08/10/2025
#অ্যাভনের_ক্রূররব
#উইলিয়ম_শেক্সপিয়রের_জীবন_ও_সময়
#শুভঙ্কর_ভট্টাচার্য
#অধ্যায়_১
ু_আগের_বা_পরের_লন্ডন
#টেমসে_একটি_ভোর
ভোর। কুয়াশা ছুঁয়ে যাচ্ছে এই জলস্রোত। পূত, পবিত্র নয় তা মোটেও। মানববর্জ্য আর শহরের নর্দমাবাহিত ক্লেদ মিলেমিশে টেমস-এর প্রবাহকে করেছে ঘোলাটে, কৃষ্ণবর্ণ। বন্দরে ভেড়ানো অলৌকিক জলযানগুলো তাদের আড়মোড়া ভাঙছে, শুভ্র সিগালেরা চিৎকার করতে-করতে পাক খাচ্ছে আকাশে, নদীর উত্তর পাড়ে উঁকি মারছে একটি টাওয়ার, তার নিষ্ঠুর পাথুরে দেওয়াল আপামর শহরবাসীকে অবাধ্যতার পরিণাম মনে করিয়ে দিচ্ছে।
দক্ষিণ পাড়ে, নদীর উপর প্রায় হেলে পড়েছে কিছু কাঠের বাড়ি। তাদের পেছনে এখনও ঘুমিয়ে লন্ডন শহর। প্রায় লাখ দুয়েক মানুষের বাস এখন এ নগরে। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর (প্যারিসের পরেই) হলে কী হবে, সুশ্রী সে নয় মোটেও। বছর আটেক হল রানি এলিজাবেথ সিংহাসনে। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মানুরাগী তিনি। ক্যাথলিকরা তাই ভীত, সন্ত্রস্ত। নিজেদের বিশ্বাস প্রতিদিন তারা লুকিয়ে রাখতে শিখে নিচ্ছে।
#বৈপরীত্যের_শহর
আজব বটে এই রাজধানী শহর! একদিকে ভেলভেটের পোশাক গায়ে চড়িয়ে, স্পেনীয় চামড়ার রাজকীয় বুট মসমসিয়ে, কেতাদুরস্ত হয়ে পথ চলছেন অভিজাত সভাসদেরা, অন্যদিকে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা দুরন্ত বাচ্চারা হয়তো-বা খালি পায়ে তাড়া করছে রাস্তার কোনও নেড়ি কুত্তাকে (নাকি বুল ডগ?)। ধোঁয়া ওঠা সরাইখানা থেকে মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। পশুমাংসের সুঘ্রাণের পাশাপাশি লন্ডন ব্রিজে পচতে থাকা নরমাংসের ঘ্রাণও বিবিধ বৈপরীত্যের এই শহরে দুর্লভ নয়। অপরাধীদের প্রকাশ্যে ফাঁসিতে লটকে দেওয়ার বা শূলে চড়ানোর মধ্যযুগীয় রীতি এখনও অস্তমিত হয়নি এখানে।
বাজারের বিকোচ্ছে নানা পণ্যদ্রব্য। প্রাচ্য থেকে আমদানি করে আনা বহুমূল্য রেশম, গরম মশলা, গন্ধদ্রব্যের পাশাপাশি দিশি পশমও। হঠাৎ বড়োলোক হয়ে ওঠা এইসব বণিকেরা লন্ডনের আদি বাসিন্দাদের ঠেলে দিচ্ছে শহরের বাইরে। নব্যধনী ও বিত্তমধ্যদের আমোদপ্রমোদের জন্য অবিশ্যি অলিতে-গলিতে গজিয়ে উঠেছে শুঁড়িখানা— মদ, মাংস ও বারাঙ্গনার অফুরন্ত জোগান সেখানে।
#নতুন_বিনোদন
বিনোদনের একঘেয়েমির জগৎ রঙিন হয়ে উঠল যখন জেমস বারবেজ ১৫৭৬-এ শোরডিচ-এ খাড়া করলেন দ্য থিয়েটার। অভিজাত, অনভিজাত নির্বিশেষে অনেকটা অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো দেখতে কাঠ দিয়ে বানানো এই প্রায়-মাথাখোলা কাঠামোয় হামলে পড়ল নাটক দেখতে। অচিরেই থিয়েটারে বুঁদ হয়ে যাওয়া নগরবাসীদের জন্য এরপর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকবে একের পর এক নাট্যশালা— ১৫৭৭-এ কারটেন, ১৫৮৭-তে দ্য রোজ, ১৫৯৫-এ দ্য সোয়ান, ১৫৯৯-এ গ্লোব, ১৬০০-য় ফরচুন।
#সকলের_থিয়েটার
কিন্তু কারা দেখবে এই থিয়েটার? সবাই। মুটে, মজুর, চাষা, ব্যাপারি, ক্রীতদাস, মনিব সব্বাই মাত্র এক পেনি (যা দিয়ে আস্ত একটা রুটি কেনা যায়) খসিয়েই দেখে নিতে পারবে এই অভিনয়। দুই কিংবা তিন পেনি খরচ করলে মিলবে মাথায় ছাদ দেওয়া গ্যালারি ও প্রাইভেট বক্স। ইন-ইয়ার্ডে (যেমন দ্য বুল ইন, দ্য বেল ইন) রাজদরবারে বা অভিজাতদের প্রাসাদে (যেমন ব্ল্যাক ফ্রায়ার্স থিয়েটার) আলাদা অভিনয়ও অবশ্য হয়ে থাকে। সেখানে প্রবেশমূল্য আরও চড়া।
থিয়েটার ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সুলিখিত নাটকের চাহিদা বাড়ছে। পেশাদার অভিনেতাদেরও। অভিনয় দেখায় বারণ না থাকলেও মেয়েদের অবশ্য অভিনয় করা বারণ। তাদের ভূমিকায় অভিনয় করতে নামছে মিহি গলার বালক বা কিশোরেরা।
কিন্তু সকলের এই থিয়েটারে যাদের মাথার উপর থাকে খালি আকাশ, লন্ডনের সেই সাধারণ জনতা এই মুহূর্তে নাটক দেখতে-দেখতে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠছে। কখনও তারা হাসছে, কখনও কাঁদছে, কখনও-বা চুপ করে যাচ্ছে, কখনও ক্রোধে মাটিতে থুতু ফেলছে, কখনও আবার বিয়ার গলায় ঢেলে উল্লাসে ফেটে পড়ছে! মারপিট বেধে যাচ্ছে প্রায়ই। যাই হোক, রাজতান্ত্রিক ইংল্যান্ডে অবশেষে একটা ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসর তো পাওয়া গেল, গোটা শহর যেখানে স্বাধীনভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছে!
#সেন্সরের_কাঁচি
স্বাধীন। কিন্তু তবু স্বাধীন নয়। লাইসেন্সরাজ এখানেও রাজ করছে বহাল তবিয়তে। থিয়েটার তা সে পাবলিক হোক কিংবা সভার জন্য, অফিস অফ দ্য রেভেলস (যা আবার লর্ড চেম্বারলেইনের অধীনে)-এর অনুমোদন থাকতেই হবেই।
প্রতিটি নাটকের পাণ্ডুলিপি মাস্টার অফ রেভেলস প্রথমে পড়বেন, রাজনৈতিক বা নৈতিকভাবে বিপজ্জনক পংক্তিগুলোকে দরকারে সংশোধন করতে বা বাদ দিতে বলবেন, সন্তুষ্ট হলে ফিজ আদায় করবেন, তারপর সেই নাটক অভিনীত হওয়ার লাইসেন্স প্রদান করবেন। যে নাট্যকার বা প্রযোজকরা বেগড়বাঁই করবে, তাদের চিহ্নিত করে রাখবেন। এলিজাবেথীয় থিয়েটারের এই পৃথিবীতে মাস্টার অফ রেভেলসকে চটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মঞ্চে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দকে এখানে সন্দেহ করা হয়।
#ষড়যন্ত্রের_জগৎ_গুপ্তচরের_পৃথিবী
শুধু মঞ্চে নয়, বারাঙ্গনাপল্লিতে, শুঁড়িখানায়, প্রমোদোদ্যানে কে কী বলছে, কান পেতে শুনছে দেওয়াল কিংবা দেওয়ালের আড়ালে রাষ্ট্র নিযুক্ত কোনও গুপ্তচর। এলিজাবেথের ডান হাত স্যার ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহ্যাম সবার অজান্তে গড়ে রেখেছেন এক স্পাই নেটওয়ার্ক। রানিকে ঘরের ও বাইরের শত্রুদের থেকে বাঁচাতে থিয়েটার হাউসেও লোক লাগিয়েছেন এই চরপ্রধান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যমোদী মেধাবী ছাত্ররাও (ইউনিভার্সিটি উইটস) নতুন ধারার নাটক লিখে যারা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, নাকি তাঁর পে-রোলে!
#রোগের_শহর
সাউথওয়ার্কের দিকে, নদীর তীর ক্রমশ জমজমাট হয়ে উঠছে। পান্থশালা, শুঁড়িখানা, পতিতাপল্লি— গিজগিজ করছে লোকজন। এমনিতেই নোংরা শহর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বলে নেই কিছুই। সাধারণ মানুষ তো বটেই, অভিজাতেরাও স্নান করেন কালেভদ্রে, সুন্দরী নারীদের মাথায় উকুন, ‘জোরডান’ নামে চেম্বার পটে ঘরের মধ্যেই প্রাতঃকৃত্য সেরে মানুষ তা উপুড় করে ফেলে দেয় রাস্তার উপরে।
শহরে উন্নত পয়ঃপ্রনালী বলে কিছু নেই। টেমসের জল (শহরের পানীয় জলের উৎস যা) ভাসমান বিষ্ঠায় ভরে থাকে। রাস্তায় মরে পড়ে থাকে ইঁদুর। সংক্রামক রোগ হানা দেয় বারে বারে। যখন প্লেগ আসে (যেমন ১৫৯২-৯৩), তখন প্রিভি কাউন্সিলের নির্দেশে থিয়েটার বন্ধ থাকে।
াড়িয়ে_দূরে
এই শহর ছাড়িয়ে দূরে, প্রায় ৯১ মাইল উত্তর-পশ্চিমে, ওয়ারউইকশায়ারের দিকে যদি যাওয়া যায়, অ্যাভন নদীর তীরে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন বলে একটা গ্রাম দেখা যাবে।
২৬ এপ্রিল ১৫৬৪-তে সেখানকারই হোলি ট্রিনিটি গির্জায় তিন দিন বয়সি এক সদ্যোজাতের ব্যাপটিজম করা হল। অর্থাৎ, শিশুটি জন্মেছে ২৩ এপ্রিল। কোথায়? হোনলি স্ট্রিটের একটি কাঠের বাড়িতে। বাবা কে? একজন দস্তানা নির্মাতা, মা? গৃহবধূ।
শিশুটির নাম?
উইলিয়ম শেক্সপিয়র।
(ক্রমশ)