21/05/2025
আজ ২২-শে মে ২০২৫। আজ থেকে বাইশ বছর আগে, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সী একটি আধা-শহুরে আধা-গেঁয়ো বাঙালী ছেলে, একটা আস্ত উপন্যাস লিখে ফেলেছিলো, তাও আবার ইংরাজী ভাষায়।
ঐ সময় তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরে অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি তৈরী করে যে অপ্রত্যাশিত বিপন্নতা, তা থেকেই যেন উপন্যাসটির ভাষা খুঁজে পায় তাঁর অব্যক্ত যন্ত্রণা; আর সেটির উপাদান হয়ে ওঠে, ঐ সময়ের আরো ছ' বছর আগে, তাঁর উনিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই, ঘটে যাওয়া তাঁর জীবনের প্রথম দুর্ঘটনাটির বিপর্যস্ততা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া হিসেবে পৃথিবীর প্রাজ্ঞতম কথকদের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থগুলির মধ্যে তাঁর নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার সাধনা থেকে স্বোপার্জিত জ্ঞান ও জীবনদর্শন বোধ।
এরপর আরম্ভ হয় প্রত্যাখ্যাত হতে শেখার ধৈর্যের পরীক্ষা। পরবর্তী বারো বছরে দেশের তথা বিদেশের বিভিন্ন ছোট-বড়-মাঝারি প্রকাশকদের কাছে মোট উনষাটবার খারিজ হয় সেই ইংরাজী উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি। এ প্রসঙ্গে লেখকের নিজের বয়ানটি ভারি সরস : "সেরিব্রাল সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় লেখকদের ধ্রুপদী গুমর অনুসারে, একটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যানই যেহেতু গুণগত মাপের মাপকাঠি, সেহেতু সান্দীপনী ধন্দ ছড়িয়ে দিয়ে বলা যেতেই পারে, যে এক্ষেত্রে স্যামুয়েল বেকেটকে আর ডেভিড মার্কসনকে যথাক্রমে তৃতীয় ও দ্বিতীয় স্থানে রেখে পরাজিত করে আমিই ক্লাসের ফার্স্ট বয়।" (বই হয়ে প্রকাশের আগে বেকেটের 'Murphy' ৪২ বার ও মার্কসনের 'Wittgenstein's Mistress' ৫৪ বার প্রত্যাখ্যাত হয়; উত্তরকালে, দু'জনেই হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তী।)
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যে ঐ বাঙালী ছেলেটির লেখা ইংরাজী উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি প্রত্যাখ্যানকারী এই প্রকাশকরা ছিলেন মোটামুটিভাবে তিন রকমের। এক, যাদের পাণ্ডুলিপিটি পছন্দ হয় নি; কেননা, তাঁরা গতানুগতিকতার বাইরে বেরোতে ভয় পেয়েছিলেন; অর্থাৎ, যারা আদতে হরিপদ-কেরানী গোছের সাদামাটা নিয়মের বেড়াজালে অভ্যস্ত চিরভীরু মানুষ; কিন্তু, বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বসম্পন্ন প্রকাশকের বা সম্পাদকের চেয়ারে, পাকেচক্রে, বসে পড়েছেন। দুই, যারা পাণ্ডুলিপিটির একটি শব্দও বুঝতেই পারেন নি; কেননা, তাঁদের পড়াশোনার পরিধি ছিলো খুবই সীমিত; অর্থাৎ, যারা আদতে happy-go-lucky ধরণের হুজুগে মস্তিবাজিতে আর অগভীর ফাজলামিতে অভ্যস্ত শুধুই ঝিংচ্যাকপ্রেমী মানুষ; কিন্তু, প্রকাশকের বা সম্পাদকের সিরিয়াস চেয়ারে, কপালের জোরে, বসে পড়েছেন। তিন, যাদের পাণ্ডুলিপিটিকে দুর্দান্ত রকমের ভালো লেগেছিলো, কিন্তু তবু তাঁরা এটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; কেননা, তাঁদের মনে হয়েছিলো যে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব নয়; অর্থাৎ, যারা আদতে হেগে-ডলারে-পোঁদ-মোছার-স্বপ্ন-দেখা গোত্রের সবকিছুকে বেচাকেনার আর লাভলোকসানের হিসেবে মাপতে অভ্যস্ত ক্যাপিটালিস্ট মানুষ; কিন্তু, শিল্পের নান্দনিক উৎকর্ষকে ব্যবসায়িক মুনাফার চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকাশকের বা সম্পাদকের চেয়ারে, দুর্ঘটনাবশতঃ, বসে পড়েছেন।
যাই হোক, অতঃপর, ২০১৫ সালে, কলকাতারই একটি কলেজে অধ্যাপনারত, বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রামের ভূমিপুত্র, ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের এক তরুণ অধ্যাপক, প্রকাশকের ভূমিকায় উদ্যোগী হওয়ায়, সেই পাণ্ডুলিপি গ্রন্থ হয়ে উঠে আত্মপ্রকাশ করে কলকাতার জ্ঞানমঞ্চ প্রেক্ষাগৃহে, ২০১৬ সালের ২২-শে মে।
মাত্র ২৮৮ পৃষ্ঠার এই বহু-বহুস্তরীয় উপন্যাসে পাওয়া যায় বিশ্বসাহিত্যের ৯৪-টি সেরিব্রাল গ্রন্থের প্রত্যক্ষ ও/বা পরোক্ষ উল্লেখ তথা রূপক পুনর্নির্মাণ, এবং অনুরণিত হয় ২৭৬ খানি চরিত্রের স্বর।
সেই গ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার আজ নবম বর্ষপূর্তি। 'Pastiche of Angst' নামক সেই উপন্যাস ইতিমধ্যেই "cult" হওয়ার পথে গুটি গুটি পায়ে আগুয়ান।
২০১৬ সালে, 'Pastiche of Angst' প্রকাশিত হওয়ার পর, সেই গ্রন্থ পাড়ি দেয় ইউরোপের আটটি দেশের বারোটি গবেষণামূলক চর্চার প্রতিষ্ঠানে --- আয়ারল্যাণ্ডের দুটি, The James Joyce Centre ও Dublin City Library and Archive; ব্রিটেনের দুটি, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের James Joyce Broadsheet ও Faber and Faber Limited; সুইজারল্যাণ্ডের দুটি, Zurich James Joyce Foundation ও Jan Michalski Foundation for Writing and Literature; ইতালির দুটি, রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের The James Joyce Italian Foundation ও ট্রিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের The Trieste Joyce School; বেলজিয়ামের The Antwerp James Joyce Centre; জার্মানির City of Frankfurt Department of Culture; চেক রিপাবলিকের The Franz Kafka Society; আর ফ্রান্সের প্রবাদপ্রতিম বুকস্টোর তথা গবেষণাকেন্দ্র Shakespeare and Company-তে।
এবং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি অনুরূপ চর্চাকেন্দ্রে --- ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের Joyce Studies Annual জার্নাল, টালসা বিশ্ববিদ্যালয়ের James Joyce Quarterly জার্নাল, মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের The James Joyce Literary Supplement জার্নাল, ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির The International James Joyce Foundation, ও নিউইয়র্কের The James Joyce Society-তে।
২০১৭ সালে, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ জার্নালটিতে (James Joyce Broadsheet) 'Pastiche of Angst'-এর একটি চমৎকার গ্রন্থ-সমালোচনাও প্রকাশিত হয়।
২০২০ সালের ১৫-ই সেপ্টেম্বর মার্কিন সাংবাদিক Andrew Roxburgh, 'US Times Now' সংবাদপত্রে 'Pastiche of Angst'-এর লেখক নীলোৎপল রায়ের উপর একটি গুণগ্রাহী প্রতিবেদন লেখেন।
ঐ বছরেরই ১৭-ই অক্টোবর 'Resident Weekly' সংবাদপত্রে 'Pastiche of Angst'-এর উপর একটি অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ নিবন্ধ লেখেন শিকাগো-বিশ্ববিদ্যালয়ের-প্রাক্তনী, সাংবাদিক Tony Anderson.
আবার, ঐ বছরেরই ১৪-ই ডিসেম্বর 'Fab World Today' পত্রিকায় নীলোৎপল রায়ের যে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়, সেখানেও আলোচনার মূল বিষয় ছিলো এই 'Pastiche of Angst' উপন্যাসটি।
তারপর, ইতালির জেমস জয়েস গবেষণাকেন্দ্র The James Joyce Italian Foundation থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক (peer-reviewed) জার্নাল 'Joyce Studies in Italy'-র ২০২১ সালে মুদ্রিত তেইশতম সংখ্যাটিতে (যার শিরোনাম ছিলো 'JOYSPACE : JAMES JOYCE AND SPACE', এবং যে সংখ্যাটির সম্পাদক ছিলেন ইতালির ক্যাসিনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক, তথা প্রখ্যাত ইতালিয়ান লেখক Roberto Baronti Marchiò) নীলোৎপল রায়ের ঐ নিরীক্ষামূলক ইংরাজী উপন্যাস 'Pastiche of Angst' সম্পর্কে একটি প্রণিধানযোগ্য ও গভীর, সুদীর্ঘ সন্দর্ভ লেখেন Roma Tre University-র English Language and Translation বিভাগের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যাণ্ট প্রফেসর Annalisa Federici.
আবার, খড়গপুর কলেজের সঙ্গে সহযোগিতায়, Kharagpur Social Empowerment & Research Association (KSERA) কর্তৃক প্রকাশিত, Associate Multidisciplinary Multilingual Peer-Reviewed Research Journal (আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণামূলক ষান্মাষিক জার্নাল) 'inQuest'-এর সপ্তম বর্ষ, গ্রীষ্ম ২০২৩-এর সংখ্যাটিতে 'Pastiche of Angst'-এর লেখক নীলোৎপল রায়ের সার্বিক লেখালেখি সম্পর্কে একটি মেধাবী গবেষণা-পত্র লেখেন ক্ষুদিরাম বোস সেণ্ট্রাল কলেজের ইংরাজী বিভাগের গুণী অধ্যাপক শ্রী সোমনাথ ভট্টাচার্য।
একেবারে গোড়া থেকেই, এই গ্রন্থটির জন্য, কারো সুপারিশ, বদান্যতা, পৃষ্ঠপোষকতা, দাক্ষিণ্য, কিংবা অনুগ্রহ প্রাপ্তির মুখাপেক্ষী হওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও যেন আমাদের, অর্থাৎ প্রকাশনা সংস্থার তরফ থেকে কদাচ না করা হয়, এই মর্মে কড়া নির্দেশ ছিলো স্বয়ং লেখকের, যা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ফলতঃ, এই ন'বছরের যাত্রাপথে 'Pastiche of Angst' কর্তৃক স্ব-কিরীটে অর্জিত এই সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পালকগুলির একটির জন্যও আমরা কারোর কাছে তিলমাত্রও বাধিত নই, কেবলমাত্র আমাদের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ছাড়া। প্রকৃত মননশীল পাঠক-পাঠিকারা সতত আমাদের পাশে থাকবেন, সঙ্গে থাকবেন, এই ভরসাতেই আপনাদের কাছে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আছি এবং চিরকাল থাকবো, যে একটি ব্যতিক্রমী প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে Joyce and Company Publishing Society আগামী দিনেও গ্রন্থ পরিবেষণার ক্ষেত্রে উৎকর্ষের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে চলবে।
পরিশেষে, উল্লেখ থাক এই পোস্টটিতে দেওয়া ছবিটির ইতিহাস। আজ থেকে ঠিক ঐ বাইশ বছর আগেই, দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন, এই গ্রন্থটিরই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটির কিয়দংশ পাঠ করে শ্রদ্ধেয় এ.পি.জে. আবদুল কালাম প্রথম যে চিঠিটি লিখেছিলেন লেখক নীলোৎপল রায়কে, এই ছবিটি সেটিরই একটি আলোকচিত্র, যা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সংগ্রহ থেকে তাঁর অনুমতিক্রমেই আমরা এখানে প্রকাশ করলাম, আমাদের লেখকের আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু পাঠককুলের জন্যে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, যে আমাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে 'Pastiche of Angst' প্রকাশিত হওয়ার মাত্র ১০ মাস আগেই, ২০১৫ সালের ২৭-শে জুলাই, মাননীয় কালাম সাহেব প্রয়াত হন; ফলে প্রকাশিত গ্রন্থটির একটি খণ্ড তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি।
'Pastiche of Angst'-এর মতো একখানি কালজয়ী গ্রন্থের প্রকাশক হতে পেরে আমরা যুগপৎ গর্বিত এবং সম্মানিত। আপনারা যারা এখনো এই গ্রন্থটি পড়ার চেষ্টা করে উঠতে পারেন নি, অবিলম্বে সংগ্রহ করুন। ধন্যবাদ।
Nilotpal Roy Somnath Bhattacharya Nilotpal Roy