03/03/2025
মানুষের জীবনযাপনের ধরন একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এবং তার সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ধারণের বিষয়টিও ব্যক্তি, সমাজ ও বাস্তবতার বিভিন্ন ফ্রেমওয়ার্কের উপর নির্ভর করে।
দর্শনের দৃষ্টিতে জীবনযাপনের স্বাধীনতা ও সফলতার ধারণা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেমন-
জ্যাঁ-পল সার্ত্র ও আলবেয়ার কামুর মতে, মানুষ নিজেই তার জীবনের অর্থ তৈরি করে। সফলতা বা ব্যর্থতা কোনো সার্বজনীন সত্য নয়; বরং এটি ব্যক্তির নিজের সংজ্ঞার উপর নির্ভর করে। জীবনযাত্রার সাফল্য নির্ধারণ হয় ব্যক্তি ও সমাজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী বা আনন্দদায়ক কি তা দিয়ে। সুখ বা সফলতা বাইরের বিষয় নয়, বরং নিজের চিন্তা ও মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থেকেই আসে। জীবনকে মোহ-মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হিসেবে দেখে, যেখানে সফলতা মানে নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে পরম সত্যে পৌঁছানো।
মানসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্ব গঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনযাত্রার স্বাধীনতা নিয়ে কয়েকটি মূল বিষয় উঠে আসে যেমন-
ব্যক্তি যদি নিজের মূল্যবোধের ভিত্তিতে জীবন চালায়, তবে তার মানসিক শান্তি ও আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে।
মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়) থেকে শুরু করে আত্মস্ফূর্তি (self-actualization) পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের প্রয়োজন মেটানোর সাথে জীবনযাত্রার স্বাধীনতা ও সফলতা জড়িত। ব্যক্তি যদি সমাজের চাপ ও নিজের ইচ্ছার মধ্যে দ্বন্দ্ব অনুভব করে, তবে তার মানসিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। সফলতা মানে শুধু লক্ষ্য অর্জন নয়; বরং মানসিক প্রশান্তি ও জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজে জীবনযাপনের ধরন অনেকাংশে নির্ধারিত হয় সাংস্কৃতিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার দ্বারা যেমন-
সমাজ সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ‘সফলতার’ সংজ্ঞা দেয় (যেমন অর্থ, শিক্ষা, খ্যাতি), যা ব্যক্তির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চাইলে অনেক সময় সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে সংঘাতে আসতে পারে (যেমন, পরিবার, ধর্মীয় বিধান)। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে ওঠার সুযোগ, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ইত্যাদির কারণে একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছেমতো জীবনযাপন করতে পারেন কি না, তা নির্ভর করে পশ্চিমা সমাজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও প্রাচ্যের সামষ্টিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা জীবনযাত্রার স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে।
বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যেমন- মানুষের মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশন ও পরিবেশ তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। কেউ যদি স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চায়, তবে তার জেনেটিক প্রবণতা ও শৈশবের অভিজ্ঞতা কী ভূমিকা রাখছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তার আবেগ, মানসিক অবস্থা এবং প্রেরণার ওপর ভিত্তি করে জীবনযাত্রার ধরন বেছে নেয়।
অর্থনীতি জীবনের স্বাধীনতা ও সফলতার সংজ্ঞাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে যেমন-
অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা জীবনযাত্রার স্বাধীনতাকে নির্ধারণ করে। কেউ যদি নিজের খরচ চালাতে না পারে, তবে সে তার ইচ্ছেমতো জীবনযাপন করতে পারবে না।
যেখানে পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দেয়, সেখানে সমাজতন্ত্র সামষ্টিক কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে, জীবনযাত্রার স্বাধীনতা ভিন্নরূপে প্রতিফলিত হয়।
নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের স্বাধীনতা সীমিত, কারণ তাদের অর্থনৈতিক বাধাগুলো বেশি। সফলতা ও স্বাধীনতা নির্ভর করে একজন ব্যক্তি তার পেশাগত জীবনে কতটা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার ওপর।
একজন মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করবেন, সেটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, তবে সেটি দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সমাজ, বিজ্ঞান ও অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণাটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না, কারণ এটি সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার মধ্যে বাঁধা থাকে। সফলতা বা ব্যর্থতার সংজ্ঞাও পরিবর্তনশীল এবং সময়, স্থান ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই, জীবনের প্রকৃত সাফল্য হলো নিজের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করা এবং ব্যক্তিগত শান্তি অর্জন করা।