20/06/2024
শতবর্ষে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে শান্তিনিকেতন। এই ঐতিহ্য শুধু অতীতচারণার বিষয় নয়, বরং আজও জীবিত, আজও প্রবহমান। সেই প্রবাহের প্রাণকেন্দ্রে কী আছে তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে, কিন্তু ইউনেস্কোর পরিচিতি অনুযায়ী, শান্তিনিকেতন ছিল একটি আবাসিক বিদ্যালয় এবং কলাকেন্দ্র যার ভিত্তি প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সীমানা পেরনো মানব-ঐক্য।
মুদ্রণ ও গ্রন্থসংস্কৃতির আঞ্চলিক সীমানাও পেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সমসময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা সেই চেষ্টার পরিচয় নিয়ে শতবর্ষে উত্তীর্ণ হল তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার পরে পরেই গ্রন্থনবিভাগের প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় এ দুয়ের একটা সংযোগ যে ছিল সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২, গ্রন্থনবিভাগ প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউসের স্বত্বাধিকারী চিন্তামণি ঘোষকে লেখা চিঠিতে, 'শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠানটিকে যথাবিধি সর্ব্বসাধারণের হস্তে সমর্পণ করিয়াছি। আমার সমস্ত বাংলা বইগুলির স্বত্ব লেখাপড়া করিয়া বিশ্বভারতীর হাতে দিয়া আমি সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি লইয়াছি। এক্ষণে এই অধিকারের হস্তান্তর উপলক্ষ্যে আমার গ্রন্থপ্রকাশের কোনো একটি সন্তোষজনক ব্যবস্থা হইতে পারিলে আমি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত হইতে পারিব।' এই সন্তোষজনক ব্যবস্থার একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ।
গত একশো বছরে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগকে অনেক বাধা-বিপত্তি, আর্থিক ও প্রশাসনিক সংকট অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, ধীরে ধীরে গ্রন্থ- প্রকাশের ক্ষেত্রে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাতন্ত্র্যে তা পেয়েছে সর্বভারতীয় স্বীকৃতি। বিক্রয়ের পরিমাণও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের প্রকাশন শুধু রবীন্দ্রনাথের বইয়ে সীমিত থাকেনি, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গে এবং অন্যান্য বিচিত্র বিষয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। যেমন লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা, বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ গ্রন্থমালা ও রবীন্দ্রপরিচয় গ্রন্থমালা। যে-সব লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে আছেন অজিতকুমার চক্রবর্তী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীঅমিতাভ চৌধুরী, অমিয়নাথ সান্যাল, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, এল. কে. এলমহার্স্ট, ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী, গণনাথ সেন, চারুচন্দ্র দত্ত, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী, নির্মলকুমার বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রবাসজীবন চৌধুরী, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন, রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, শ্রীপ্রমথনাথ বিশী, প্রিয়রঞ্জন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, মনোমোহন ঘোষ প্রমুখ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔপনিবেশিক ধারণার উল্টোদিকে হেঁটে রবীন্দ্রনাথ যেমন তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী (বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নয়), তেমনই ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস’-এর কেম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন বা হার্ভার্ড-এর আদর্শ নাকচ করে তৈরি করেছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ। এই প্রকাশনার প্রথম বই রবীন্দ্রনাথের বসন্ত, একটি নাটক। তাঁর অমল পণ্ডিত হতে চায়নি। তাঁর প্রকাশনাও গবেষণাগ্রন্থ দিয়ে যাত্রা শুরু করল না। তাঁর ছাপাখানাও শুরু করেছিল গানের বই গীত-পঞ্চাশিকা দিয়ে। তাঁর শান্তিনিকেতনের ভাবনায় যে খোলা মাঠের খেলা, নইলে প্রাণের সঙ্গে প্রাণ একতানে মিলবে কী করে! গ্রন্থনবিভাগের বইপত্রেও তাই খোলা মাঠেরই খেলা। প্রচ্ছদে অতটা খোলা জায়গা, খোয়াইয়ের প্রান্তরের রঙে। ত্যাগের ভারতবর্ষের রঙেও।