02/09/2025
না ট্য ব না ম থি য়ে টা র
আমাদের থিয়েটারের ইতিহাসবেত্তারা এই কথাটি খুবই মুন্সিয়ানার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন যে, বাংলা থিয়েটারের জন্ম খুব বেশি দিনের না। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে গেরাসিম লিয়েবেদেফ নামে একজন রুশদেশীয় মানুষের হাতে এর প্রতিষ্ঠা। তারপর কলকাতার ধনী বাবুদের হাতে তার উত্তরাধিকার এবং পথ চলা শুরু হয়ে অবশেষে ১৮৭২-এ ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার পাবলিকিকরণ। পাবলিক থিয়েটারের সেই চলার পথ খুব মসৃণ ছিল না বলেই বিশ শতকের চল্লিশের দশকে সমান্তরাল নাট্যধারা হিসেবে প্রথমে গণনাট্য এবং পরে সেটা ভেঙেই নবনাট্য তথা গ্রুপ থিয়েটারের জন্ম। আমাদের থিয়েটারের দুশো পঁচিশ বছরের সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসে আশ্চর্যজনকভাবে ঠাঁই পায় না বাংলার নিজস্ব নাট্যধারা। প্রসেনিয়াম মঞ্চমায়ার জৌলুস তাতে নেই, সুতরাং ‘থিয়েটার’ পদবাচ্যই নয় সেটা। খুব সচেতনভাবেই বাংলার সেই নিজস্ব নাট্যধারাকে আমরা ননপ্রসেনিয়ম ক্যাটাগরি হিসেবে দেশজ-নাট্য বলে দাগিয়ে দিলাম। ফাত্রা লোকের যাত্রাপালা, লেটো, ঝুমুর, সঙ্নাচ, ছৌ, মনসার ভাসান, বনবিবি, গম্ভীরা, আলকাপ— অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের এই সমস্ত নাচগানকে থিয়েটারের মতো উন্নততর শিল্পের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসাতে বাবুদের আপত্তি ছিল বই-কি! তাই প্রসেনিয়ম থিয়েটার আর গ্রামীণ নাট্যধারা আজও দুই স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে পরস্পর বাইনারিতেই দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের এই পরিহাস এবং তার দায়ভার শুধু কি আমাদের নাগরিক থিয়েটারকর্মীদের? ইতিহাসবেত্তা ও থিয়েটার-গবেষকদের দায় নেই কি? হ্যাপেনিং থিয়েটার নিয়ে অভিষেক চ্যাটার্জীর একরত্তি বইখানির প্রস্তাবনা লিখতে গিয়ে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি, কেননা আমাদের গ্রাম ও শহরের যা কিছু বিভাজন, তার পিছনে আছে মূলত শিক্ষিত নাগরিকের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আত্মকেন্দ্রিকতা। এই আত্মঘাতী প্রবণতাই আমাদের সামগ্রিক নাট্যচেতনায় পৌঁছুতে দেয়নি, প্রসেনিয়ম থিয়েটারের সঙ্গে মিলতে দেয়নি গ্রামীণ নাট্যধারার স্বাস্থ্যবান সম্পদকে। গ্রামকে ব্রাত্য করে আমরা আসলে পঙ্গু করেছি আমাদের থিয়েটারকেই।
ই তি হা স ক থা ক ও
ইতিহাসের দিকে তাকালে বারে বারেই তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। গত শতকের চল্লিশের বছরগুলিতে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল ছায়া আমাদের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে, ভারত-ছাড়ো আন্দোলনের ঢেউ যখন সারা বাংলাদেশ জুড়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, যুদ্ধের বাজার, ব্ল্যাক আউট, ব্ল্যাক মার্কেটের পোড়া মাটির নীতি—সব মিলিয়ে ম্যানমেড দুর্ভিক্ষে যখন গ্রামবাংলা উঠে এসেছে কলকাতায়, ফুটপাতে মৃতদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে শেয়াল-কুকুরে—তখনই আসলে শিক্ষিত বামমনস্ক মধ্যবিত্ত বাঙালি প্রথম উপলব্ধি করেন, গ্রামকে দূরে ঠেলে আসলে আমরা শিকড়টাকেই ধ্বংস করেছি। সেই প্রেক্ষিত থেকেই তো বিষ্ণু দে লিখবেন ‘জল দাও আমার শিকড়ে’। সেই তাগিদ থেকেই তো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলকাতা ছেড়ে গ্রাম পরিক্রমা শুরু, ব্যঞ্জনহেড়িয়ার বস্তিতে গিয়ে জীবনবোধের নতুন শিক্ষালাভ! এই গ্রামকে আঁকড়ে ধরার, কৃষক শ্রমিকের কর্মক্ষম হাতে হাত রাখার তাগিদ থেকেই তো গণনাট্য নামক বিকল্প সমান্তরাল নাট্যধারার সূচনা—যার মূল প্রেরণাই ছিল মঞ্চমায়া ত্যাগ করে থিয়েটারকে নিয়ে যেতে হবে গ্রামের মানুষের কাছে। এই গণনাট্যের হাত ধরেই পূর্ণেন্দু পাল—পানু পাল—তৈরি করবেন অ্যাজিটপ্রপ-ধর্মী পথনাটক। গম্ভীরার মতো দেশজ নাট্যশিল্পের আঙ্গিককে মিশিয়ে দেবেন সেই পথ নাটকের সঙ্গে। শ্রীরঙ্গম থেকে বিতাড়িত শিশিরকুমার ভাদুড়ি উপলব্ধি করবেন—বিলিতি থিয়েটার থেকে শুরু না হয়ে, যদি যাত্রা থেকে আমাদের থিয়েটার শুরু হতো, তাহলে তা হয়ে উঠতে পারত আমজনতার, হয়ে উঠতে পারত প্রকৃত জাতীয় থিয়েটার।
উনিশশো সত্তরের বছরগুলিতে যখন গ্রুপ থিয়েটার হাজারো সমস্যায় ভুগছে। যখন আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়ে ব্যবসায়িক নাট্যশালাগুলি প্রমোদের নয়া উপাদানের জন্য ক্যাবারে ড্যান্সার মিস্ শেফালির দ্বারস্থ হচ্ছেন। প্রেক্ষাগৃহের অভাব, কর্পোরেশন ট্যাক্স, ভালো দর্শকের অভাব, পুঁজির অভূতপূর্ব সংকট—ইত্যাদির মুখোমুখি হয়ে গ্রুপ থিয়েটার দলগুলি যখন আত্মরক্ষার্থে ব্যবসায়িক কলা-কৌশলে দর্শক টানতে ব্যস্ত, প্রতিবাদী চরিত্র থেকে সরে এসে আপসকামিতাই যখন অনিবার্য হয়ে উঠছে, তখন এই নাগরিক থিয়েটারের প্রসেনিয়মের জৌলুসকে বর্জন করে দেশজ নাট্যধারা থেকে রসদ খুঁজেছিলেন বাদল সরকার। দুই থিয়েটারের সিনথিসিস তৈরি করতে চেয়েই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত থার্ড থিয়েটার। বাদল সরকারই সেই পথিকৃৎ যাঁর দেখানো পথে বেশ কিছু দল প্রসেনিয়ম ছেড়ে ভিন্ন পথের সন্ধানী হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে দূরে—গ্রাম ও মফস্বলে—গ্রামীণ থিয়েটারের এক-একটা রূপ নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা করে যাচ্ছেন এখনও অনেক নাট্যপ্রেমী। তৈরি হয়েছে অনেকানেক নাট্যগ্রাম। কলকাতা তাকে হয়তো অস্বীকারই করতে চেয়েছে, স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হয়েছে। কিংবা বিকল্প থিয়েটার-স্পেশ হিসেবে দু-চার দিনের ওয়ার্কশপ কাম প্রমোদ ট্যুরে গিয়ে কলকাতা যেন তাকে—গ্রাম বা মফস্বলকে ধন্য করে এসেছে।
আমাদের দেশজ নাট্যধারার সমৃদ্ধ অতীত--নাচ-গান-অভিনয়-অ্যাক্রোবেটস্-ক্যারিকেচার—অসম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ সব মিউজিক্যাল টুলস্, প্রভূত-শক্তিশালী জনসংযোগের ক্ষমতা—এসব থেকেই তো পুনর্জন্ম হতে পারত আমাদের নাগরিক থিয়েটারের। ঠিক যেভাবে অভিনয়-নাচ-গান-চিত্রকলা-ভাস্কর্য-কবিতা-মডেলিং ইত্যাদি বিচিত্র পারফরমেটিভ উপাদান মিলে মিশে গত শতকের পাঁচের দশকে আমেরিকায় জন্ম নিচ্ছে হ্যাপেনিং থিয়েটার। যাকে বলা চলে থিয়েটারের মতো একটি সদাজ্যান্ত শিল্পমাধ্যমের প্রভূত সম্ভাবনার নব নব উদ্ভাবনার পথ আবিষ্কার। সেই পথ কাটা ও আবিষ্কারের নব নব সম্ভাবনা ঘটতে পারত আমাদের বাংলাতেই।
সম্ভাবনার সেই দৃষ্টান্তও তো ছিল আমাদের অতীতে, ঠিক যেভাবে গিরিশচন্দ্র ঘোষ লোকপুরাণ থেকে খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁর থিয়েটারের পুনরুজ্জীবনের উপায়। যাত্রা ও পালাগানের আঙ্গিক—গান, কথকথা, কবিগান, পদ্যসংলাপ কিংবা বিবেকচরিত্র—এ সমস্তই তো তাঁর থিয়েটারকে লোকায়তিক চরিত্র দান করেছিল—যা তাঁকে সমকালে প্রকৃত জাতীয় নাট্যাচার্য হিসেবে সর্বজনপ্রিয় করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন পর্যায়ের নাটকেও সেই দেশজ উপাদানের বিপুল সিনথিসিস যে ঘটেছিল, শঙ্খ ঘোষের রবীন্দ্রনাট্য-বিষয়ক আলোচনায় তার যথেষ্ট পরিচয় আছে। আজ যখন এই অতিমারীর করাল গ্রাসে আমাদের নাগরিক থিয়েটার-প্রেক্ষাগৃহগুলি তালাবন্ধ, যখন অস্তিত্ব রক্ষার একান্ত তাগিদেই থিয়েটার দলগুলি বাধ্য হচ্ছে শহরের প্রান্তে-প্রান্তরে—কৃষ্ণকক্ষে, নদীতীরে, পুরোনো বটের ছাওয়ায়, ধুলোমাখা ফাটলধরা মন্দির-চাতালে, গ্রামের আখড়ায়, বনবীথিকায়—স্পেশ খুঁজে নিতে। স্বাস্থ্যকর এই জার্নি যদি সত্যিই কোনোদিন দেশজ মনকে ছুঁতে পারে, যদি আপন করে শিখে নিতে পারে দেশজ আঙ্গিকের বিচিত্র কলাকৃৎ, তাহলেই হয়তো বাস্তবে রূপ নিতে পারত আলাদিনের সেই আশ্চর্য দৈত্য। এই আত্মাবিষ্কারের তাগিদেই—ফুটপাতে, শপিংমলে, আর্ট-গ্যালারিতে, বন্ধ কারখানার গেটে, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে—তৈরি হতে পারত আমাদেরও নিজস্ব কোনো হ্যাপেনিং থিয়েটার।
-------------------------------------
উপরের অংশটি শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, নাট্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক শ্রীমলয় রক্ষিত কৃত ভূমিকা বা প্রস্তাবনা। বাংলা সাহিত্যে বিরল একটি গ্রন্থ। গ্রন্থের নাম - এবং হ্যাপেনিং থিয়েটার। সঙ্গে রইল হ্যাপেনিং-এর প্রাণপুরুষ অ্যালেন ক্যাপ্র সহ কিছু বিখ্যাত হ্যাপেনিং-এর চিত্র।
দেখে নেওয়া যাক বইটিতে কি কি স্থান পেয়েছে -
প্রস্তাবনা (অধ্যাপক মলয় রক্ষিত)
নিবেদন
কথারম্ভ
হ্যাপেনিং
পটভূমি
Avant-garde Movement
Experimental Theatre
French & Russian Avant-garde theatre
Theatre of the Absurd
Dadaism
Futurism
উৎস
যাত্রারম্ভ
শিল্পশৈলী ও দর্শন
Theatre of Cruelty
Panic Movement
Guerrilla Theatre
The Living Theatre
Fluxus
হ্যাপেনিং বনাম ফ্লুক্সাস
হ্যাপেনিং বনাম নাটক
Theatre of the Oppressed
অ্যালান ক্যাপ্র এবং হ্যাপেনিং
How To Make A Happening
হ্যাপেনিং-এর বিশ্বব্যাপী বিস্তার
বর্তমান সময়ে হ্যাপেনিং
কিছু বিখ্যাত হ্যাপেনিং
উল্লেখসূত্র এবং টীকা
ঋণস্বীকার ও কৃতজ্ঞতা
তৃতীয় মুদ্রণের আর মাত্র কয়েকটি কপি রয়েছে।
এবং হ্যাপেনিং থিয়েটার
অভিষেক চ্যাটার্জী
মূল্য - ২৫০ টাকা
সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করুন
কলেজ স্ট্রিটে
বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স
দে বুক স্টোর (দীপুদা)
দেজ পাবলিশিং
আদি দে বুক স্টোর
বুক ফ্রেন্ড
বিমলা বুক এজেন্সি
প্ল্যাটফর্ম
লালন
উত্তরপাড়া
আনন্দ লহরী বুক ক্যাফে
শ্রীরামপুর
ভেস্ট পকেট
হাজরা
প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স
সোদপুর
পাপাঙ্গুলের ঘর
গোমস বুক হাউস
চুঁচুড়া
বিদ্যার্থী ভবন
শান্তিনিকেতন (বোলপুর)
রামকৃষ্ণ বুক স্টল
ত্রিবেণী
গীতাঞ্জলি
নবদ্বীপ
সুজয়া প্রকাশনী
কল্যাণী
শম্ভু বুক স্টল
দমদম ক্যাণ্টনমেন্ট
বইঘর
বর্ধমান
বুড়োরাজ
অরবিন্দ
বাংলাদেশে
বাতিঘর
তক্ষশীলা
কথাপ্রকাশ
রকমারি
ইন্দো বাংলা
অনলাইনে
Boighar.in
এছাড়া আমরা আছি পৌঁছে দিতে
বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স
২৭/৬, সূর্য সেন স্ট্রিট, কল - ০৯
8013655643 / 7686037907