26/02/2025
শিব: ব্যাখাতীত মহাদেব ::
জগতে যদি সবচেয়ে রহস্যময় কোনো চরিত্র থাকে, তবে তিনি শিব। তাঁকে বোঝা সহজ নয়।
কখনো তিনি গায়ে ছাই মেখে, গলায় সাপ ঝুলিয়ে শ্মশানে ঘুরে বেড়ানো এক সন্ন্যাসী; আবার কখনো স্ত্রীকে পাশে রেখে, কোলে গণেশকে নিয়ে থাকা এক আদর্শ গৃহস্থ।
একদিকে আগম-নিগম-তন্ত্র নিয়ে পার্বতীর সঙ্গে জটিল আলোচনা করা এক পরিণত দার্শনিক, অন্যদিকে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া এক শিশুসম প্রেমিক।
কখনো তিনি ছোট্ট শিশু মার্কণ্ডেয়র আকুল ডাকে সন্তুষ্ট হয়ে যমকে তাড়িয়ে দেন, আবার কখনো মহাবীর অর্জুনের অসীম তপস্যার পরও তাঁকে দেখা দিতে নানা ছলনার আশ্রয় নেন।
শিবের চরিত্র ব্যাখ্যার অতীত।
গঙ্গাও একদিন ভেবেছিলেন, "এই বৃদ্ধের শক্তি আর কতটুকু? আমাকে ধারণ করা এত সহজ?" কিন্তু ভগীরথের আহ্বানে যখন স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নামলেন, তখনই ভুল বুঝতে পারলেন। মহাদেবের জটাজুটে বন্দী হয়ে ঘুরপাক খেতে লাগলেন পথহারানো শিশুর মতো। অহংকারী গঙ্গার তখন বের হওয়ার পথ নেই! শেষমেশ সেই রহস্যময় হাসিমুখ বৃদ্ধের কৃপায় মুক্তি পেলেন—অহংকার চূর্ণ হলো।
শিব অজ্ঞানীর অহংকার বিনাশ করেন, অথচ নিজে সম্পূর্ণ নিরহংকারী। স্ত্রীর পায়ের নিচে শুয়ে পড়তেও তিনি একটুও দ্বিধা করেন না!
রক্তবীজের রক্ত পান করে মা কালি যখন উন্মত্ত হয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিলেন, তখন মহাদেবই তাঁকে শান্ত করেছিলেন—নিজের বুক পেতে দিয়ে, স্ত্রীর রোষে নিজেকে সমর্পণ করে।
শিব ছাড়া প্রকৃতি যেন শব! পুরুষ ও প্রকৃতির এমন অপূর্ব মিশেল আর কোথায়?
তবু এই শান্ত-শিষ্ট শিবই আবার ক্রুদ্ধ রুদ্র হয়ে ওঠেন। সতীর দেহ নিয়ে উন্মত্ত তাণ্ডব নৃত্যে মেতে ওঠেন, দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করে দক্ষের গলা কাটেন, তবু তাঁর ক্রোধ থামে না! সদ্যমৃত স্ত্রীর দেহ কোলে নিয়ে তিনি প্রলয় সৃষ্টি করেন।
কাজী নজরুল তাই লিখেছেন—
"হে শিব, সতীহারা হয়ে নিষ্প্রাণ
ভূ-ভারত হইয়াছে শবের শ্মশান!"
তাঁর ক্রোধে পুড়ে যান কামদেব, তাঁর পিনাকে ধ্বংস হয় ত্রিপুরা, তাঁর ত্রিশূলে বিদ্ধ হয় জলন্ধর!
অথচ এই ভয়ংকর মহাশিবই আবার এক ডাকেই চলে আসেন ভক্তের কাছে, কোনো অভিযোগ ছাড়াই।
সমুদ্র মন্থনে হলাহল বিষে যখন সৃষ্টির অস্তিত্ব বিপন্ন, তখন মহাদেব নির্বিকারভাবে এসে বিষ পান করেন—
He came like a boss, He saved like a boss, He walked off like a boss.
শিব সহজ-সরল, ভোলানাথ! একটুখানি বেলপাতা আর একটু ভালোবাসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট। তাই সীতামাতার হাতে তৈরি মাটির শিবলিঙ্গেও তিনি বিরাজ করেন, আর দামী শ্বেতপাথরের শিবলিঙ্গ এনে রাখলেও তাঁর অবস্থান বদলায় না।
হনুমান, যিনি এক লাফে সমুদ্র পেরিয়েছেন, যিনি একাই লঙ্কা ধ্বংস করেছেন—তিনিও শিবের সামনে শিশু! মহাদেব যেখানে থাকতে চান, সেখান থেকে তাঁকে সরানোর সাধ্য কারও নেই।
শিব ভক্তের ভালো-মন্দ বিচার করেন না। কে ডাকলো, কেন ডাকলো—এসবের পরোয়া নেই!
রাক্ষসরাজ রাবণের ডাকেও তিনি আসেন, বর দিয়ে প্রায় অমরত্ব দেন।
মহাবীর অর্জুনের ডাকেও আসেন, সহজেই দিয়ে দেন বিধ্বংসী পাশুপত অস্ত্র।
ছোট্ট এক গোপালের আহ্বানেও তিনি চলে আসেন—উজ্জয়ীনিতে বিরাজ করেন মহাকাল হয়ে।
এমনকি মধ্যরাতে ঘুমন্ত পান্ডবদের হত্যার জন্য বের হওয়া অশ্বত্থামার ডাকেও তিনি সাড়া দেন—তাঁর হাতে তুলে দেন ব্রহ্মশস্ত্র!
শিব ভয়ংকর! শ্মশানে বসবাস, গায়ে মাখেন মৃতের ছাই, গলায় বিষধর সাপ, ধ্বংসই তাঁর আনন্দ!
তবু শিব সুন্দর! সত্যম শিবম সুন্দরম।
শিব মানেই সত্য, শিব মানেই সৌন্দর্য।
তাই নজরুলও গেয়ে ওঠেন—
"কে শিব সুন্দর শরৎ-চাঁদ চূড়
দাঁড়ালে আসিয়া এ অঙ্গনে,
পীড়িত নরনারী আসিল গেহ ছাড়ি
ভরিল নভোতল-ক্রন্দনে..."
এই কারণেই শিব কারও কাছে হিরো, কারও কাছে ভিলেন! তিনি ব্যাখাতীত—তাঁকে বোঝার চেষ্টাই বৃথা।
শিব আদর্শ পুরুষ! তাঁর কাছে নর-নারী ভেদ নেই। তাঁর দৃষ্টিতে সবাই সমান। তাই তিনি বিরাজ করেন অর্ধনারীশ্বর রূপে—অর্ধেক পুরুষ, অর্ধেক নারী! বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত আর কোথাও আছে?
নারীরা শিবের মতো বর চান। অনেকেই বলেন, "শিব? সে আবার কেমন বর?"
জ্বি, শিবই আসল বর! সত্যিকারের আদর্শ পুরুষ। স্ত্রীর কঠোর তপস্যায় তিনি প্রসন্ন হন, স্ত্রীর পায়ের নিচে শুয়ে থাকতেও হাসিমুখে রাজি।
স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি পাগলপ্রায়, স্ত্রীর প্রতিশোধে তিনি দক্ষযজ্ঞ ধ্বংসকারী।
স্ত্রী বিয়োগে তিনি সংসারত্যাগী, স্ত্রীর সঙ্গে তিনি আনন্দনৃত্যে মেতে ওঠেন।
স্ত্রীকে তিনি শিবপুরাণ ও তন্ত্র ব্যাখ্যা করেন, আবার স্ত্রীর কাছ থেকেই তিনি শাক্ততত্ত্ব ও তন্ত্র শোনেন।
স্ত্রীর কোলেও তিনি শিশু হয়ে বসেন, আবার স্ত্রীর রোষ শান্ত করতেও বুক পেতে দেন।
তিনি দুর্গারূপী স্ত্রীর হাতে তুলে দেন মহিষাসুর বধের ত্রিশূল, আবার অন্নপূর্ণারূপী স্ত্রীর কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আসেন।
"পার্বতী পতি হর হর মহাদেব!"
স্ত্রীর নামেই যার শুরু, তাঁকে পার্বতী থেকে আলাদা করা সম্ভব?
তাই নারীরা শিবের মতো বর চায়—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
শিবকে ব্যাখ্যা করতে যাবেন না—এ বৃথা চেষ্টা।
তিনি যোগী ও গৃহী, তিনি রাগী ও ভোলা, তিনি জ্ঞানী ও পাগলা, তিনি বৃদ্ধ ও শিশু—সবকিছু একসঙ্গে মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় সত্তা।
অর্ধনারীশ্বর রূপে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সম্মান, ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হোক—জগতে, সমাজে, পরিবারে। হর-গৌরীর মতো সম্পর্কই হোক আদর্শ।
বিশেষত আজকের সমাজে, এই শিক্ষার প্রয়োজন আরও বেশি।