01/11/2025
শুভ ৬০তম জন্মদিন কিং খান! 👑♥️
এখন শাহরুখের সিনেমা রিলিজ করা মানে জাতীয় উৎসব কিন্তু চিরকাল এমনটা ছিল না। নিউ দিল্লির রাজেন্দ্র নগরে একটি ভাড়ার ফ্ল্যাটে জন্ম নিয়েছিল এক ছেলে ২ নভেম্বর ১৯৬৫। নাম শাহরুখ খান। মধ্যবিত্ত পরিবার, দুটো স্বপ্ন আর তিনটে প্রত্যাশা। কোনো সিনেমা-ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, কোনো নাম-ডাক নেই, কোনো সংযোগ নেই। শুধু আছে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আর জেদ।
স্কুলে খেলত, থিয়েটারে অভিনয় করত। হকি ছিল তার প্রথম ভালোবাসা, কিন্তু কাঁধে আঘাত সেই স্বপ্ন মাটি করে দিল। তারপর থিয়েটার। বারি জন-এর স্কুলে, দিল্লি থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপে প্রশিক্ষণ নিল। সবাই হাসে, তালি বাজায়। কিন্তু সেই তালি একটা দিন পুরো বিশ্ব নাড়িয়ে দেবে বলে কেউ জানে না।
ইকোনমিক্সে ডিগ্রি, জামিয়া মিল্লিয়ায় মাস কমিউনিকেশনে ভর্তি কিন্তু শেষ করা হয়নি। কারণ জীবনের পথ বদলে গেল। বাবা ক্যান্সারে চলে গেলেন, মা ডায়াবেটিসের জটিলতায় আর ছোট বোন শাহনাজ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এতিম হয়ে গেল শাহরুখ, কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি।
"কোন সিনেমা নয়, এটাই আমার জীবন," মনে মনে ভাবত। ১৯৮৮ সালে "ফৌজি" টিভ সিরিজ। মাত্র ২৩ বছর বয়সে জাতীয় পর্দায়। তারপর "সার্কাস", "ঘর জমাই" একটা একটা করে সিরিজ। টেলিভিশনে সন্তুষ্ট ছিল আপাতত, কিন্তু জীবন তো অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়। পাঁচটি ফিল্মের চুক্তি নিয়ে মুম্বই চলে এল।
১৯৯২। "দিওয়ানা" রিলিজ হল। শাহরুখ খান বলিউডের নতুন মুখ। কিন্তু এটা শুরু ছিল মাত্র। তিন বছরে দশটি ফিল্ম। প্রতিটি ফিল্মে নতুন শাহরুখ। "বাজিগর"-এ ভিলেইন, "ডার"-এ অবসেসড প্রেমিক। প্রতিটি চরিত্রে এমন গভীরতা যা অভিনয়কে শিল্পে পরিণত করে। কিন্তু শাহরুখ জানে, "সব কিছুর আগে মানুষ, তারপর চরিত্র।"
১৯৯৫। "দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে" রিলিজ হল। রাজ এক বিদেশি ভারতীয় যুবক যে প্রেমের নামে সবকিছু ঝুলিয়ে দেয়। প্রতিটি সিনে শাহরুখের রোমান্স, কমনীয়তা, আত্মবিশ্বাস। "বড় বড় দেশে এমন ছোট ছোট বাত হোতি রেহতি হ্যায়," তার ডায়ালগ। একটা লাইনই যথেষ্ট ছিল পুরো ভারতবর্ষকে মুগ্ধ করার। "জা সিমরন, জা। জী লে আপনি জিন্দগী।" এই কথা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মন কেড়ে নিল। বলিউড বুঝে গেল এই শাহরুখ শুধু অভিনেতা নয়, এক যুগের সূচনা।
তারপর আসে "দিল তো পাগল হ্যায়", "কোয়ান্টাম অফ সোলাস", "দিলওয়ালে দুলহানিয়া"। প্রতিটি ফিল্মে নতুন মাত্রা। শাহরুখ জানে, "সাফল্য শুধু নাম নয়, এটা দায়িত্ব। দায়িত্ব মানুষের ভালোবাসার প্রতি।" তাই তিনি প্রতিটি ফিল্মে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দেন।
২০০০ এর দশক এসে যায়। এখন শাহরুখ শুধু প্রেমের গল্প নয়, সামাজিক সমস্যার গল্প বলে। "স্বদেশ" (২০০৪) নাসা ইঞ্জিনিয়ার যে মাতৃভূমি ছেড়ে আসে না। "চাক দে ভারত" (২০০৭) হকি কোচ যে মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। "মাই নেম ইজ খান" (২০১০) আসপার্গার সিন্ড্রোমে ভোগা মানুষ যে পোস্ট-৯/১১ বিশ্বে নিজের স্থান খুঁজে পায়। প্রতিটি ফিল্মে শাহরুখ শুধু চরিত্র নয়, একটা বার্তা রেখে যায়। "মাই নেম ইজ খান অ্যান্ড আই এম নট আ টেররিস্ট," তার সেই ডায়ালগ সারা বিশ্বকে থামিয়ে দেয়।
বলিউড তাকে পুরস্কৃত করে। ১৫টি ফিল্মফেয়ার, গণনাহীন সংখ্যক অন্যান্য পুরস্কার। কিন্তু সবচেয়ে বড় পুরস্কার আসে ২০২৩ সালে—ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড। "জওয়ান"-এর জন্য। ৩৩ বছর অপেক্ষার পর জাতীয় স্বীকৃতি। প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে। শাহরুখর চোখ ভেজে যায়। শুধু পুরস্কার নয়, এটা ন্যায়বিচার। বছরের পর বছর তার অবদান, তার প্রতিভা, তার দেওয়ার যাত্রা সবকিছু স্বীকৃত হয়েছে।
তার আগেও স্বীকৃতি এসেছিল। ২০০৫-এ পদ্মশ্রী। ফ্রান্স থেকে "অর্ড্রে ডেস আর্টস এ ডেস লেট্রেস"। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক পুরস্কার "লিজিয়ন অফ অনার"। ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড। বিবিসি'র "১০০ গ্রেটেস্ট সিনেমা স্টার"-এর তালিকায় স্থান। প্রতিটি স্বীকৃতি বলে, "শাহরুখ, তুমি বিশ্বের।"
কিন্তু শাহরুখ জানে, "সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি মানুষের ভালোবাসায়।" অর্থনীতিকের দিক দিয়ে তিনি এক বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। "রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট" গৌরি খানের সাথে ২০০২ সালে শুরু করা। কলকাতা নাইট রাইডার্স ট্রিনিবাগো নাইট রাইডার্স। প্রতিটি প্রকল্পে সফলতা। কিন্তু টাকা সেটা শুধু মাধ্যম, লক্ষ্য নয়।
বরং শাহরুখর সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মানসিকতা। "ভয়ই আমাদের একমাত্র আসল শত্রু," তিনি যুবকদের বলেন। কখনো বলেন, "মানুষের হৃদয় জয় করা সবচেয়ে বড় জয়।" "পরিবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ," তাই প্রতিটি বড় প্রজেক্টে গৌরি খান, সন্তানরা সাথে থাকেন। ছোট বোন শাহনাজের যত্ন নিয়েছে বছরের পর বছর একটা ভাইয়ের দায়িত্ব।
বছরের পর বছর ধরে শাহরুখ প্রমাণ করেছে যে সিনেমা-ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা জরুরি নয়। বলিউডে প্রবেশের সুবিধা জরুরি নয়। জরুরি শুধু প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম, মানবিক মূল্যবোধ আর অবিরাম বিশ্বাস। শাহরুখ একজন সাধারণ মানুষ ছিল, আর সাধারণ মানুষকে রাজা বানানোর স্বপ্ন দেখত।
"জীবন ওয়ালের মতো যতক্ষণ তুমি দৌড়াও, ততক্ষণ সব ঠিক থাকে। যেদিন থেমে যাবে, সেদিন তুমি অর্থহীন," তার একটা চরিত্র বলেছে। শাহরুখ এটা বাস্তবে রূপায়িত করেছে। ৬০ বছর হয়ে গেলেও, তিনি কখনো থেমে নেই। নতুন ফিল্ম করে চলেছেন, নতুন প্রজেক্ট নিচ্ছেন, মানুষের সাথে সংযোগ রাখছেন।
লাক্সারি গাড়ি আছে, বিলাসবহুল বাড়ি আছে, কিন্তু হৃদয় এখনও সাধারণ মানুষের সাথে। রাস্তায় দারিদ্র্য দেখলে বুঝতে পারেন কারণ তিনি এটা জানেন। প্রতিটি সাফল্যের পিছনে গরিবির ছায়া, মা-বাবার অভাব, মানসিক ট্রমা এগুলো তাকে শেখিয়েছে মানুষ হতে।
শাহরুখের মানসিকতা অনন্য যখন ব্যর্থতা এসেছে, তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন। "আপস" ফিল্ম ভালো পারফরম্যান্স করেনি, কিন্তু তিনি বলেছেন, "প্রতিটি ব্যর্থতা একটা শিক্ষা।" যখন সমালোচনা এসেছে, তিনি কান খুলে শুনেছেন। "কোনো মানুষ বড় না ছোট নয় সবাই সমান," এটাই তার দর্শন। প্রতিটি ফিল্মে শাহরুখ নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছেন। সিনেমা হলে, ওটিটিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্বত্র তার উপস্থিতি।
কিন্তু যা সবচেয়ে বড় কথা, তা হল শাহরুখ খান একটা আন্দোলন। তিনি দেখিয়েছেন যে স্বপ্ন দেখলে, প্রচেষ্টা করলে, বিশ্বাস রাখলে কোনো প্রতিবন্ধকতা অপরাজেয় নয়। তিনি দেখিয়েছেন যে মানবিক থাকা সফলতার চাবিকাঠি। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রতিটি মানুষের মধ্যে রাজকীয় সম্ভাবনা আছে শুধু আবিষ্কার করতে হয়।
আজ ২ নভেম্বর শাহরুখ খানের ৬০তম জন্মদিন। ছয় দশক। লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে হাসি এনেছে। কত মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখিয়েছে। পুরো বিশ্বকে "ভারতীয় সিনেমা" শেখিয়েছে।
নিউ দিল্লির সেই ভাড়ার ফ্ল্যাটের ছেলে, যার কাছে বাবা-মা নেই, যার কাছে সংযোগ নেই, যার কাছে সবকিছু অভাব সেই ছেলে আজ বিশ্বের একটা মুকুট। শুধু অভিনেতা নয়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ।
শুভ জন্মদিন, শাহরুখ খান। আরও ছয় দশক এভাবে লড়াই করো। আরও ছয় দশক মানুষকে স্বপ্ন দেখাও। কারণ তুমি শুধু একজন অভিনেতা নই তুমি একটি প্রতীক। তুমি হৃদয়ের বাদশাহ। এবং বিশ্ব তোমাকে ভালোবাসে, চিরকাল ভালোবাসবে।
✍️ Rounak Ghosh