21/06/2025
চরাচর প্লাবিত হচ্ছে প্রবল বর্ষণে। স্বাভাবিক নয় এ বর্ষণ, যেন ঈশ্বরের ক্রোধ অম্বুজাল ছিন্ন করে বর্ষিত হচ্ছে বারিবিন্দুরূপে। সে বর্ষণশব্দের সহচর হয়ে রয়েছে অবিশ্রান্ত ভেকরব। সমগ্র নবদ্বীপের দাদুর কুল যেন কী এক উন্মত্ত বাসনায় চতুর্দিক কম্পিত করছে কর্কশ আহ্বানধ্বনিতে।
বর্ষণপ্রাবল্যে সন্ধ্যাবেলা তুলসীবেদিতে দীপ প্রজ্জ্বলন সম্ভব হয়নি। শ্বেত আকন্দের গোড়ায় পিপীলিকা-স্তূপ সে বর্ষণে ধ্বস্ত। প্রতিবেশী মুকুন্দ শর্মার পুরাতন গৃহপ্রাচীরখানি ঝড়ের আঘাতে ধসে পড়ল। সে শব্দে শ্বশ্রূমাতা বুঝি চমকিত হয়ে উঠলেন। বৃদ্ধার অনিদ্রারোগ। নিদ্রাদেবী বিদায় নিয়েছেন বুঝি চিরতরে তাঁর নয়ন হতে। সামান্য শব্দেই তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। প্রায়ান্ধ বৃদ্ধা, পুত্রনাম ধরে চিৎকার করে ওঠেন।
খিড়কিদ্বারের কবাট দু’টি উন্মত্ত বাত্যাঘাতে শব্দ করে উন্মুক্ত হয়-বন্ধ হয়। অর্গলটি নষ্ট হয়েছে বেশ কিছুদিন। সূত্রধর শ্রীদাম সহজেই সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু তাতে তিন-চার কপর্দিকা ব্যয় হবে। শ্রীদাম অবশ্য অর্থ যাচনা করে না, অর্থ প্রদান করতে গেলে অস্বীকার করে গ্রহণ করতে। বলে, “মা তোমাদের ঘরের কাজ করে দিছি, স্বর্গে আমার থান পাকা হয়ে গেল। ট্যাকা-কড়ির কথা তুলোনি মা।”
মা। সকল সমস্যার সমাধান আছে, এ সমস্যার কোনও সমাধান নেই। এই বয়সেই সে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের মাতৃস্থানীয়া রূপে পরিগণিত হতে আরম্ভ করেছে। সে পথ চললে পথচারীরা সসম্ভ্রমে সরে যায়— সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে। গঙ্গাতীরে এই সেদিন পর্যন্ত সে সখীদের সঙ্গে খেলে বেড়িয়েছে— আজ প্রভাতে সে পথে চলতে চলতে অবগুণ্ঠনখানি ঈষৎ স্খলিত হয়েছিল অসাবধানতায়, রমাকান্ত আচার্যের গৃহিণী শশব্যস্তে সেটিকে পুনঃস্থাপিত করে বললেন, “মাগো, কিছু মনে করো না মাগো। ছেলেপুলে তোমার বরে বেঁচেবত্তে থাকুক।”
আশ্চর্য! মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বেই এই আচার্যদের উদ্যানে সদলে পুষ্পচয়ন করতে গিয়ে আচার্য গৃহিণীর কত কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তবে কেবল আচার্য গৃহিণীই কেন? আবাল্য পরিচিত মানুষের দৃষ্টিতে সে লক্ষ করতে পারে অপরিচয়ের বিস্ময়, অনতিক্রম্য সম্ভ্রম। দিবসকালে তার শ্বশুরগৃহের প্রাঙ্গণ পূর্ণ থাকে পরিচিত-অপরিচিত মানুষের ভিড়ে। দূর-দূরান্ত হতে আসে এয়োস্ত্রী, বিধবা, গর্ভবতী নারীর দল। তার একটি স্পর্শে, একবিন্দু পাদোদকে নাকি বিবাগি স্বামী প্রত্যাবর্তন করবে— রোগোপশম হবে— সন্তানটি সুস্থ জন্ম নেবে।
কয়েকদিন পূর্বে সে ভিড়ে একজনের উপর তার দৃষ্টি পড়ে। এক তরুণী, শীর্ণ দেহে মুখচ্ছবিটি ভারী করুণ। অন্যদের মতো সে আপন সমস্যার কথা বলতে উন্মুখ নয়, নিশ্চুপে সলজ্জ দণ্ডায়মান দ্বারপার্শ্বে। কেবল তার আয়ত চক্ষু দু’টি হয়ে অশ্রুপাত হচ্ছে অঝোরে।
নিস্তারিণী দাসী এসেছিল পাটুলি গ্রাম হতে, পাদোদক সংগ্রহ করার জন্য। তার পুত্রটির মারণ জ্বর। বৈদ্য হরিনামের বিধান দিয়েছেন। নিস্তারিণী অতি মৃদুস্বরে বলল, “মাগো, ও মুখপুড়ির সোয়ামি ঘরে থাকে না। বড্ড বারদোষ। তুমি মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করো মাগো।”
তার নিজের অন্তর হতে উঠে আসছিল চিৎকৃত ক্রন্দন এক। তার আশীর্বাদে নাকি হতভাগিনীর স্বামী প্রত্যাবর্তন করবে, এত শক্তি তার আশীর্বাদের! সে তো আপনজন, নিজের মানুষটিকেই ধরে রাখতে পারেনি। উদ্গত অশ্রু মার্জনা করে সে ওই তরুণীটিকে নিকটে আহবান করে। মস্তকে স্নেহস্পর্শ দেয়, দু’টি মিষ্ট কথা বলে।
মানুষজন বিদায় হলে তাকে উঠতে হয়। শ্বশ্রূমাতার অন্নগ্রহণের সময় হল। দৃষ্টি হারিয়েছেন তিনি, পুত্রবধূর হস্তেই অন্নগ্রহণ করেন। বিধবা মানুষের একবেলার খাদ্য। সে নিজেও ভেবেছিল সেভাবেই চলবে— কিন্তু সমর্থ শরীর খাদ্য যাচনা করে। তাই তাকে সন্ধ্যায় পুনরায় নিজের জন্য দু’টি আয়োজন করতে হয়।
অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা ব্রহ্মোত্তর ভূমি থেকেই হয়ে যায়। শ্বশুর সে ব্যবস্থা করে গেছেন। কিন্তু ঘরে পুরুষমানুষ না থাকলে যা হয়— প্ৰণামোন্মুখ সহস্র মানুষ উপস্থিত থাকলেও সংসারসমস্যার সমাধান হয় না।
তার পিতা বলেছিলেন, “কেন আর ওখানে পড়ে থাকবি মা? শাশুড়িকে নিয়ে উঠে আয় আমাদের কাছে। ও ভাঙা ঘরে আর কী-বা আছে তোর?”
সে সম্মত হয়নি। শ্বশুরভিটা তার। এ ভিটা ত্যাগ করে গিয়ে শ্বশ্রূমাতা শান্তি পাবেন না। এখানেই তাঁর স্বামী, দুই পুত্র, তাদের সমস্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সে স্মৃতিই এখন অসহায়া বৃদ্ধার সম্বল। বাইরে ঝড়ের দাপট বাড়ে। সে নতমস্তকে নিশ্চুপ হয়ে আসীন। ভ্রাতাদের সংসার এখন তার পিতৃগৃহে। সে সংসারে শান্তিলাভ করবে না সে-ও। স্বামী সোহাগিনি বউদিদিরা তাকে কৃপাদৃষ্টিতে দেখবে, সে সহ্য করতে পারবে না।
মাঝে মাঝে বড়ো ক্ষোভ হয় সেই মানুষটার উপরে। ফুলশয্যার রাতে, কিশোরী বধূটির অবগুণ্ঠন সরিয়ে স্বামী বললেন, “তোমার চোখদুটো ঠিক তোমার দিদির মতো। সে একদম তোমার মতো করেই তাকাত।”
যত্নে পরিমার্জিত মৃত্তিকাপ্রাচীরে প্রদীপের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে যেন। উন্মুক্ত গবাক্ষপথ দিয়ে আম্রমুকুলের সুবাস বহন করে আনছে মৃদু বাতাস। সম্মুখে দাঁড়িয়ে গৌরদেহী সুপুরুষ স্বামী। তাঁর রূপ-গুণ-পাণ্ডিত্যের খ্যাতি তাঁকে ইতিমধ্যেই এই কিশোরীটির মনে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। এই মায়াবী রাতে, সেই দেবতা তার মৃত সপত্নীর উল্লেখ করেই উদাস হয়ে গেলেন। তারপর যে কয়দিন তিনি গৃহাশ্রমে ছিলেন— নববধূটি তাঁর মন-শরীরের নাগাল পায়নি। তারপর তো একদিন তিনি চলে গেলেন— এ জন্মের মতো।
বাইরে বর্ষণবেগ হ্রাস পেয়েছে ক্রমে। সিক্ত মৃত্তিকা হতে উত্থিত হচ্ছে জলার্দ্র সুবাস। গৃহপার্শ্বের প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষটির পত্রদলের আশ্রয় ত্যাগ করে শেষবৃষ্টির বারিবিন্দুগুলি ভূমিতে পতিত হচ্ছে— টুপটাপ টুপটাপ। হঠাৎই শচীদেবী কাতরভাবে বলে উঠলেন, “কেরে, নিমাই এলি নাকি বাপ? নিমাই, অ নিমাই।” বৃদ্ধার আর্তনাদ সিক্ত অন্ধকারের বুক চিরে গৃহত্যাগী পুত্রের সন্ধান করে বেড়াচ্ছে অবিরত।
***
অকস্মাৎ নিদ্রা টুটেছে সে মানুষটির। স্বপ্ন। স্বপ্নই তো! স্বপ্ন কি এত স্পষ্ট হয় কখনও? কিন্তু না, স্বপ্নই এ দৃশ্যপট। শচীদেবী আর ইহজগতে নেই। পুত্রের সন্ধান অসম্পূর্ণ রেখেই পরপারে যাত্রা করেছেন চিরদুর্ভাগিনী। এ সংবাদ আনয়ন করেছে দামোদর পণ্ডিত। মা বিদায় নিয়েছেন। সমস্ত জীবন শোকতাপে জর্জরিত হয়েছেন শচীদেবী— অবশেষে তাঁর সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটেছে।
তা হলে, তা হলে নীলাচলে আর কী-ই বা রয়েছে তাঁর জন্য! মাতৃ-আজ্ঞাতেই নীলাচলে এতদিন বাস করেছেন তিনি, মানুষটি ভাবলেন। অস্থির বোধ হচ্ছে তাঁর। এ অস্থিরতার বোধ বেশ কিছুদিন ধরেই অধিকার করে রয়েছে তাঁর হৃদয়-মস্তিষ্ক। এ অস্থিরতা বোধ তাঁর মানসিক শান্তি হরণ করেছে, সম্ভবত হরণ করেছে তাঁর মানসিক ভারসাম্যও।
এ জীবন তো যাচনা করেননি তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকটে। তাঁর একটিমাত্র প্রার্থনা ছিল কেবল— জম্বুদ্বীপের সমস্ত প্রান্তে হরিনামের প্রচার ও প্রসার। কিন্তু সে প্রচারে লাভ হল কি কিছু? আজ তিনি সন্ন্যাসী কৃষ্ণচৈতন্য এক অবতাররূপে পূজিত। কিন্তু অবতাররূপে পরিগণিত হওয়ার কোনও বাসনা ছিল না তাঁর। এ অবতারত্ব তাঁকে আবদ্ধ করেছে শৃঙ্খলে। দান করেছে অস্থিরতা, মানসিক বৈকল্য।
আজ কেউই নেই, যাঁকে তিনি মনের কথা বলতে পারেন অকপটে। হরিদাস ঠাকুর মর্তকায়া ত্যাগ করে গোলোকধামে গমন করেছেন। নিত্যানন্দ সুদূর খড়দহে। আচার্য অদ্বৈত... আচার্য অদ্বৈত কি তাঁর উপর কোনও কারণে রুষ্ট? মানুষটি বুঝে উঠতে পারেন না। আজ সহস্রভক্তপরিবৃত হয়েও তিনি একা। দেবমূর্তির মতো একা, শূন্যগর্ভ মন্দিরের মতো একা।
তিনি জানেন উন্মত্তভাব দেখা দিচ্ছে তাঁর আচার ব্যবহারে। ক্রমবর্ধমান অস্থিরতায় তিনি ভূমিতে লুটিয়ে ক্রন্দন করেন, উন্মাদের মতো গম্ভীরার কক্ষপ্রাচীরে মুখ ঘষেন, বাহ্যজ্ঞান হারান ক্ষণে ক্ষণে। তাঁর ভক্তরা ভাবে ঐশ্বরিক আবেশ ঘটেছে, দিব্যোন্মাদ হয়েছেন মহাপ্রভু। তিনি মনোমধ্যে কেবল হরিনাম জপ করেন। শ্রীহরির উদ্দেশে বলেন, “হে নিঠুর, কথা কও। পথ দেখাও তুমি নিঠুর হে।”
পথনির্দেশ লাভ হয়নি। কোন পথে যেতে হবে তাঁকে, তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। নবদ্বীপে প্রত্যাবর্তন করবেন? সেখানে হয়তো অভাগিনী বিষ্ণুপ্রিয়া তাঁরই অপেক্ষায় রত, এখনও। ওই অভাগিনীর প্রতি কি অন্যায় করলেন তিনি? জগৎসংসারকে পরম সুখের পথ নির্দেশ করতে গিয়ে কি তিনি সংসারসুখ হরণ করলেন নবদ্বীপের ওই কিশোরীটির নিকট হতে? অস্থিরতা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে তাঁর।
না নবদ্বীপে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। আচার্য অদ্বৈত সংবাদ প্রেরণ করেছেন জগদানন্দের মাধ্যমে, প্রহেলিকার অন্তরালে।
‘বাউলকে কহিহ, লোক হইল আউল,
বাউলকে কহিহ, হাটে না বিকায় চাউল।
বাউলকে কহিহ, কাজে নাহিক আউল
বাউলকে কহিহ, ইহা কহিয়াছে বাউল॥’
জগদানন্দের মুখে এই প্রহেলিকা শ্রবণে কেউই তার অর্থ উদ্ধার করতে পারেননি। পেরেছেন একমাত্র মহাপ্রভু, আর সে মুহূর্ত থেকে তাঁর অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অতল বিষণ্ণতা, এক সর্বগ্রাসী হতাশা।
‘বাউল’ যে ‘চাউল’ দান করে এসেছে রাঢ়-গৌড়ের জনগণে, তা আর তারা চায় না। মহাপ্রভুর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ক্রমে জনমানসে গুরুত্ব হারাচ্ছে। ‘আউল’ কাজে এল না। নিত্যানন্দ আজ নবদ্বীপের বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্র হতে দূরে। অদ্বৈত আচার্যের ধারণা, বৈষ্ণব আন্দোলনের দায়িত্ব নিতে শ্রীপাদ ব্যর্থ হয়েছেন।
না, কোনও লাভ নেই নবদ্বীপে প্রত্যাবর্তন করে। সমস্তই ব্যর্থ হল তবে। এই আন্দোলন, এই জন-জাগরণ, এই সাম্যবাদ— যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয়ে মানুষটি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন, “পথ দেখাও প্রভু, এ অন্ধকূপ হতে মুক্তির পথ দেখাও।”
---------------------------------------------------------------------
অভীক মোহন দত্ত রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস 'নিঠুর হে' এখন পাওয়া যাচ্ছে কলকাতাসহ জেলার বিভিন্ন অগ্রণী গ্রন্থবিপণিতে। অন্তরীপের নিজস্ব ওয়েবসাইট-এ বিশেষ ২৫% ছাড়সহ বইটি পাওয়া যাচ্ছে জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত, অর্ডার করার জন্য ক্লিক করুন এই লিংক-এ: https://tinyurl.com/nhjnpe46
আমাজন-এ অর্ডার করার জন্য আগ্রহী পাঠক অর্ডার করতে পারেন এই লিংক-এ:
আদিপর্ব: https://shorturl.at/t4hrE
অন্তপর্ব: https://shorturl.at/OHxWy