07/07/2025
নবনারীকুঞ্জর, সংক্ষেপে নবনারী।
হাওড়া জেলার বাকসাড়া অঞ্চলে এখনও প্রতিবছর প্রায় চার মাস ধরে পুজো হয় দুটি নবনারী মূর্তির।রাধিকা ও তাঁর আট জন সখী ললিতা, বিশাখা, চিত্রলেখা, চম্পকলতা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা, রাঙাদেবী ও সুদেবী। সব মিলিয়ে ন’জন নারী একযোগে কুঞ্জর বা হাতির রূপ ধারণ করেছেন। তাই তাঁরা নবনারী। আর সেই হাতির আরোহী হলেন কৃষ্ণ, এখানে তাঁর নাম রসরাজ। যাঁরা এসব নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের মতে এই নজন নারী হলেন আদতে নয়টি রসের প্রতীক। শৃঙ্গাররস, হাস্যরস, করুণারস, বীররস, ভয়ানকরস, বীভৎসরস, অদ্ভুতরস ও শান্তরস।রাধিকার সখীদের চিনে নেওয়া যায় তাঁদের বৈশিষ্ট্য দেখে। ললিতার গায়ের রঙ হলুদ, তিনি পরেন ময়ূরপুচ্ছ রঙের শাড়ি। রাধিকার সবচেয়ে প্রিয় সখী ললিতা, সাধারণভাবে তাঁর পাশেই থাকেন। কৃষ্ণের যেদিকে রাধিকা, তার অন্যপাশে থাকেন বিশাখা। তাঁর গায়ের রং কমলাভ। চম্পকলতার গায়ের রং চাঁপাফুলের মতো, পরণে নীল বসন। চিত্রাদেবীর গায়ের রঙ গেরুয়া, পরণে স্ফটিকশুভ্র বসন। কুমকুমের মতো রঙ আর সাদা বসনে চিনে নেওয়া যায় তুঙ্গবিদ্যাকে। ইন্দুলেখার গায়ের রং শ্যাম, পরণে ডালিম ফুলের মতো লাল পোশাক।বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দিরের একটি থামের নীচের অংশে এটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। তবে যে নবনারীর মূর্তি বাকসাড়া অঞ্চলে পুজো হতে দেখেছি, তার সঙ্গে এর অনেক ফারাক।আসা যাক হাওড়ার নবনারীকুঞ্জর প্রসঙ্গে, আপাতত সংক্ষেপে। এখানে নবনারীতে রাধা আছেন, আবার তিনি রয়েছেন কৃষ্ণের পাশেও। মানে দুটি রাধা। এই দৃশ্য অন্য কোথাও দেখা যায় না, অন্তত আমি দেখিনি। কৃষ্ণের পাশে রাধিকা না থাকলে মানায় না, তাই শৈল্পিক প্রয়োজনে সামান্য বিচ্যুতি। দুটি মূর্তির একটি কৃষ্ণনগরের শৈলীতে তৈরি, এটি পুরাতন নবনারীকুঞ্জর। অন্যটি কুমোরটুলির সাবেক শৈলীতে, মানে কলকাতার পুরনো বাড়ির পুজোয় দেবী দুর্গার যে আদল দেখা যায়, তেমন। এটি নতুন নবনারীকুঞ্জর।পুজো হয় চার মাস ধরে নবনারী কী, তা নিয়ে একাধিক মত জানা যায়। তার মধ্যে বেশি প্রচলিত মতটি বলা যাক। কৃষ্ণ ছিলেন দ্বারকার রাজা। তখন রাজ্যের শাসক না হলেও গোধনের বিচারে অনেকে রাজা বলে সম্মানিত হতেন। অন্য মাপকাঠিও ছিল। যেমন কোথাও কোথাও দুর্যোধনকেও রাজা বলা হয়েছে। সেকথা থাক। মথুরা থেকে রাধিকা এসেছেন তাঁকে নিতে। কৃষ্ণ যেতে চান না মথুরায়। তাই তিনি অদ্ভুত শর্ত দিলেন। বললেন, তিনি রাজা, অতএব হাতির পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবে সেই হাতি তাঁর রাজ্যের হলে চলবে না। তাঁর এমন বায়নাক্কা শুনে রাধিকা ও তাঁর আটজন সখী, মানে নয় জন নারী মিলে হাতির রূপ ধারণ করলেন। সেই হাতির উপরে বসলেন রসরাজরূপী কৃষ্ণ।শোনা যায়, দক্ষিণভারতে পথ চলতে চলতে নারীরা নাকি হঠাৎই হাতির রূপ ধারণ করতেন। তা দেখে বিদেশীরা (ভিন রাজ্য থেকে আসা লোকজন, যাঁরা এই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নন) বেশ অবাক হতেন। অর্থাৎ বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটত। ফরাসী পর্যটক জঁ-ব্যাপ্তিস্তে তাভারনিয়ের তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, সপ্তদশ শতকে গোলকোণ্ডায় (বর্তমানে হায়দরাবাদের অদূরে) তিনি দেখেছেন, প্রশিক্ষিতা নারীরা হাতির রূপ ধরে তার উপরে সুলতানকে বসিয়ে নিয়ে চলেছেন। এভাবে বায়ুসেবন করা নাকি নবাব-সুলতানদের বিলাসিতার অংশ ছিল।বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দির ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন টেরাকোটা মন্দিরে নবনারীকুঞ্জর দেখা যায়। বাংলা ও ওড়িশার পটচিত্রে এই দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে। দক্ষিণ ভারতের পাথরের মন্দিরের গায়েও এই বিশেষ মোটিফ রয়েছে। কোথাও হাতির বদলে ঘোড়াও দেখা গেছে।নবনারীকুঞ্জরের মতো পঞ্চনারীতুরঙ্গের দৃশ্যও দেখা যায় দক্ষিণভাতের হাম্পিতে। সেখানে তুরঙ্গ বা ঘোড়ার পিঠে দেখা যায় কামদেব মদনকে। স্বভাবতই তুরঙ্গের মূল চরিত্র সেখানে রতি। মদনের স্ত্রী রতি, এই দুই চরিত্রের সঙ্গে রসের যোগ রয়েছে। উৎসের বিচারে তাই এই রূপও প্রাসঙ্গিক।
📷 DEV Photography
Copyright Pujo Clicks Pujo Clicks Original