা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনেছে। টিলার উপরে দাঁড়িয়ে শ্যামলকান্তি মানুষটি উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে বলছে, 'আত্মায় নম্র যারা, তারা ধন্য। স্বর্গরাজ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যারা ন্যায়পরায়ণতার জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত, ধন্য তারা।' কিংবা, 'শত্রু যদি তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চায়, বিচারসভা পৌঁছোনোর আগেই তার সঙ্গে মিটমাট করে নাও। নইলে সে তোমাকে বিচারকের হাতে তুলে দেবে, বিচারক রক্ষীর হাতে এবং রক্ষী তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। মনে রেখো, নরহত্যা করলে ঈশ্বরের বিচারালয়ে জবাবদিহি করতে হবে।'

সত্যকে কত সহজভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল মানুষটা! অথচ দেখো, সকলে মিলে তাকেই কীভাবে অবলীলায় হত্যা করল! হ্যাঁ, নাজরাতীয় জিশুকে যে হত্যাই করা হয়েছে এ নিয়ে গায়াসের মনে অন্তত কোনো সংশয় নেই। হয়তো সচিব ম্যালিনাসও তা-ই মনে করেন। বিচারের নামে হত্যা। আর সে, সচিব ম্যালিনাস, সামারিটান সৈন্যদের দল, এবং অবশ্যই গভর্নর পিলেত সকলে সেই পাপের সমান অংশীদার। বাকিদের সঙ্গে নরকের আগুনে তাদেরও পুড়ে মরতে হবে। কিন্তু এতকিছুর পরেও নাজরাতীয় জিশুকে কেবলমাত্র একজন জ্ঞানী মানুষ বলেই মনে করত গায়াস। গতকাল থেকে সেই ধারণা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সচিব ম্যালিনাসের মতো তার মনও দ্বিধাদীর্ণ। সীমাহীন শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেও কোনো মানুষ এতটা শান্ত, সমাহিত ভাব ধরে রাখে কীভাবে? আর তারপর, ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় হঠাৎ নেমে আসা অকাল রাত্রি, পৃথিবীর কেঁপে ওঠা- এগুলো তো কোনো জাদুকৌশল ছিল না! তবে কি সত্যিই...? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় সচিব ম্যালিনাসের পাশে গিয়ে দাঁড়াল গায়াস। চোখাচোখি হতে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানাল।

'এই অহেতুক রক্তপাত এড়াতে গভর্নর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তা-ই না? তবুও দেখুন, মাননীয় ম্যালিনাস, আমাদের হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ অমলিন!'........................................
সৌভাগ্যশলাকা
অলোক সান্যাল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য। আগামী সপ্তাহে আসছে।

সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৪। বরুণদেবসম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক কমেন্টে।
02/11/2025

সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৪। বরুণদেব
সম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক কমেন্টে।

কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৪। শোভন সরকারসম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক কমেন্টে।
02/11/2025

কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৪। শোভন সরকার
সম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক কমেন্টে।

অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৫। অনন্ত জানাসম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক কমেন্টে।
02/11/2025

অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৫। অনন্ত জানা
সম্পূর্ণ পড়ার লিঙ্ক কমেন্টে।

Address

16, Radhanath Mallik Lane
Kolkata
700012

Opening Hours

Monday 12am - 8pm
Tuesday 12pm - 8pm
Wednesday 12pm - 8pm
Thursday 12pm - 8pm
Friday 12pm - 8pm
Saturday 12pm - 8pm

Telephone

+919477530440

Website

http://suprokashbooks.com/

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Suprokash posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Suprokash:

Share

Category